বাংলাদেশে কতটি মসজিদ আছে কেউ কি জানেন? বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের গতবারের হিসাব অনুযায়ী মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার। আর হিসাব ছাড়া কতটি আছে তার কোন পরিসংখ্যান আমার কাছে নাই। তবে তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
এবার একটু পিছনের দিকে তাকাই। ইসলামের প্রথম যুগে সমাজের অনেক ভালো কাজের, কল্যাণমূলক কাজের সূচনা হত মসজিদ থেকে। রাষ্ট্র পরিচালনাও হয়েছে মসজিদ থেকে। গরিব মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল ছিল মসজিদ। সামাজিক অনেক সমস্যার সমাধান মসজিদ থেকে হয়ে যেত। মসজিদ থেকে মানুষ যে উপকার পেত সে উপকার শুধু পরকালের উপকার না ইহজীবনের অনেক প্রত্যক্ষ উপকরও মানুষ পেয়ে যেত।
এবারে আসা যাক আমাদের মসজিদ গুলোর চিত্র কেমন। বিগত জীবনের কোন প্রত্যক্ষ উপকারভোগী আমার চোখে আমি কোনদিন দেখিনি। আপনাদের কারো চোখে পড়লে জানাবেন। অবশ্য দুইজন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা হলো ইমাম আর মুয়াজ্জিন। তবে তাদের অধিকাংশের বেতন-ভাতা মোটামুটি পাবলিকের দান-খয়রাতের উপর নির্ভরশীল।
এদেশের মসজিদ গুলোর আরেকটা চিত্র হলো শহর থেকে গ্রাম, মফস্বল থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রায় একই চিত্র বিদ্যমান। প্রত্যেকটা মসজিদে একটা কমিটি আছে মসজিদ পরিচালনা করার জন্য আর তারা সবাই ঐ এলাকার প্রভাবশালীর, রাজনৈতিক নেতা, হঠাৎ বড়লোক হওয়া ব্যবসায়ী এই টাইপের সব লোকজন। এদের জন্য মসজিদের প্রথম কাতার বরাদ্দ থাকে, দুই পাশে হাতলওয়ালা চেয়ার বসানো থাকে, নির্দিষ্ট জায়গায় জায়নামাজ বিছানো থাকে। এরাই সকল সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
প্রায় প্রতি শুক্রবার এরা দান-খয়রাত করে দো-জাহানের অশেষ নেকি হাসিলের জন্য শত শত হাদিস উগরে দিয়ে থাকেন। আপনার দানকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দিয়ে উদারহস্ত হবার আহ্বান জানান। অনেক মসজিদে রীতিমতো খিস্তি খেউর করতেও দেখেছি ওই কমিটির সভাপতি সেক্রেটারিদের। কেন টাকা দিবেন না? আপনারা মানুষ না ইহুদী নাসারা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই দানের টাকা ব্যয় করা হয় টয়লেটে টাইলস লাগানোর জন্য, ফ্লোরে মার্বেল লাগানোর জন্য, মসজিদকে বহুতল ভবন বানানোর জন্য, মসজিদ কমপ্লেক্সে দোকানপাট তৈরি করার জন্য।
হালের ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে এসি লাগানো। এসির টাকা উঠানোর জন্য বেহেশতে তার প্রতিদান ফজিলত কি সেজন্য ফেকাহ শাস্ত্র খুঁজে নতুনভাবে হাদিসের আমদানিও কম না। এসির টাকা উঠানো হলো, এসি লাগানো হলো। নতুম করে দানের খাত সৃষ্টি হলো বিদ্যুৎ বিলের টাকা। ইমাম সাহেব জুমার খুতবায় আরো দান আরো টাকা তোলার প্রতি বেশি মনোযোগী। কোনো কোনো মসজিদে এই বিদ্যুৎ বিলের টাকা কয়েক মাস কয়েক বছরও বাকি থাকছে। মসজিদ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয় তাই এখানে কোন কোন জোর জবরদস্তি চলেনা বিদ্যুতের লাইন কাটা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তো প্রায় এরকম কাজের মধ্যে দিয়েই মসজিদের প্রায় সকল কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে বছর জুড়ে।
অথচ আমাদের মসজিদগুলো হতে পারতো আমাদের সমাজ পরিবর্তনের বড় একটা সূতিকাগার। দানের টাকা দিয়ে এলাকার গরিব মেধাবীদের শিক্ষার ব্যয় করতে পারত। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পাশে দাঁড়াতে পারতো। বেকার যুবকদের জন্য সহায়তা হতে পারতো, চিকিৎসাহীন হয়ে ধুকতে থাকা মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে পারতো। অর্ধাহারে অনাহারে থাকা মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে পারতো। হতে পারতো ঋণের দায়ে সর্বশান্ত হওয়া কৃষকের ভরসার স্থল। এরকম মহৎ এবং মানবিক কাজের উদ্যোগ কেন মসজিদগুলো থেকে মানুষ পায় না।
এ বিষয়ে দু চারজন ধর্মকর্ম ওয়ালা কমিটির লোককে প্রশ্ন করেও দেখেছি তাদের প্রতিক্রিয়া কি? অনেকের কাছে উত্তর পেয়েছি এরকম;- ওসব কাজ সরকারের। আমরা কেন করব সরকার শিক্ষা খরচ দিবে, সরকার চিকিৎসা সেবা দেবে ব্লা ব্লা সহ আরো অনেক কিছু।
মসজিদ কমিটির সভাপতি সেক্রেটারিরা মসজিদের ফান্ডে লাখ লাখ টাকার হিসাব আড়ম্বরে ঘোষণা করে অথচ নিয়মিত গরীবদেরকে একবেলা ফ্রি খাবার ব্যবস্থা তারা কয়জন করেন? মসজিদের আশপাশের রাস্তায় মানুষ বাধ্য হয়ে প্রসাব করতেছে তবুও মসজিদের টয়লেটে যেতে পারছে না। কারণ টয়লেটে তালা মারা। দুরের পথিক রাত হয়ে গেলে মসজিদের বারান্দায় একরাত ফ্রী থাকতে পারে না কারণ প্রধান ফটোকে তালা মারা।
আমাদের মসজিদ গুলো থেকে এলাকার বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য, বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য কোন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারতো। এরাই চিল্লায়া ওয়াজ করে সুদ খাওয়া হারাম অথচ মসজিদের ফান্ড থেকে কোনদিন কোন বেকারকে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে বা কর্জে হাসান দিয়ে উপকার করছে কিনা কেউ সেরকম উল্লেখযোগ্য নজির বা দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি। সংশ্লিষ্ট এলাকার এরকম হাজারো ছোটখাটো সমস্যা মসজিদ থেকে হতে পারতো। আর আমাদের দেশ হতে পারতো মানবাধিকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অথচ মসজিদের শহর আমাদেরই ঢাকা এবং আমরা ফেন্সি মসজিদ নির্মানে ব্যস্ত।
ছবিঃ অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:৫৯