somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাসুদ রানার বই আক্রমণ এর (র্পব-৬) প্রকাশ করলাম...

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাড়াতাড়ি রুবির পিছু নিয়ে বেরিয়ে এলো বার থেকে।
রুবিকে বিশ মিনিট সময় দিলো রানা, জানে সন্ধ্যায় বাইরে বেরুবার জন্যে
সাজগোজ করতে পছন্দ করে মেয়েরা। ও নিজেও সিভিল ড্রেসে বেরুতে চায়,
যদিও সেটাও হবে প্রায় আরেক ধরনের ইউনিফর্মÑডানহিল ¯−্যাকস আর বে−জার,
ব্রেস্ট পকেটে আরএন ক্রেস্ট।
গাঢ় নীল বিএমডবি−উ-টা নিয়ে মেয়েদের অফিসার্স কোয়ার্টারের সামনে চলে
এলো রানা। অবাক হয়ে দেখলো, ওর আগেই পৌঁছে গেছে রুবি বেকার,
চেহারায় রাজ্যের প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। সিভিল ড্রেসের ওপর
১৩
একটা ট্রেঞ্চ কোট পরেছে সে, কোমরের কাছে আঁট করে বেল্ট বেঁধেছে, ফলে
সুগঠিত কোমর আর নিতম্ব নিখুঁতভাবে ফুটে থাকায় আকর্ষণের মাত্রা বেড়ে গেছে
বহুগুণ। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে রানার পাশে বসলো রুবি, স্কার্টটা উঠে
গিয়ে চার ইঞ্চি ঊরু উন্মুক্ত হলো। গেট দিয়ে বেরুবার সময় রানা লক্ষ্য করলো,
কোট বা স্কার্ট ঠিকঠাক করার কোনো গরজ নেই মেয়েটার মধ্যে, সিট-বেল্ট বাঁধার
কাজে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।
‘তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা, ক্যাপ্টেন রানা?’
গলার খসখসে, সেক্সি ভাবটুকু ওর কল্পনা, নাকি বরাবরই ওটার অস্তিত্ব
ছিলো? ‘ছোট্ট একটা পাবে। ভালো খাবার পাওয়া যায়। মালিকের বউ ফরাসী,
তারমানে রান্নাটা হয় প্রথম শ্রেণীর। ডিউটির সময় ছাড়া আমাকে তুমি রানা বলে
ডাকতে পারো।’
রুবির কণ্ঠে হাসির আভাস পেলো রানা, মেয়েটা যেন পুলকে অস্থির হয়ে
পড়েছে। ‘ধন্যবাদ, রানা। আমার একটা ডাক নাম আছে, মেয়েরা আমাকে শেলি
বলে ডাকে। আমি যদিও রুবিটাই পছন্দ করি।’
‘রুবি আমারও পছন্দ।’
‘গল্পটা বহুবার বাবার মুখে শুনেছি। মেয়ের খুব শখ ছিলো বাবার। আমি
যখন পেটে এলাম, মাকে বাবা বললো, তুমি যদি মেয়ে উপহার দাও তাহলে আমি
তোমাকে রুবি পাথরের একটা আঙটি উপহার দেবো। সেই সূত্রেই আমার নাম
রাখা হলো রুবি। তবে দ্বিতীয় গল্পটা বেশি রোমান্টিক, তাই সেটাই আমার
পছন্দ।’
‘কি সেটা?’
আবার মেয়েটার কণ্ঠস্বরে চেপে রাখা হাসির আভাস পেলো রানা। ‘আমি
যখন পেটে আসি তখন গোধূলি, খোলা আকাশের নিচে আমাকে রোপণ করেন
বাবা, আকাশের রঙ ছিলো ঠিক রুবি পাথরের মতো লাল।’
দীর্ঘ একটা বাঁক নিতে ব্যস্ত রানা। ‘রুবি নামটা আমার প্রিয় এই জন্যে যে
এই নামে বয়স্কা এক ভদ্রমহিলাকে চিনি আমি, যিনি আমাকে অত্যন্ত øেহ করেন।
মহিলার স্বামী মস্ত বড় ইন্টেলিজেন্স অফিসার ছিলেন।’ রানার তরফ থেকে
বাজিয়ে দেখার চেষ্টা এটা, রুবি বেকারও ওর মতো একই পেশায় আছে কিনা
জানতে চাওয়া। মারভিন লংফেলো বলেছেন, আশপাশে অন্যান্য অফিসাররাও
থাকবেন। কিন্তু রুবি বেকার টোপটা গিললো না।
‘আজ বিকেলের ঘটনাটা সত্যি, রানা?’
‘কোন্ ঘটনাটা?’
‘তোমাকে লক্ষ্য করে সত্যি কেউ সাইডউইণ্ডার ছুঁড়েছিল?’
‘আমি অন্তত সেরকমই উপলব্ধি করেছি। তুমি শুনলে কোত্থেকে? ব্যাপারটা
তো অনেকের কাছে গোপন থাকার কথা।’
‘আরে, তুমি জানো না? হ্যারিয়ারগুলো দেখাশোনা করে মেয়েরা, আমি
তাদের লিডার।’ রয়্যাল নেভির নিজস্ব ভাষায় স্থল ঘাঁটিগুলোকে স্টোন ফ্রিগেট
বলা হয়। ঘাঁটিতে মেইন্টেন্যান্স ও আর্মিং-এর দায়িত্ব পালন করে, বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে, মেয়ে অফিসাররা। ‘জেফারসন, উইংস-এর জেফারসন, আমাকে একটা
মেমো পাঠালো, মুখে বলার চেয়ে মেমো লেখায় বেশি দক্ষ সে, বিশেষ করে
মেয়েদেরকে লিখতে খুবই পছন্দ করে। মেমোটা পাবার পর তোমাদের সব
পে−নের ইলেকট্রনিক্স চেক করে দেখছি আমরা, যাতে ধোঁকায় না পড়ো।’
‘ওটা একটা মিসাইল ছিলো, রুবি। মিসাইলের ধাওয়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা
আমার আছে, তুমি জানো। শব্দটা আমি চিনি।’
‘তবু আমাদের চেক করে দেখতে হবে। তুমি তো জানো কমাণ্ডার কি ধরনের
লোক, সব সময় অভিযোগ করছেÑআমরা রেন-রা নাকি তার প্রিয় হ্যারিয়ারগুলোর
ঠিকমতো যতè করছি না। আমাদের যতেè নাকি নারীসুলভ আদর আর ভালোবাসার
অভাব থেকে যাচ্ছে।’ হাসলো রুবি, খসখসে ও সংক্রামক, মনে হলো রানার।
পনেরো মিনিট পর, পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি রেস্তোরাঁটার এক কোণের একটা
টেবিলে বসে আছে ওরা। পরিবেশিত হলো রাম্প্ স্টেক, আলু আর রসুন দিয়ে
রান্না করা গোমাংস। ঘণ্টাখানেক না পেরুতেই দেখা গেল পুরনো বন্ধুর মতো
চুটিয়ে গল্প করছে ওরা। জানা গেল, কিছু লোককে দু’জনেই চেনে ওরা। রুবির
বাবা যাজক ছিলেন, কিন্তু তাঁর বড় ভাই, স্যার মার্টিন বেকার, বেকারটন ন্যাব-এর
সপ্তম ব্যারন ও মালিক ছিলেন। শিকার উপলক্ষ্যে বেকারটন ন্যাব-এ দু’একবার
গেছে রানা, শুনে উৎফুল− হয়ে উঠলো রুবি। ‘তাহলে তুমি আমার চাচাতো ভাই-
বোন বুথ আর জেমকে নিশ্চয়ই চেনো?’ প্রশ্ন করে ঝট্ করে মুখ তুলে তাকালো
সে।
‘ঘনিষ্ঠভাবে,’ অবলীলায়, কোনো রকম ইতস্তত না করে জবাব দিলো রানা,
চেহারায় কোনো ভাব ফুটলো না।
প্রসঙ্গটা দীর্ঘ করার উৎসাহ দেখালো না রুবি। এরপর ওরা বেকারটন ন্যাব-
এ শিকার সম্পর্কে আলোচনা করলো, আলোচনা করলো রয়্যাল নেভিতে সময়
কাটানোর সমস্যা নিয়ে, তারপর সঙ্গীত প্রসঙ্গ উঠতে রুবি বললো, ‘আমার বড়টা,
আর্থার, কেমব্রিজে পড়ার সময় প্রথম আমাকে জাজ শুনতে নিয়ে যায়, সেই থেকে
অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছি জাজের।’ ক্যারিবিয়ানে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা, দু’জনেরই
আছে। স্কিয়িং, দু’জনেরই পছন্দ। থ্রিলার রাইটার হিসেবে উইলবার স্মিথ, এরিক
অ্যাম্বলার আর গ্রাহাম গীন ওদের প্রিয়।
‘যেন মনে হচ্ছে কতো যুগ ধরে তোমাকে আমি চিনি, রানা,’ ঘাঁটিতে ফেরার
সময় বললো রুবি।
সম্ভবত, ভাবলো রানা, এটা একটা কথার কথা, আবার আমন্ত্রণও হতে
পারে। পাশের একটা গলিতে ঢুকিয়ে গাড়িটা দাঁড় করালো ও, বন্ধ করলো
এঞ্জিন।
‘আমারও সেই একই অনুভূতি, রুবি, মাই ডিয়ার।’ অন্ধকারে মেয়েটার
দিকে হাত বাড়ালো রানা। ওর প্রথম চুমোটা আনাড়ির মতো হলো, সাড়া দিলো
রুবি, কিন্তু রানা আরো কাছে আসার চেষ্টা করছে দেখে বাধা দিলো সে।
‘না, রানা। না, এখুনি নয়। ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে
আমরা যখন শিপমেট হতে যাচ্ছি।’
১৪
‘শিপমেট মানে?’ রুবির চুলের ভেতর আঙুল চালালো রানা।
‘শিপ, ইনভিনসিবল...।’
‘ইনভিনসিবল কি?’ ধীরে ধীরে সরে এলো রানা।
‘কেন, দু’জনই তো আমরা অ্যাটাক এইটিনাইন উপলক্ষ্যে ওখানে হাজিরা
দেবো, তাই না?’
‘এই প্রথম শুনলাম আমি,’ শান্তই থাকলো রানার গলা, কিন্তু উদ্বেগের একটা
অনুভূতি সাপের মতো কিলবিল করছে তলপেটের ভেতর। ‘এই প্রথম শুনলাম
রেন-রা সাগরে যাচ্ছেÑবিশেষ করে আক্রমণ ’৮৯-এর মতো একটা
এক্সারসাইজে।’
‘কেন, ঘাঁটির প্রায় সবাই তো জানে। ইন ফ্যাক্ট, অফিশিয়ালি জানানো
হয়েছে আমাকে। আমরা মেয়েরা পনেরোজন। আমি, আর চোদ্দজন রেটিং।
জাহাজে আরো মেয়ে থাকবে।’
‘কিন্তু আমার ব্যাপারটা?’ শুধু উদ্বিগ্ন নয়, রীতিমতো ভয় পাচ্ছে রানা। ওকে
ইনভিনসিবলে ডিউটি দিতে হবে, এটা যদি সবাই জানে তাহলে শত্র“পক্ষের পক্ষে
বাকিটা আন্দাজ করে নেয়া অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। শত্র“পক্ষকে ছোটো করে
দেখার কোনো অবকাশ নেই, কারণ অনেক গোপনীয় তথ্য ইতিমধ্যে তারা জেনে
ফেলেছেÑরাশিয়ান নেভির সি-ইন-সি ছাড়াও তিনজন সিনিয়র অ্যাডমিরাল
থাকবেন ইনভিনসিবলে। বিদ্যুৎচমকের মতো আজ বিকেলের ঘটনাটা মনে পড়ে
গেল রানার। তাহলে কি ওটা ওকে খুন করার প্রচেষ্টা ছিলো?
অজুহাত দেখাবার সুরে নিজের কথা বলে চলেছে রুবি বেকার। রানা যে
জড়িত, তা সে জানে বলেই প্রসঙ্গটা তুলেছে। ‘ব্যাপারটা ক্লাসিফায়েড তো
বটেই,’ আÍরক্ষার সুরে বললো সে। ‘কিন্তু সিকিউরিটি সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ তো
শুধু যাদের জানার দরকার নেই তাদের জন্যে।’
‘যাদের জানার দরকার আছে আমি বুঝি তাদের দলে পড়ি?’
‘তালিকায় তোমার নাম আছে, রানা। অবশ্যই ক্লিয়ার‌্যান্স পেয়েছো তুমি।’
‘আরো মেয়ে বলতে কি বোঝাতে চেয়েছো তুমি? কারা তারা?’
‘তা আমাদের জানানো হয়নি। আমি শুধু জানি, ইনভিনসিবলে আমরা ছাড়াও
অন্য মেয়ে থাকবে।’
‘ঠিক আছে, একেবারে প্রথম থেকে যা জানো সব বলো আমাকে, রুবি।’
মনোযোগ দিয়ে শুনলো রানা, আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। এতোটাই,
যে নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে মারভিন লংফেলোর সাথে সাক্ষাতের
জরুরী প্রয়োজন অনুভব করলো ও। ‘এ-ব্যাপারে যার-তার সামনে বক বক
করাটা ঠিক হবে না, রুবি,’ বললো ও। ‘এমনকি আমার সাথে আলাপ করাও
উচিত নয়।’
ঘাঁটিতে ফিরে এলো ওরা। গাড়ি থেকে মেয়েদের অফিসার্স কোয়ার্টারের
সামনে নামার আগে বিষণœ চোখ তুলে রানার দিকে তাকালো রুবি, বললো, ‘অন্তত
চুমো খেয়ে শুভরাত্রি জানাও আমাকে, রানা।’ অভিমান উথলে উঠলো তার
গলায়।
স্মিত হাসলো রানা, হাত তুলে আঙুল দিয়ে রুবির নাকটা ছুঁয়ে দিলো। ‘না,
রুবি। না, এখুনি নয়। ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে আমরা
যখন শিপমেট হতে যাচ্ছি।’
গাড়ি নিয়ে একা ফেরার পথে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে যতোই চিন্তা করলো
ততোই গম্ভীর হয়ে উঠলো রানা। ঘাঁটি থেকে মাইলখানেক দূরে এসে একটা
টেলিফোন বক্স থেকে বিএসএস-এর হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করলো
ও। ডিউটি অফিসারের সাথে কথা হলো ওর, একটা স্ক্র্যাম্বলার ব্যবহার করছে
সে। কথা দিলো, রোববারে মারভিন লংফেলোর সাথে রানার দেখা করার ব্যবস্থা
করবে।



চার

সী হ্যারিয়ার আর স্প্যানিশ পাইলট রিকি ভালদাজকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সন্ধ্যার দিকে তল−াশির কাজ স্থগিত রাখা হলো, সকালে আবার শুরু করা হবে।
পাইলট আর তার পে−নের ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছে?
সার্চ পার্টি তখনো হ্যারিয়ার বা পাইলটের খোঁজে রওনা হয়নি, বেশ
আয়েশের সাথে একটা ছোটো ফ্রেইটার-এর কেবিনে বসে ধূমায়িত কফির কাপে
চুমুক দিচ্ছে রিকি ভালদাজ। ফ্রেইটারটা রয়েছে তার নিজের দেশ, স্পেনের
উপকূল থেকে দুশো মাইল দূরে।
জাহাজটা পর্তুগালে রেজিস্ট্রি করা, বো আর স্টার্নে নাম লেখা রয়েছে
‘মিরানডা সালামানকা’। পর্তুগালের অপোর্টো বন্দরের দিকে যাচ্ছে ওটা।
অপোর্টো ভালো ওয়াইনের জন্যে বিখ্যাত। সাগরে প্রায় ডুবে আছে মিরানডা,
বোঝা যায় হোল্ডে ভারি কার্গো বহন করছে। শুধু হোল্ডে নয়, সামনের দিকে
বড়সড় একটা কনটেইনারও রয়েছে, ডেকের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে।
জাহাজের কাগজ-পত্রে দেখা যাবে, কনটেইনারে এঞ্জিনিয়ারিং ইকুইপমেন্ট রয়েছে,
গন্তব্য জিব্রালটার। ইকুইপমেন্টগুলো পাঠাচ্ছে বিখ্যাত একটা ব্রিটিশ কোম্পানী।
অপোর্টোয় শুধু রিফুয়েলিঙের জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা থাকবে মিরানডা, কাজেই
কাস্টমস চেকিঙের ঝামেলা নেই।
কেবিনে রকি ভালদাজের সামনে ক্যাপটেন নয়, বসে রয়েছে ফারাজ
লেবানন, বাস্ট-এর স্ট্র্যাটেজিস্ট। প−্যানটা কিভাবে সফল হলো তার বিস্তারিত
বিবরণ দিচ্ছে ভালদাজ, শোনার ফাঁকে ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছে ফারাজ লেবানন,
মাঝে মধ্যে প্রাণ খুলে হেসে উঠছে।
‘প−ট থেকে সরে এসেছি, জানতাম কেউ লক্ষ করেনি,’ স্প্যানিশ ভাষায় দ্রুত
কথা বলছে ভালদাজ। ‘আপনার লোকজনও ঠিক সময়ে অপেক্ষা করছিল। মাত্র
দুই মিনিট লাগলো।’
চারটে হ্যারিয়ার টেক-অফ করে, তার পে−নটা ছিলো দু’নম্বরে। হ্যারিয়ার
১৫
নিয়ে নির্ধারিত উচ্চতায় ওঠে সে, সতর্কতার সাথে বাধ্যতামূলক কোর্স ধরে
এগোয়। অপারেশনের ছক করা হয়েছিল মাত্র দশ দিন আগে, যদিও তারও আগে
হ্যারিয়ার চুরির প−্যানটা গজায় ওদের মাথায়। আসলে রকি ভালদাজকে কোর্স
করতে পাঠানোই হয়েছে এই কাজের জন্যে। স্প্যানিশ নেভিতে বাস্ট-এর এজেন্ট
কয়েক হপ্তা আগে থেকেই তৎপর ছিলো, রকি ভালদাজকে দলে টানতে বিশেষ
বেগ পেতে হয়নি তার। অবশ্য প্রথমদিকে প−্যানটার মধ্যে মাসুদ রানাকে খুন
করার ব্যাপারটা অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। বাস্ট-এর অপর এক এজেন্ট আক্রমণ ’৮৯-
তে রানার ভূমিকা সম্পর্কে খবর পাঠানোর পর এক ঢিলে দুই পাখি মারার
আয়োজন করে তারা।
শ্রূসবারি-র সামান্য দক্ষিণে, উঁচু আকাশ থেকে গভীর একটা বনভূমিতে নেমে
আসে ভালদাজ। তার নৈপুণ্যের তুলনা হয় না, সী হ্যারিয়ার একটা এক্সপ্রেস
লিফট-এর মতো ঝপ করে খাড়া নেমে আসে বনভূমির মাঝখানে, ছোট্ট ফাঁকা
জায়গাটায়। কাছাকাছি একটা ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে চারজন লোক অপেক্ষা
করছিল। সাইডউইণ্ডার এআইএম-নাইনজে মিসাইলটা হ্যারিয়ারের স্টারবোর্ড
সাইডের পাইলনে ফিট করতে খুব বেশি সময় নেয়নি তারা। (রয়্যাল এয়ারফোর্স
বেস-এর পশ্চিম জার্মান ঘাঁটি থেকে মোট চারটে মিসাইল চুরি যায়, সেগুলোরই
একটা ওটা।) দুই মিনিট বিশ সেকেণ্ডের মাথায় ফাঁকা জায়গা ছেড়ে সবেগে
আকাশে উঠে এলো হ্যারিয়ার, ফিরে এলো নির্দিষ্ট কোর্সে। লিড এয়ারক্রাফটের
পিছনে এবং তৃতীয় হ্যারিয়ারের যথেষ্ট সামনে থাকাটা তার জন্যে জরুরী ছিলো।
‘ইয়োভিলটনের রাডার সত্যি যদি আমাকে হারিয়ে ফেলতো, রেডিওতে খবর
পেতাম আমরা,’ বিজয়ীর হাসি হেসে বললো ভালদাজ, সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালো
ফারাজ লেবানন।
ভালদাজের হ্যারিয়ার রানার পিছনে তিন মাইলের মধ্যে চলে এলো, রানা
তখন বম্বিং রেঞ্জ থেকে ফিরছে। ‘ওটার পিছু নিয়ে মিসাইল ছুঁড়ে দিলাম,’ ফারাজ
লেবাননকে বললো ভালদাজ। ‘এরপর আমার বোমাটা ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে
উঠি আমি।’
দু’দিকে হাত মেলে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো ফারাজ লেবানন। ‘আমার ভয় হচ্ছে
বন্ধু মাসুদ রানা বেঁচে গেছে।’ হাসলো সে, যেন বলতে চায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল
হওয়া কঠিন।
বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রকি ভালদাজ, বিব্রতবোধ করছে। ‘দুঃখিত।
সাধ্যমতো যতোটুকু করার করেছি আমি। লোকটার নার্ভ ইস্পাত দিয়ে তৈরি,
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত বিপদেও ঘাবড়ে যায়নি ব্যাটা।’
‘মন খারাপ করবেন না। ক্যাপটেন রানার ব্যবস্থা করার যথেষ্ট সময় পাওয়া
যাবে। আফসোস এই যে এক ঢিলে দুটো পাখি মারা গেল না। তবে, আমি কথা
দিচ্ছি, মি. ভালদাজ, তাকে বিদায় নিতে হবে। আমাদের অপারেশন সফল করতে
হলে এর কোনো বিকল্প নেই।’
হাসলো ভালদাজ, সোনা দিয়ে বাঁধানো দাঁত দুটো বেরিয়ে পড়লো। তারপর
কাহিনীটা শেষ করলো। সফলতার সাথে বোমা ফেলে আকাশে উঠে আসে সে।
‘রাডারে ধরা পড়ার জন্যে ৩০০ ডিগ্রী উঁচু করি পে−নের নাক। এক হাজার ফুটে
পৌঁছে সবগুলো ফ্লেয়ার ছাড়ি, বোতাম টিপে অফ করি নিজের রাডার, তারপর
অন করি ইসিএম।’ ইলেকট্রিক কাউন্টার মেজারস পড ব্যবহার করা হয় স্থল
রাডার ও মিসাইলকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। ‘ব্যাপারটা ফুল প্র“ফ নয়, অবশ্যই,
তাই আমি জিরো ফুটে নেমে আসি পে−ন নিয়ে, তারপর আপনার দেয়া কোর্স
ধরি। ভারি মজা পাচ্ছিলাম, বিশ্বাস করুন। পানি থেকে মাত্র কয়েক ফুট ওপরে
ছিলো আমার পে−ন। পানির ছিটা লাগছিল, হিটার আর ওয়াইপার পুরোদমে চালু
থাকলেও উইণ্ডশীল্ড সবসময় পরিষ্কার রাখা যাচ্ছিলো না। ঠিক ওড়া নয়, বলা
যায়, বোট নিয়ে ভাসছিলাম।’
সোজা আটলান্টিকে বেরিয়ে আসে হ্যারিয়ার, তারপর বে অভ বিস্কে-র দিকে
ঘুরে যায়। দুশো মাইল পেরিয়ে এসে অপেক্ষারত মিরানডা সালামানকার পাশে
পে−নটাকে স্থির করে ভালদাজ। খাড়াভাবে ল্যাণ্ড করার জন্যে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে
ফ্রেইটারে। ককপিট থেকে বেরিয়ে এলো সে, পরমুহূর্তে লোকজন পে−নটার
চারধারে ফলস সাইড খাড়া করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, তৈরি করে ফেললো
বিশাল কনটেইনারটা।
‘গুড।’ তেল চকচকে হাসির রেখা আর ভাঁজ ফুটিয়ে তুললো ফারাজ লেবানন
মুখে। ‘আপনার কৃতিত্বের প্রশংসা করি আমি। এখন আমাদের সবার দেখতে
হবে মেশিনটা যাতে ঠিকমতো ওভারহল করা হয়, ঠিকমতো ফুয়েল ভরা হয়,
তারপর অস্ত্র দিয়ে সাজানো হয়। এই কাজগুলো শেষ হলেই অপারেশনের দ্বিতীয়
পর্যায়ের দায়িত্ব চাপবে আপনার কাঁধে। ভালো কথা, এটার নাম দিয়েছি আমরা,
অপারেশন লস।’ রহস্যময়, সকৌতুক হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে। ‘নামটা ইচ্ছে
করেই ব্যঙ্গাÍক রাখা হয়েছে, তবে ভারি অর্থপূর্ণ। অপারেশন লস মানে মেজর
সুপার পাওয়ারগুলো তাদের প্রিয় কিছু জিনিস হারাবেÑনিজস্ব জাইরোস্কোপ ছাড়া
কোন্ রাষ্ট্রই বা চলতে পারে, বলুন?’
‘এই অংশটুকু বুঝলাম না,’ বললো ভালদাজ, যদিও কোনো ব্যাখ্যা দাবি
করলো না সে, তবে অস্বস্তিবোধ করছে।
‘আপনি বুঝছেন না, কারণ আপনার জানা নেই আসলে ঠিক কি বাজি ধরেছি
আমরা।’ আবার সেই তেল চকচকে হাসি দেখা গেল ফারাজ লেবাননের মুখে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ‘আসুন, খানাপিনা সারি। কিছু রসের আলাপও
হতে পারে। আপনার জন্যে ভারি মজাদার একটা উপহার আছে। মিষ্টি, পাকা,
টসটসে। আমাকে বলা হয়েছে, মিশরীয় মেয়ে সে, আপনার মতোই ধাওয়া করতে
অভ্যস্ত। তবে আগে ভূরিভোজন, কারণ আপনার প্রচুর এনার্জি দরকার হবে।’

শনিবার প্রায় সারাটা দিনই আকাশে থাকলো রানা, সন্ধ্যা আটটার দিকে
ওয়ার্ডরুমে ডিনার খেতে এসে দেখলো লোকজন নেই বললেই চলে। অ্যান্টি-
রুমে ঢুকলো ও, রুবি বেকারকে দেখে বিস্মিত হলো। স্মার্ট, প্রায় সামরিক ধাঁচের
ড্রেস পরে আছে সে। ‘কেমন আছো, রুবি?’ স্মিত হাসলো রানা, যেন কাল
রাতের মান-অভিমানের কথা ভুলে যাওয়া হয়েছে।
১৬
‘ভালো আছি, স্যার,’ পদমর্যাদার কথা মনে রেখে কথা বললেও, হাসলো
রুবি বেকার। ‘আপনার সাথে কথা বলবো বলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি।’
‘বেশ। ডিনার খেতে আপত্তি নেই তো?’
‘সত্যি খুশি হবো। কোটটা নেবো আমি। আমরা কি...
?’
মাথা নাড়লো রানা, একটা হাত বাড়ালো রুবিকে থামাবার জন্যে। ‘শনিবারে
ওয়ার্ডরুমে লোকজন প্রায় থাকেই না, রুবি। দেখাই যাক না কি পরিবেশন করে
এরা।’
দেখা গেল ওয়ার্ডরুমে ওয়াচ অফিসার আর রয়্যাল মেরিন ডিউটি অফিসার
ছাড়া আর কেউ নেই। দু’জনেই তারা সমীহের সাথে রানার উদ্দেশ্যে মাথা
ঝাঁকালো, কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না। পথ দেখিয়ে ওদের কাছ থেকে
বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে এলো রানা রুবিকে, এক কোণের টেবিলে সামনাসামনি
বসলো দু’জন। একজন রেন স্টুয়ার্ড পরিবেশন করলো। মেনুতে রয়েছে স্মোকড চলবে... ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×