গল্প: সময়
২০১১। ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টের পাশের সরকারী হোটেল সেন্টুরের খাবার থেকে ভিন্নতার স্বাদ নিতেই মাঝে মাঝেই মহিপালপুরে গলির ভেতরে এক শ্বেত-শুভ্র টুপি-দাঁড়িওয়ালা চাচার রেস্তরাঁতে বিরিয়ানি খেতে যেতাম। প্রায় ১০০ স্কয়ার ফিটের আয়তনের একটি রেস্তরাঁ। সাকুল্যে সাতজন বসে খেতে পারবে। গলির রাস্তার উপরই ডেকচিতে হরেকরকম মসলাসহ বাসমতি চালের চিকেন ও মাটন বিরিয়ানি রান্না চলছে। বিকেলবেলা একবারই রান্না হয়। নিট এন্ড ক্লিন। অত্র এলাকায় তো বটেই, অনেক দূরের লোকের কাছেও ভীষণ জনপ্রিয় চাচার বিরিয়ানী। সন্ধ্যার একটু পরে গেলে আর খাবার পাওয়া যায় না। বেশির ভাগই পার্সেল চলে যায়। চাচার ভাষ্যমতে, উনার গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্রান্ডফাদার মুঘলদের হেঁসেলেও কাজ করেছে।
একজন ভারতীয় বন্ধুই উনার সন্ধান দিয়েছিল। তখন দিল্লীর কোন জায়গায় কোন কোন খাবার ভালো পাওয়া যায় তা ঢুঁড়ে চলেছি, বিশেষ করে নন-ভেজ। নেহেরু প্যালেসের কোরেশীর চিকেন ও রুমালী রুটি, রাজীব চকের জাফরানের ভেজ থালি, দিল্লী জামে মসজিদের পাশে বিখ্যাত করিম’স এ হরেকপদ, বেরসরাই-এ কানাগলিতে নানা পদের রুটি, জেএনইউ-এ বাটার চিকেন আর মমোস, চাঁদনী চকের আফগানি রুটি-বিরিয়ানি, নিজামদ্দিনে ইকবালের কাবাব ও পাশের রেস্তরাঁগুলোতে নানা আয়োজনের বিরিয়ানি আরো কত জায়গা…!
সেভাবেই এই চাচার পাত্তা। তবে মজার বিষয় হচ্ছে ছোট রেস্তরাঁগুলোতে বিরিয়ানি দেওয়া হয় পাল্লাতে মেপে। অর্থাৎ হাফ কেজি, এক কেজি, এক পোয়া এভাবে। বিরিয়ানি দাঁড়িপাল্লায় মেপে খেতে হবে ভাবতেই প্রথমে অদ্ভুত লেগেছিল। তবে পরে এ নিয়ে বিরাট প্রতিযোগিতা হত। কে কতটুকু খেতে পারে! এক শ্রীলংকান বন্ধু প্রায়শই দেড় কেজি-পৌনে দুকেজি সাবাড় করত। রেস্তরাঁর চাচাও আমাদের এই প্রতিযোগিতায় মজা পেত।
ভেতরের গল্প: সময় বড় নিষ্ঠুর। ২০১৪ সালের পর নয়া চন্দ্রগুপ্তের ভারতে শ্বেত-শুভ্র টুপি-দাঁড়িওয়ালা চাচার মতো লোকেদের তিন পুরুষের ব্যবসাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে হিংসার আগুনে। ফলাফল…?
২
গল্প: তোমরা বনাম আমরা
একদিন মনীশ নামের এক ভারতীয় বন্ধুর সাথে বের হয়েছি। হোটেল থেকে বের হয়ে পাবলিক বাসে করে মহিপালপুরে আসতে হয়। কিলো তিন-চারেক রাস্তা। মিনিবাস প্রায় ফাঁকা। সামনের সিটে আমরা বসলাম। একটু পরেই আরেক বাসস্টপে বাস থামলে চারজনের একটি পরিবার উঠল। সাধারণ পোশাক-আশাক। সাথে পোটলা-পুটলি। বাসের মাঝের সিটগুলো ফাঁকা থাকা স্বত্তেও উনারা সকলেই একেবারে পেছনের সিটে গিয়ে বসল। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল?
পরে আমার ভারতীয় বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটি নিয়ে। ও জানালো ওরা দলিত। নিজেদের থেকেই ওভাবে বসেছে। অনেক সময় ভদ্রমানুষ(?) ওদেরকে পাশাপাশি সিটে বসায় পছন্দ করে না। আমি শুধু বললাম, ‘হুম’।
ভেতরের গল্প: দেখতে মানুষের মতো হলেও ‘মানুষ’ হওয়া অনেক কঠিনরে পাগলা!!
৩
গল্প: স্বভাব
ভদ্রলোক। সামাজিক স্ট্যাটাসে লোকে তাই বলবে। দশাসই। চেহারা দেখে লোকে তাই বলবে। সেন্টুর হোটেল। থাকা ও খাওয়া ফ্রি। তো ফ্রি খাওয়া হলে বাঙ্গালীদের জাত কিছুটা হলেও চেনা যায়। হরেক পদের খাবার। দেশি এই লেজবিহীন ভদ্রলোক নিয়মিত সকালের নাস্তায় শুরুতেই দু/তিনটি সেদ্ধ ডিম ও হাবিজাবি নিয়ে এক টেবিলে বসে খাওয়া শেষ করে। ততক্ষণে টেবিলে ডিমের খোসা, আমুল বাটারের মিনিপ্যাক, ব্রেডের পোড়া অংশ ইত্যাদি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন। এবার পুনরায় দুটা/তিনটা ডিমসহ অন্য আইটেম নিয়ে আরেক টেবিলে গিয়ে বসে সে টেবিলেও একই দশা। লেজযুক্ত বাঙ্গালীরা নিষেধ করলেও কে শোনে কার কথা?
এভাবে প্রতিদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে একদিন এক ওয়েটার (ওয়েটাররা বেশিরভাগই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ট্রেইনি স্টুডেন্ট) উনাকে এ নিয়ে ভদ্রভাবেই বললে সে এক তুলকালাম কান্ড। এক্কেরে বাঙ্গালী স্টাইল। লেজযুক্তদের তো লজ্জায় মাথাকাটা।
ভেতরের গল্প: স্থান-কাল-পাত্র বলে একটি জিনিস রয়েছে যা বাংলাদেশী আমরা মনে হয়ে প্রায়শই ভুলে যাই! ফলাফল। কী দেশ কী বিদেশ সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্য…?
৪
গল্প: সময়-২
রমা কেন রমেশকে বিয়ে না করে কাশি কিংবা বৃন্দাবনে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল? যখন সে চাইলেই তাকে সহজেই বিয়ে করতে পারে। এই প্রশ্ন স্কুল জীবনে বহুবার উদয় হয়েছে। তখন থেকেই মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল। সুযোগ পেলেই দৌড় দিব। পরে আনন্দলোক কী দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যাতে রুপক সাহার ‘মোক্ষ’ উপন্যাসে বিধবাদের নিয়ে বিশদ পড়ে এই বৃন্দাবন নিয়ে একটি স্থায়ী ছাপ পড়ে গিয়েছিল। খালি সুযোগটা পাই।
জন্মাষ্ঠমী। সাথে উইকেন্ড। আশেপাশের কোনো জায়গায় যাওয়ার প্লান করছিলাম। ইতোমধ্যে এক ভারতীয় বন্ধু প্রস্তাব দিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে তাঁর জন্মস্থানে গেলে কেমন হয়? আমি তো যাওয়ার জন্য সটান খাড়া। অনেকে গাঁইগুই করতে লাগল। যাবে কি যাবে না। যেহেতু এগুলো জনপ্রিয় পর্যটন স্থান নয়, আর সবাই প্রায় বিদেশী ও নানান ধর্মের। তাই এই দ্বিধা। অবশেষে আরো কিছু স্থানের সাথে তাজমহলও রাখা হলো পরিকল্পনায়। এতে সবাই রাজি।
বাজেট ট্যুরের কাঠামোয় সকাল বেলা ৮ জনের দল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কৃষ্ণলীলা দেখতে। প্রথমে হযরত নিজামদ্দিন বাস স্টপ থেকে আগ্রাগামী বাসে বৃন্দাবন। দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার।
বৃন্দাবনের প্রধান রাস্তার মুখে নেমে পড়লাম। সেখান থেকে বাংলাদেশের লেগুনার মতো গাড়িতে করে সোজা বৃন্দাবন। লক্কর-ঝক্কর গাড়ী ‘ঢিঙ্কাচিকা ঢিঙ্কাচিকা’ স্টাইলে চলতে শুরু করল। বৃন্দাবন শহরে ঢুকার পর দেশি স্টাইলের জ্যাম। কারণ রাতেই শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন পালন হবে অদূরবর্তী মথুরাতে। তাই প্রচুর লোক এসেছে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে। লোকে লোকারণ্য।

লেগুনা বা ভুটভুটি থেকে গুটিগুটি পায়ে নেমে বৃন্দাবনের দর্শনীয় স্থানের সন্ধানে বের হলাম। ভারতীয় বন্ধুকে মুচকি হেসে বললাম, ‘দোস্ত, মিঃ কৃষ্ণ যমুনার যে ঘাটে রাধার বস্ত্র লোপাট করেছিল, সেখানে নিয়ে চল। দেখি, কোনো রাধারা এখনো স্নানে আছে কিনা’। যমুনার পাড়ে সেই কথিত বটগাছ দেখিয়ে বন্ধু জানালো, সামনের অশীতিপর বটগাছেই রাধার কাপড় রাখা ছিল। শীর্ণ গাছে প্রচুর কাপড়ের টুকরো বাঁধানো। ভক্তের কাজ।
‘যমুনার জল দেখতে কালো, চান করিতে লাগে ভালো’—এই কালো গভীরতার কালো নয়। এই কালো উজানে দিল্লীর নব্য সভ্যতার কুফল। তাই সেই কালো জলে আর নেমে স্নানের বাসনা উঁকি দিল না চামড়ায় খাউজানি-উস্কানির ভয়ে। সেখান থেকে বের হয়ে গলির ভেতর দিয়ে, কখনো যমুনার পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। সারি সারি পুরোনো ভাঙাচুরা বাড়ি। উনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকের এই বাড়ীগুলোতে বিধবারা বাস করত। এখনো কিছু বাড়িতে তারা যুগ যুগ ধরে বাস করছে। তেমনি এক ভাঙা বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। শ্বেত পাথরে মোড়া দেওয়ালে নানান আঁকিজুকি। সেই বাসায় যে বিধবারা বাস করতেন তাদের নাম ও ঠিকানা লেখা আছে দেওয়ালে, পিলারে। বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের।
হঠাৎ করে একটি নামে চোখ আটকে গেল। নাম (নামটা স্মরণ নেই) ও ঠিকানা লেখা। মাইজদী, নোয়াখালী। (অ্যান্টার্টিকাতে গেলেও বুঝি নোয়াখালী ভাইদের দেখা মিলবে

এরপর গেলাম সেই বৃন্দাবন যার কারণে এর নাম বৃন্দাবন। কথিত আছে, এ বনে কৃষ্ণ রাধার সাথে অভিসারে মত্ত হতেন। সেখানকার মানুষেরা এখনও বিশ্বাস করে অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতিথিতে রাধা-কৃষ্ণ ধরায় নেমে এসে লীলাখেলায় বৃন্দাবন মাতিয়ে তোলে। তাই রাতের বেলা বনে ঢুকা নিষেধ। অভিসারের ব্যাঘাত ঘটবে। কৃষ্ণ মানুষ দেখে রেগে গিয়ে যদি ধনুক থেকে তীর ছুড়তে শুরু করে। ওরে বাবা, আমরা তাই সন্ধ্যা নামার আগেই স্থান ত্যাগ করলুম!
বৃন্দাবনে বিখ্যাত বাকেবিহারি মন্দির দর্শন শেষে রওয়ানা হলাম কিমি দশেক দূরের মথুরা শহরে যেখানে লর্ড কৃষ্ণের জন্ম। মথুরাতে এসে জনসমুদ্রের সামনে পড়ে গেলাম। হোটেল-মোটেল কোথাও সিট নেই। মানুষ রাজপথেই শুয়ে-বসে আছে। কেউ সেখানেই রান্না-বান্না, ভজন-কীর্তন করছে। কয়েক লক্ষ লোক এসেছে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে। অনেক চেষ্টা তদবির করে শেষে শহরের প্রান্তের এক ধর্মশালাতে রাত্রিযাপনের বন্দোবস্ত হল। রাতে লর্ড কৃষ্ণের জন্মভূমি দেখতে বের হলাম। ছোট্ট এক টিলার উপরের মন্দিরে উনার পূণ্যভূমি। ভীষণ ভীষণ ভিড়। আমরা দেশি স্টাইলে ধাক্কাধাক্কি করে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ক্ষান্ত দিলাম। এ কম্ম দেশি স্টাইলে হবার লয়, হাল্ক স্টাইল দরকার! একবার পড়ে গেলে ছাতু হতে বেশি সময় লাগবে না। পদপিষ্ট হয়ে…বাপ-দাদার পৈত্রিক জান খোয়ানোর চেয়ে একটু দূর থেকেই চারপাশটা ঘুরে টুরে দেখে বিদায় নিলাম! আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করলাম পাশেই প্রাচীন একটি জামে মসজিদসহ ঈদগাহ।
ভেতরের গল্প: সময়ের সাথে মানুষের চিন্তার পরিবর্তন, বিশ্বাসের পরিবর্তন, ধারণার পরিবর্তন, নীতির পরিবর্তন সুন্দর-সুস্থ-মনোরম সকালকে বিষাদে ভরে দিতে পারে। অমাবস্যার আঁধারে ঢেকে যেতে পারে নৈসর্গিক আলোর জগত। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগেও একবার হয়েছে উগ্রবাদীদের দ্বারা…। সাড়ে তিনশ বছর পরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের পাশে দন্ডায়মান শাহী মসজিদ ও ঈদ্গাহ এখন উগ্রবাদীদের নয়া টার্গেট। কবে হয়ত শুনব হিংসার নয়া সমীকরণ…?
ছবি: লেখক (বৃন্দাবনের ভেতরের চত্তরে এক সাধু বাবার নৃত্য ও কাপড় ঝুলানো গাছ) ও গুগল ম্যাপ (মন্দির ও মসজিদ পাশাপাশি)
*****************************************************************************************
আখেনাটেন-২০২২/জানুয়ারি
আরো কড়চা পড়তে চাইলে...
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-৪
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-৩
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-২
@দিল্লী কড়চাঃ কিছু ঘটনার মুখোমুখী-১
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৩:৩৭