রজর আলীর গাছীর বয়স সত্তুরের কাছাকাছি হলেও গায়-গতরে এখনো শক্তি সামর্থ্য সবই আছে। রোদে পুড়ে জলে ভিজে গড়া শরীরে কোন রকম বয়সের ভার চোখে পড়ে না। অগ্রাহায়নের শুরুতেই দুই গ্রামের খেঁজুর গাছ প্রস্তুত করতে থাকে রস বের করার জন্য। খেঁজুরের রস বের করা চলবে ফাল্গুন মাসের শেষ পর্যন্ত। প্রতি গৃহস্থের কাছ থেকে বর্গা নেয়া গাছগুলো পরম যতেœ সে রসের জন্য তৈরী করে। এ বছর প্রায় দুইশো গাছ রজব আলী বর্গা নিয়েছে। প্রতিটি গাছের রস প্রতিদিন সমান ভাগে ভাগ করে গেরস্থকে এক ভাগ এবং নিজের এক ভাগ নেয়ার চুক্তি থাকে।
প্রায় সব গাছ ছোলানো হয়ে গেছে। পাল পাড়ার নিতীষ কুমার'’কে দুইশো বিশটা মাটির হাড়ির জন্য বায়নাও করেছে। প্রতিটা হাড়ি দশ টাকা দরে। ব্র্যাক সমিতি থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋন নিয়ে এই বায়না করতে হয়েছিলো। ঋনের টাকা দিয়ে হাড়ি, দড়ি, বাঁশ, দা, সহ আরো টুকিটাকি সরঞ্জাম কিনতেই শেষ হয়ে গেছে। খেঁজুরের গাছ পুরোপুরি রেডি হতে আরো সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। এরই মধ্যে হাড়িগুলোকে এনে ধানের খড়ের মধ্যে আগুন দিয়ে আবারো পোড়াতে হবে, তা না হলে হাড়িগুলো টেকসই হয়না । আর রসের মানও ঠিক থাকে না।
প্রতিদিন রজব আলী প্রায় পঞ্চাশটা করে গাছে হাঁড়ি পাতে। প্রায় বিশ হাড়ি রস হলে গেরস্থদেরই দশ হাঁড়ি রস দিয়ে দিতে হয়। বাকি রসের জন্য আগে থেকেই দাদন দিয়ে রেখেছে ছলেমান ব্যপারী। তাকেই সব দিয়ে আসতে হয়। সপ্তাহ শেষে দাদনের টাকার কিস্তি কেটে বাকি টাকা হাতে পায় রজব আলী। এ সপ্তায় অনেক অনুরোধ করেছে ছলেমান ব্যপারীকে;
- ব্যপারী এই হপ্তায় দাদনের ট্যাকা কাইটো না, ছোড মাইয়াডারে পোলা পক্ষ দেখতে আইবো। বাজার সদায় আছে।
এই কথা শোনার পর ব্যপারী গলা খাকারি দিয়ে উঠলো,
- তোমাগো তো দেহি বারো মাসে তেরো কেত্তন লাইগাই থাহে, দাদন নেয়ার সময় তো এই সব কওনা, যাও মিয়া।
মনটা ভিষন রকমের খারাপ হয়ে গেলো রজব আলীর। ছোট মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তাছাড়া মুদির দোকানে অনেক টাকা বাকি পরে আছে। দোকানের সামনে দিয়ে গেলে প্রতিদিন অপমান হওয়া লাগে। কি করবে ভেবে কোন কুল কিনারা করতে পারছেনা।
ভোর থেকে শুরু করে সকাল আটটার মধ্যে গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে সেই রস ছলেমানের আড়তে দিয়ে বাসায় ফিরে হাড়িগুলো ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতে প্রায় দশটা বেজে যায়। এতো বেলা পর্যন্ত খালি পেটেই থাকা লাগে রজব গাছীর। ঘরে এসে এক থাল পানতা ভাত নিয়ে বসে। সাথে একটা ডিম ভাজা আর নুন। কোন কোন দিন শুধু পিয়াজ আর মরিচ দিয়েই খেতে হয়।
আজ রজবের বৌ সামনে পানতা ভাতের থালা দিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা তুলেছে;
- সামনের বিষ্যুদবার মাইয়া দেখতে আইবো, মেয়েতো আগে থিকাই তাগো পছন্দ। ঘটক কইছে ঐদিনই শরা-কলমা দিয়া কাজ সাইরা ফালাইবো, তোমার ট্যাকার যোগাড় হইলো?
- নাহ ছলেমান কথা শোনে নাই। দাদনের ট্যাকার কিস্তি কাইটা রাখছে।
- তাইলে উপায় কি? মাইয়াডারে কি আইবুড়ি কইরা রাখবা? শোনো, আমি এই সোমন্ধ হাত ছাড়া করুম না। আমি গ্রামীন ব্যাংক থিকা আবার দশ হাজার ট্যাকা লোন তুলুম, আর মাত্র তিনডা কিস্তি বাকি আছে। আফায় কইছে আগের তিন কিস্তির ট্যাকা কাইট্টা নতুন কইরা দশ হাজার ট্যাকা লোন নেওন যাইবো।
- বুজলাম, কিন্তু হপ্তা না ঘুরতে কিস্তির ট্যাকা কেমনে দিমু আমি?
- পরের চিন্তা পরে করন যাইবো।
লোনের টাকা দিয়ে ছোট মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়ে গেল। নিজেদের আতœীয়-স্বজন সহ আশপাশ দুই চার ঘর দাওয়াত করে খাইয়েছে। এ জন্য গাছীর বৌয়ের এক মাত্র সোনার জিনিস কানের দুলটাও দারোগার বৌয়ের কাছে বন্ধক রাখতে হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে টাকা দিয়ে না ছাড়িয়ে আনলে সে কানের দুল আর ফেরৎ পাবে না।
হাড়ি শুকাতে দেয়ার পর সকাল দশটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত রজব আলী গ্রামে ভ্যান চালায়। সবাই এখন মটর লাগনো অটো ভ্যান চালায়। কিন্তু রজব আলী পায়ে প্যাডেল মারা ভ্যান চালায়। পায়ে ঠেলা ভ্যানে যাত্রিরাও এখন উঠতে চায় না। সময় বেশি লাগে। তাই রজব গাছীর ইনকামও কমে গেছে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিলো একটা অটো ভ্যান কেনার। কিন্তু কেনার সামর্থ্য নাই।
শরিফুল রজব গাছীর পাশের বাড়ির রমিজ মাঝির ছেলে। আশা সমিতির ম্যানেজার। রজব গাছীর ভ্যানে চড়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে মহিলা সমিতিগুলা পরিদর্শনে যায়। একদিন যেতে যেতে ভ্যানে বসে দেখছে রজব গাছীর শরীরটা আর চলছে না। অনেক কষ্টে প্যাডেল মারছে। এটা দেখে শরিফুল বলছে;
-মামু, একখান অটো ভ্যান কিন্নালাও। তোমার এতো কষ্ট আর হইবো না। তিন চাইর জন যাত্রী লইয়া তোমার এই বয়সে প্যাডেল মারতে তো শইল্লের বিরাট কষ্ট হইতাছে।
- হ, ঠিকই কইছো বাবা। কিন্তু ট্যাকা পামু কৈ?
- তোমার ট্যাকা লাগলে আমারে কও, কিস্তিতে কেনার ব্যবস্থা কইরা দিমুনে। কতো ট্যাকা দাম একখান অটো ভ্যানের।
-তা প্রায় বিশ পচিঁশ হাজার তো হইবোই।
- আইচ্ছা, তুমি রবিবার হাটে আইসো। আামার সমিতির তালিকা ভুক্ত দোকান আছে, হেই দোকান থিকা ভ্যান লইয়া দিমুনে। তুমি পনেরো দিন পর পর কিস্তি টানবা। এক বচ্ছর পর কিস্তি শোধ হলে ভ্যান তোমার নিজের।
অবশেষে একটা অটো ভ্যান কেনা হলো রজব গাছীর। ফাল্গুন মাসেরও শেষ। খেঁজুর গাছ থেকে আর তেমন রস বের হচ্ছে না। আর বড় জোর দুই এক সপ্তাহ হাড়ি পাতা যাবে। এখন প্রায় ফুল টাইম ভ্যান চালায় রজব আলী। রাত নয়টা দশটা পর্যন্ত। কিন্তু এখন প্রতি সপ্তায় রজব গাছীর ঘরের দুয়ারে তিন চার জন কিস্তি আদায় করতে আেেস। ভ্যানের কামাই, রস বিক্রী করার কামাই সবই নিয়ে যায় কিস্তিওয়ালারা।
এরই মধ্যে গত সপ্তায় বিরাট ধাক্কা সামলাতে হয়েছে। হঠাৎ করে বৌ’টার পেটে ব্যাথা শুরু হলো। চিৎকার দিতে দিতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। রবজ গাছী ভ্যানে উঠিয়ে সদরের হাসপাতালে এসে ভর্তি করিয়ে অপারেশন করাতে হয়েছে। ডাক্তার বলেছে জরুরী ভাবে অপারেশন করাতে হবে। অপারেশন করাতে না পারলে এ্যাপেন্ডিক্স ফেটে রোগীর মৃত্যও হতে পারে। কোন কুল কিনারা না পেয়ে বহু শখের ভ্যান গাড়ীটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। সেই ভ্যান বিক্রির টাকায় কোন মতে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে বৌ’কে বাড়ি নিয়ে এসেছে।
ভ্যান বিক্রি করার পর একদিন হুলস্থুল কান্ড ঘটলো। হাটের দিন রজব আলীকে হাটে পেয়ে ভ্যানের দোকানের মালিক আর ছলেমান ব্যাপারী মিলে কলার চেপে ধরে নিয়ে ব্যাপারীর গদির সামনে নিয়ে এসেছে। চারপাশ থেকে আরো লোকজন জড়ো হয়ে ঘিরে ধরেছে। চিৎকার করে ভ্যানের দোকানদার বলছে;
- বাইনচোদ, কোন সাহসে তুই তিন কিস্তি দিয়াই আমার ভ্যান বিক্রি করলি? বল। আইজ ট্যাকা দিয়া তোরে কোন বাজানে ছাড়ায়া নিবো দেখি।
আরো কতো অশ্রাব্য গালাগাল। হাট ভর্তি মানুষের মধ্যে এতো অপমানে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে রজব আলী। বড় মেয়ের জামাই এই হাটেই দোকান করে। খবর পেয়ে বড় জামাই জামিন হয়ে শশুড়কে এই যাত্রা থেকে রক্ষা করেছে।
এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে রজব আলী। কিস্তিওয়ালাদের অকথ্য গালাগাল, ব্যপারীর হুমকি, মুদি দোকানদারের নির্মম অপমান যেন আর সহ্য হচ্ছে না। কতবার মনে হয়েছে এই অপমান সহ্য করার পর আর বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। ইস্টিশানে গিয়ে রেলের সামনে ঝাঁপ দিয়ে জ্বালা জুড়াই। পরক্ষনেই রজবের মনে হয়েছে এটা কাপুরুষতা। নিজে মরে গিয়ে বেঁচে যাবো হয়তো কিন্তু পাওনাদারেরা আমার স্ত্রী সন্তানদের জীবনও নরক বানিয়ে ফেলবে।
পানতা ভাতের থালা সামনে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করছে রজব আলী। গত রাতে বৌয়ের সাথে পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহেশখালী চলে যাবে সে। রজব আলীর এক দুর সম্পর্কের ভাই মহেশখালী থাকে। তার নাম দাউদ শেখ। দাউদ শেখ বড় মাছ ধরা ট্রলারে করে সাগরে মাছ ধরতে যায়। সেই মাছ আড়তে বিক্রী করে। আড়ৎদাররা সেই মাছ দিয়ে শুটকী বানায়। সে প্রায়ই বলতো; - রজব আমার এইহানে চইলা আয়। সাগরে কামাই ভালো।
তারপর একরাতে বৌ আর ছোট ছেলেটাকে নিয়ে কাউকে না জানিয়ে রজব আলী ট্রেনে চেপে চিটাগং চলে গেলো। সেখান থেকে নদীপথে মহেশখালী। বহুদিন পর রজব’কে দেখে দাউদ অত্যান্ত খুশি হয়েছে। রজব আলী এ মাসের এই কয়টা দিন দাউদের ঘরেই থাকবে। তারপর মাসের প্রথম দিকে একটা ঘর ভাড়া করে সেখানে থাকার ব্যবস্থা হবে।
এখন নিয়মিত সাগরে মাছ ধরতে যায় রজব আলী। সাথে ছেলেটাকেও নিয়ে যায়। ছেলেটার বয়স পনেরো বছর। রজবের বৌ দাউদের বৌয়ের কাছে শুনেছে সাগরের বড় বড় ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ সবাই সহ্য করতে পারে না। সেসব শুনে রজবের বৌ ছেলেকে সাগরে পাঠাতে চায়নি। তারপরও রজব আলী ছেলেকে সাথে নিয়ে গেছে। মাসের মধ্যে সাগরে দুই তিনটা খ্যাপ মারলে বাপ বেটা মিলে যে রোজগার হয় তা দিয়ে গ্রামের ধার-দেনা আস্তে আস্তে পরিশোধ করছে আর সাথে নিজেদের খোরাকী। এখনো কিস্তিওয়ালারা মোবাইল করে গালিগালাজ অব্যহত রেখেছে। কতো আর সহ্য করা যায় তাই রজবের বৌটাও শুটকির চাতালে কাজ নিয়েছে।
মাঝে মধ্যে ট্রলারের পাখায় জাল পেচিয়ে গেলে রজব আলীকে কোমড়ে রশি বেঁধে সাগরে নামতে হয়। ট্রলারের উপর থেকে একজন সে দড়ি ধরে দাড়িয়ে থাকে। দড়ির টানে অনেক সংকেত থাকে। প্রথম প্রথম অনেক ভয় করতো ডুব দিতে। এতো বড় সমুদ্র, যদি হাঙ্গরে টেনে নিয়ে যায় আরো কতো কি। জাল ছাড়াতে কোন কোন দিন অনেক সময় লেগে যায়। লবনাক্ত পানিতে হাত পায়ের চামড়া সাদা হয়ে কুচকে যায়।
সাগর থেকে জাল তোলার পর দেখা যায় সমুদ্রের বিচিত্র রকম মাছ, যা কোন দিন রজব আলী দেখেনি। একদিন অবাক হয়ে রজবের ছেলে ‘মন্টু’ লক্ষ করলো মাঝারি সাইজের একটা মাছকে হাতির শুড়ের মতো কয়েকটা প্রানী এমন ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে মাছটা কোন ভাবেই ছুটতে পারেনি। মরে যাবার পরও পেঁচিয়ে রেখেছে শুড়গুলো দিয়ে। মন্টু অবাক হয়ে রজব’কে জিজ্ঞেস করলো;
- আব্বা,এইগুলান কি?
- এইগুলান অক্টোপাস। একটাও ফেলনা না, দাম অনেক, আলাদা কইরা রাখ।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্টু অক্টেপাস গুলোকে ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে বরপের বাক্সে তুলে রাখছে।
রজব আলী অক্টোপাসের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে;
- আমিও তো এহন ঐ মাছটার মতনরে বাজান, আমারে কতোগুলান অক্টোপাস প্যাঁচ দিয়া রাখছে। জানিনা কবে ছুটতারমু।
এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের অক্টোপাসের বাহু থেকে হয়তো একদিন রজব আলীদের মুক্তি মিলবে, হয়তো মিলবে না, কিংবা অক্টোপাসের এই বাহুতে চলে আসবে ‘মন্টুরা’ ধারাবাহিক পরম্পরায়।
ঢাকা, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
ছবিঃ অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৪:১৩