Click This Link
খুলনার সুন্দরবনের কয়রা উপজেলার দক্ষিন বেদকাশী ও উত্তর বেদকাশীর গাবুরা ইউনিয়নে মুন্ডাদের বাস। এর কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে শাকবাড়িয়া নদী। মুন্ডা শব্দের অর্থ বুনো। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর শুরুর দিকে ইংরেজরা এদের নিয়ে আসে ছোট নাগপুর থেকে। ব্রিটিশরা তাদের সুন্দরবনের ঘন জংগল পরিষ্কার করে চাষাবাদের কাজে নিয়োজীত করে।
মুন্ডারা সাধারনত একত্রে বসবাস করে। তাদের ভাষার নাম নাগরি। এই ভাষায় বাংলা , হিন্দি ও ফরাসী ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। দুর্বোধ্য ভাষা ও অশিক্ষার কারনে মুন্ডারা অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। তারা চিকিৎসার জন্য এখনও বুনো লতা ও ঝাড়ফুকের উপর বিশ্বাস করে। মুন্ডারা মূলত হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তাদের রয়েছে বিভিন্ন গোত্র যেমন ভীমরুল, কচুয়া, রুয়া, পদ্মা, ভতকুয়া, রাজকুয়া ইত্যাদি।
মুন্ডারা এখনও তীর- ধনুক, বল্লম দিয়ে বন্য জন্তু শিকার করে আগুলে পুড়িয়ে খায়। তবে পোড়ানোর পর বড় প্রানী হলে যেমন শিয়াল, শুকর, কুকুর , বন বিড়াল,বানর ইত্যাদি আগুনে দিয়ে লোমগুলি পুড়িয়ে তারপর পানিত ধুয়ে কেটে রান্না করে খায়। সেই রান্নায় বিভিন্ন বনজ মসল্লাও দেয়।
ওরা সব প্রানীই খায়। ভেড়া ,ছাগল, থেকে শুরু করে কীট-পতংগ সব। শুধু গরু খায় না কারন তারা হিন্দু ধর্মালম্বী। আর কি কি যে খায় না তা আমি জানি না।
শামুক, ঝিনুক, কেঁচো, ইঁদুর সব খায়। ইঁদুর ওদের খুব প্রিয় খাবার। ইঁদুরকে ওরা মুচা বলে। ইঁদুর পোড়া ওদের প্রিয় খাবার। ইঁদুর শুধু পুড়িয়েই খায়। ইঁদুর নিয়ে ওদের অনেক গান ও আছে।
আমরা যেদিন পৌঁছালাম সেদিন রাতে ছিল ওদের বিয়ে। ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ বৈচিত্রময়। ছেলের বাবা মেয়ে দেখে পছন্দ করে ছেলের বিয়ে দেয়। মোড়ল বা মাতব্বরেরা মুন্ডাদের বিয়ের কাজ সম্পাদন করে থাকে। এতে কোন পুরোহিত লাগে না। বর ও বউএর কনিষ্ট আংগুলের রক্ত আলাদা আলাদা করে কয়েকটি আম পাতায় রাখা হয়। এরপর বরের রক্ত লাগানো পাতা ভাজ করে মালা বানিয়ে বউ কে পরিয়ে দেয়া হয় আর বউএর রক্ত লাগানো পাতা ভাজ করে মালা বানিয়ে বরকে পরানো হয়। এবারে বউ এর বাবা বরের কাছে জানতে চায়, সে তার মেয়েকে চিরদিনের জন্য ভরন পোষন করতে পারবে কি না। বর রাজি হলে বউয়ের সিঁথিতে সিঁদুর পরানোর অনুমতি পায়। তারপর চলে নাচ গান হাড়িয়া ও অতিথি আপ্যায়ন।
সাধারনত মুন্ডারা বিবাহ বিচ্ছেদে বিশ্বাস করে না তবে কেউ যদি বিচ্ছেদ চায় তবে তাকে চারটি ছাগল, দুইটি শূকর, ও মদ দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মুন্ডাদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে হয় যা অত্যান্ত ব্যয় বহুল। এ ছাড়াও বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া পাত্রের সাথে কেউ আর মেয়ে বিয়ে দেয় না। তাই ওদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই ।
পরদিন দুপুর তিনটার দিকে শুরু হল হাড়িয়া উৎসব। হাড়িয়া উৎসব সাধারনত সূর্য একটু মাথার ওপর থেকে হেলে পরলেই শুরু হয়। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। যারা মদ খেতে দক্ষ তারা কেউ কেউ সকালে উঠে বাড়ি যায়। হাড়িয়া উৎসবে হাড়িয়ার সাথে থাকে ইঁদুর পোড়া। আমরা দেখলাম ওদের মদ খাওয়ার উৎসব। সেখানে নেই কোন বজ্জাতি সবাই সু শৃংখল, নেই কোন হট্টগোল। জানিনা সময়ের সাথে সাথে ওদের মাতলামো বাড়ে কিনা আর তখন তারা সু শৃংখল থাকে কি না ? কারন আমাদের রিক্সা ভ্যান এসে গেছে আমরা সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ওরা আমাদেরকে আবার ও আসতে অনুরোধ করলো। বিশেষ করে গাল্লির বাবা । গাল্লির বিয়ের সময় যেন অবশ্যই আসি।
আমরা চলে এলাম পিছনে পরে রইল সুন্দরবনের প্রাচীন আদিবাসী মুন্ডা বা বুনোরা যাদের জীবন কাহিনী ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বর্ণাঢ্যময়।
আমাদের দুইদিনের মুন্ডাপল্লী ভ্রমন আমাদের মন পরিপূর্ন হয়েছে কত অজানা কাহিনীতে। যার কিছু কিছু আমরা বইতে পরেছি কিন্তু চাক্ষুশ দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা।
এবারে একটা মজার কাহিনী। আগেই বলেছি মুন্ডারা হিন্দু এবং তারা আদিবাসী ও সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে থাকে তাই বোধ হয় মুন্ডাদের বাচ্চারা কাউকে নামাজ পড়তে দেখেনি। আমাদের গ্রুপের একজন নামাজ পড়তে বসেছে বাইরে, আর জোড়ে জোড়ে দোয়া পড়ছে। কিছুক্ষনের মধ্যে যত বাচ্চা যেখানে ছিল সব ওকে ঘিরে সিজদা দিচ্ছে আর ওর সুরে গুন গুন করতে শুরু করে দিয়েছে। বাচ্চাগুলি বেশ এক্সপার্ট ওরা দেখি অনেক বারই দোয়ার সুরে গুন গুন করছে। পরে বোধ হয় বড়রা কিছু বুঝিয়েছে। নামাজের সময় আর এসে সিজদা দেয় নি ।
বিঃদ্রঃ কিছু কিছু বাংলাপিডিয়া থেকে সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:১৩