somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধশিশুদের আমরা দেশ থেকে নির্বাসন দিয়েছি; ইতিহাস থেকে নয়! ; শেরিফ আল সায়ার

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনুমতি না নেয়ার জন্য লেখকের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।

লেখকের লিংক: Click This Link

আইরিন সুলতানার "১৯৭১ : বীরাঙ্গনা অধ্যায়" পোষ্টটা স্টিকি করার আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিবেলায় যে কারও একটি দলিল ভিত্তিক পোষ্ট আমি কপি-পেস্ট করে পোষ্ট করবো। হয়তো ব্লগ কর্তৃপক্ষ আমাকে এর শাস্তি দিবেন। যদি কেউ আমার সিদ্ধান্তটিকে মেনে না নেন তাহলে বলবেন; আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।
---------------------------------------------------------------------------------
জন্মের পর ওরাও কেঁদে উঠেছিল। পৃথিবীর আলো ওদেরও স্পর্শ করেছিল। তবে, তাদের কান্না ছিল সানন্দে বরন না করার বেদনায়। তাদের কান্না ছিল পৃথিবীর বুকে তাদের নিয়ে লুকিচুরি খেলার বেদনায়। তারা জানে না তাদের মা’র কথা। তারা জানে না তাদের বাবা’র কথা।
তাদের জন্মের পর ধর্মীয় পবিত্র কাজ স¤পন্ন হয় নি। ঘরে তার জন্য দোয়া করা হয়নি। হ্যা আমি যুদ্ধশিশুদের কথা বলছি। ওদের কথা কেউ কখনও বলতে চায় নি। কেউ না!!

প্রতি বছর স্বাধীনতার মাস কিংবা বিজয়ের মাস আসলে আমরা স্বরণ করি বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। আমরা স্বরণ করি, বুদ্ধিজীবীদের কথা। ৩০ লক্ষ শহীদকে স্বরণ করে মুক্তির চেতনায় ভেসে যাই। শুধু ভুলে যাই তাদের কথা। সেই চুপিসারে আর্তনাদ করা মা’দের কথা। সেই অসহায় নিষ্পাপ যুদ্ধশিশুদের কথা আমরা ভুলে যায়। আসলে ওদের তো কেউ স্বরণ করেও না। কারণ, ওদের তো বরণ করাই হয়নি।
তাও আমি বলতে এসেছি সেই যুদ্ধশিশুদের কথা। আমি বলবো, সেসব সব শিশুর কথা যাদের অধিকাংশের জন্ম হয়েছিল ৭২-এর দিকে।

যে কোনো যুদ্ধে জয়ের একটি কৌশল হচ্ছে, সেনাবাহিনীর প্রয়োগ করা "যৌন সন্ত্রাস"। ঠিক সেই কাজটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনী করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তারা আড়াই থেকে চার লাক্ষ বাঙালী নারীকে ধর্ষণ করেছিল। এবং সেই ধর্ষণের ফলাফল স্বরুপ জন্ম হয়েছিল পঁচিশ হাজার যুদ্ধশিশু। [ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুডের সূত্রমতে]

ইতিহাস বলে, যুদ্ধে পরাজিত হলে, "যুদ্ধশেষে ভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পরাজিত বাহিনী পেছনে রেখে যায় কিছু চিহ্ন।" বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধে সেই চিহ্নই হচ্ছে, বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুরা।
বীরাঙ্গনাদের একটা ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাফ কথা ছিল, ওরা আমার মেয়ে। ওদের সম্মান দেয়া হয়েছিল “বীরাঙ্গনা” উপাধি দিয়ে।
কিন্তু আড়ালে রয়ে গেলো যুদ্ধশিশুরা। তাই তাদের দত্তক দেয়া ছাড়া কোনো উপায়ই ছিল না। বরাঙ্গনার অধিকাংশই তাদের শিশুকে দত্তক দেয়া শুরু করলো। অনেক ক্ষেত্রে দত্তক দিতেও বিপত্তি দেখা যায়। যেমন, কোন মা হয়তো জন্মের পূর্বে বলেছে দত্তক দেয়ার কথা কিন্তু নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের পর মা’র হৃদয় কেঁদে উঠেছিল। নিজ গর্ভে ধারণ করা অসহায় শিশুটিকে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার বিভৎসতা অনেকেই সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যাও করেছে।
তবে রাষ্ট্র এসব নিয়ে কখনও ভাবেনি। ভাবেনি; কারণ, রাষ্ট্রের কাছে তখন প্রয়োজন ছিল বিশুদ্ধ রক্তের সন্তান। দূষিত রক্ত তারা বর্জন করতে চেয়েছে। তাই বীরাঙ্গনাদের সামনে রাষ্ট্র দিয়ে দিয়েছিল এক শক্ত পর্দা। যে পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে এবং কে আছে তা জানার উপায় ছিল না!!

অনেক বিদেশী সংস্থা যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করে দেয়। আবার অনেক দেশীয় পূনর্বাসন কেন্দ্রও কাজ করতে থাকে। যেমন, পাবনার নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে প্রায় সাতটি শিশুকে পাঠানো হয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ায়। কানাডায় ফস্টার প্যারেন্টস দত্তক নিয়েছিল ১০০ শিশু। প্রথম ১৫ জনের তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের ১৭ই জুলাই প্রথম দলে ছিল ওই ১৫জন। বড় হয়ে একজন একাত্তরের তার ভয়াবহতা সহ্য করতে পারেনি। পরে সে আত্মহত্যা করে। বাকিদের মধ্যে দুজন মানুসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পাগল হয়ে যায়।
এই শক্ত বাস্তবতা তারা অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। পারার কথাও তো নয়।

আবার অনেকে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে এমন নজিরও আছে। যেমন, কানাডার একটি পরিবার একশিশুকে দত্তক নেয়। শুধু যে তারা বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুকেই নিয়েছে তা কিন্তু নয়! তারা কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লন্ডনের এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকেও দত্তক নেয়। তারা প্রতিটি বাচ্চাকে তাদের অতীত সম্পর্কে জানায়। তারা প্রতিটি শিশুকে আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে যেভাবে বড় করে তুলেছেন যে তাদের মধ্যে কখনও কোনো ধরনের অস্বাভাবীকতা দেখা যায়নি। এমনকি ১৯৮৯ সালে, দুটি এতিমখানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেই যুদ্ধ শিশুটি (শিশুটি মেয়ে ছিল নাম দেয়া হয়েছিল আমিনা) বাংলাদেশে আসে। সে তার অনুভূতি বলতে গিয়ে বলে, এ দেশে সে এক ধরনের টান অনুভব করছে।
এ মহান পরিবারটির কথা ইতিহাসে আসেনি। আসার কি কথা? সেই পরিবার আমাদের দেশর কি বা উপকার করেছে!! স্বীকৃতি দেয়নি এ মহান দত্ত্বক পিতা-মাতাদের।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ৭৫-এর পর এই সকল নথীপত্র পুড়িয়ে ফেলার কথা অনেকেই বলেন। তাই সেই অজানা যুদ্ধশিশুদের কথা ইতিহাসে আনা সম্ভব হয় নাই।

এদেশে এই শিশুগুলো বেড়ে উঠলে উন্মাদ হয়ে উঠতো; সে কথা অনেকের মুখেই শোনা যায়। তাই তাদের দেশে রাখা যায় নি। যুদ্ধশিশু সম্পর্কে পার্ল এস বাক বলেন, গড়ে নেয়ার জন্য তার একটা সুন্দর পৃথিবী হবে। প্রকৃতপক্ষে সেটা পূর্ব বা পশ্চিম কোনটাই হবে না। এসবের প্রত্যেকটাকেই সে বর্জন করবে। কারণ কোনটাই তাকে বুঝবে না। তবে আমি মনে করি, যদি তার দুই জন্মদাতারই শক্তি-সামর্থ থাকে, তাহলে সে বুঝতে পারবে দুই পৃথিবীকেই এবং অতিক্রম করবে সংশিষ্ট সব সমস্যা।

কিন্তু পার্ল বাক বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থানটা জানতেন না। বাংলাদেশে আজও যুদ্ধশিশুদের কোনো কথা বলা হয় না। তাদের বলা হয় দূষিত রক্ত। বাংলার ইতিহাসে তাদের কথা কোনোদিন কি উচ্চারিত হওয়ার নয়!

বিজয় মানে অর্জন। যেই অর্জনে থাকে রক্ত আর রক্ত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে বেজে উঠে কান্নার শব্দ। আমাদের পতাকায় মায়ের-বোনের অসম্মান। সেই পতাকা যখন পতপত করে ওড়ে তখন মনে হয়, আমার মায়ের আঁচল উড়ছে। আর সেই আঁচলে মুখ লুকিয়ে আছে যুদ্ধশিশুর পবিত্র মুখচ্ছবি।
এই যুদ্ধশিশুদের ইতিহাসের পাতায় নিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীকে বোঝাতে হবে, যুদ্ধশিশুদের আমরা দেশ থেকে নির্বাসন দিয়েছি ইতিহাস থেকে নয়!

৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×