somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ হলুদ প্রশান্তির দিন

১৭ ই মে, ২০১৭ রাত ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি ওর ঊরুতে হাত বুলোচ্ছিলাম। এভাবে কেটে যেতে পারত আরো সহস্র বিকেল। ওর কানের কাছে একটা মদের মত গন্ধ। খুব চেনা মদ। বাবা খেতেন। বাবা যখন মদ খেতেন তখন তাকে খুব সুপুরুষের মতন লাগত। এমনিতে বাবা ছিলেন বাই সাইকেল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে এমনই মনে হত। বাবা মাঝে মাঝে গান গাইতেন। সে গানের সুর অনেকটা সাইকেলের বেলের মত। একঘেয়ে আর কর্কশ। হাসলে সামনের পাটির দাঁত বেড়িয়ে আসতো অনেকখানি। আমার সেই বাবা এক ভর দুপুরে মারা গেলেন। বাবা সাইকেলের মতই মারা গেলেন। হোঁচট খেয়ে মাথা মটকে পড়ে থাকেন পুকুর পাড়ে। অনেকে বাবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। কেউ লক্ষ্য করলেন না , মৃত এক ভদ্রলোক উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। সবার আগে বুঝতে পারল এক ছিচকে চোর। সে বাবার মানিব্যাগ হাতিয়ে নিতে চাচ্ছিল। মানিব্যাগ হাতে নিতেই সে দেখল, বাবা মরে পড়ে আছে, মানিব্যাগের গা বেয়ে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে।
বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় ওদিন থেকে জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আরকি।
তারও আগের কথা। অফুরন্ত বাতাসের ভেতরে আমার বাবা দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে আমি, ছোট আর চঞ্চল। বাবা আমাকে ছোট্ট ভালুক ডাকতেন। বলতেন আমি নাকি ভালুকের মত ঘুমুই। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতাম, চোখ দিয়ে জানতে চাইতাম , ভালুকের মত ঘুম জিনিসটা কি? তিনি হাসতেন। এখন মনে হয়, তিনি হাসতেন কোনো এক সম্রাটের মত বা দার্শনিকের মত। আমার বাবা, একই সাথে একজন সম্রাট,দার্শনিক আর বাই সাইকেল। তার পিঠে চড়ে আমি এই মনোরম শহুরে বাতাসে ঘুরে ঘুরে বড় হয়েছি। আমার সেই বাবা সেদিন আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন। ছোট আর চঞ্চল আমি, কি শান্ত আর নিবিড় হয়ে দেখছিলাম বাবাকে। সম্ভবত বাবা একটা গান ধরেছিলেন। সেই অফুরন্ত বাতাসে বাবার আনকোরা গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আমার সেই বাবা গাইতে গাইতে সেই অফুরন্ত বাতাসের মাঝে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা সেদিন মারা গেলেন। কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না। লক্ষ্যই করল না। এমনকি আমিও না। বাবার হাত ধরে আমি সেদিন অনেকটা পথ হেঁটেছি। আরও অনেকদিন পর , এরকম এক অফুরন্ত বাতাসের দিনে আমি বুঝতে পারি, বাবা মরে পড়ে আছেন মুখ থুবড়ে।
হয়ত সেদিন থেকেই বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আরকি।
আমি আমার বাবার নাম জানতাম না। ক্লাসে টিচার জিজ্ঞেস করলে হা করে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। রাস্তায় লোকে জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে হাসতাম। আমার বাবা, আমাকে কখনো তার নাম বলেন নি। আমিও কিভাবে যেন একটা মানুষের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়ে গেলাম বছরের পর বছর, যার নাম পর্যন্ত আমি জানিনা। বাবার কোনো বন্ধু ছিলনা। দুধওয়ালা বাবাকে ডাকত সাহেব বলে। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক , যার ছেলে এখন বিরাট বড় ইঞ্জিনিয়ার, তিনি বাবাকে ডাকতেন মশাই বলে। বাবা বলতেন, তার অফিসের বস, মাঝেমাঝে তাকে স্টুপিড বলে ডাকতেন। আর আমি ডাকতাম বাবা বলে। আমার সেই বাবা, যিনি আমাকে কোনোদিন তার নাম পর্যন্ত বলেননি, একদিন আমার সামনে অনর্গল বলতে লাগলেন তার ছোটবেলার কাহিনী। জমিদার বাড়ির দেয়ালে যে একটা আলাদা গন্ধ থাকে, বাবার কাছ থেকেই আমি সেদিন জানতে পারি সে কথা। আমার সেই বাবা, তার বাবার কথা বলতে গিয়ে কি অঝোরে কেঁদেছিলেন সেদিন সে কথা ঈশ্বর জানেন। আমার বাবার বাবা, লোকটা নাকি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। এক দুরন্ত ঝড়ের দিনে দুরন্ত সেই লোকটা বজরা নিয়ে মিশে গিয়েছিলেন বিলাস বহুল এক বাতাসে। বাবা বলেন সেই লোকটা আর ফিরে আসেনি। আমি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি যে মা ফিরে না আসায় কেন বাবা কেঁদেছিলেন। কিন্তু আমার সেই বাবা, যিনি একই সাথে ছিলেন সুদর্শন আর মদ্যপ, তিনি যে আমার সামনে মরে পড়ে আছেন আমি তা বুঝতে পারিনি।
কিন্তু সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটয় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আরকি।
আমি যেদিন প্রথম সেলারি পাই সেদিন বাবার জন্মদিন ছিল। আমার বাবার জন্য কি উপহার কিনব সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। আমার সেই বাবার জন্য, যিনি প্রতিবছর আমার জন্মদিন ভুলে যেতেন, আর বার বার লজ্জিত কন্ঠে ক্ষমা চাইতেন। বাবার জন্য উপহারের খোঁজে গায়ে রৌদ্র মেখে আমি হেঁটে চললাম কোনো সমুদ্রের দিকে। আমার সেই বাবার জন্য, আমি যার নাম পর্যন্ত জানিনা। আমার বাবা এভবেই সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতেন আমাকে পিঠে চড়িয়ে। কখনো মধ্যবিত্ত বাতাসের মাঝে একঘেয়ে লাগলে আমাকে নিয়ে যেতেন আরও দূরে , কোনো এক বিলাস বহুল বাতাসে। আমার সেই বাই সাইকেল বাবা সে সময়টায় তার আনকোরা কর্কশ কন্ঠে গান গাইতেন। আমি, ছোট আর চঞ্চল আমি কি শান্ত আর নিবিড় হয়ে বাবার পিঠে ঝুলে থাকতাম। দারুণ অফুরন্ত বাতাসে আমার মদ্যপ বাবার চুলের গন্ধে আমার মাতাল সময় কাটত। আমার সেই বাবার জন্য আমি উপহার খুঁজতে খুঁজতে বোকা বনে গেলাম। একই সাথে আমার সম্রাট,দার্শনিক আর বাই সাইকেল বাবার জন্য আমি সেদিন পাগলের মত খুঁজে এক উপহার পেয়েছিলাম। এখন মনে নেই, হয়ত একটা সস্তা হাতঘড়ি ছিল, বা এক বোতল বিদিশি মদ। আমার বাবা, যার জন্য আমি আমার সেলারি থেকে সামান্য উপহার তুলে এনেছিলাম, আমার সেই বাবা সেদিন রান্নাঘরে চায়ের কেটলির সামনে মুখ থুবড়ে মরে পড়েছিলেন।
সেই সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আরকি।
মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর বাবা আমার সামনে আর কখনও মায়ের প্রসঙ্গ তোলেননি। মাঝেমাঝে আমার বাবা ফটো এ্যালবাম খুলে বসে থাকতেন উঠোনে। আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম দূর থেকে। মনে হত কোনো দেবতা বসে আছেন প্রবল আয়েশে। আমি তার কাছে যাবার সাহস পেতাম না। বাবা মাঝে মাঝে হাত তুলে ডাকতেন। দূর থেকে দেখতাম ধুলোমাখা সেই উঠোনে বসে আমার ভদ্রলোক বাবা তালে তালে মৃদু হাসির সাথে কাঁদছেন। তার শত ডাকা সত্ত্বেও আমি তখন আমার সেই দেবতা বাবার কাছে যেতাম না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। হলুদ প্রশান্তির কোনো এক দিনে আমার সেই বাবা, ফটো এ্যালবামে মাথা গুঁজে মারা গেলেন। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম আমার সেই প্রেমিক বাবা কোনো এক ফটোতে চুমু দিচ্ছেন।
ঠিক সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরা শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যা হয় আরকি।
এক মেজেন্ডা রঙের বিকেলে মাকে দেখেছিলাম , কাঁদছেন। আমার মা, যার নাম-ধাম-পরিচয় সবকিছু আমার মুখস্ত ছিল। তার আঙুলের ঘ্রাণ, শাড়ির আঁচলের মিষ্টি শব্দ, রিনরিনে হাসির দৃশ্য আর আমাকে চুমু খাবার মুহূর্ত সবকিছু আমার মুখস্ত ছিল। মা কোথাও বাইরে গেলে প্রথমে চুমু খেতেন আমাকে, তারপর বাবাকে। আমার সেই মা, যাকে আমি কোনো ঈশ্বরী ভাবতাম, তিনি আমাকে প্রাণভরে সেদিন চুমু খেলেন একবার, তারপর কয়েকবার। আমার সেই মা যিনি বাবার হাত ধরে সহস্র বছর ধরে, বিকেলের পর বিকেলে অফুরন্ত বাতাসের মাঝে হেঁটেছেন সমুদ্র পর্যন্ত, তিনি সেদিন দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়লেন অফুরন্ত বাতাসে, একা। আমার মা সেদিন বাবাকে চুমু পর্যন্ত খেলেন না। সেদিন আমার বাবা জীবনে দ্বিতীয়বারের মত, আর আমার সামনে প্রথমবারের মত মুখ থুবড়ে মাটিতে মরে পড়ে রইলেন।
সেদিন থেকেই আসলে বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আরকি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৭ রাত ৯:৪৫
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×