স্যামন, তারপর গ্রিলড্ স্টেক। স্টেক বাদ দিয়ে গ্রীন স্যালাড-এর অর্ডার দিলো
রানা।
অলসভঙ্গিতে আলাপ করলো ওরা, যে সমস্যা সম্পর্কে দু’জনেই সচেতন
সেটা এড়িয়ে গেল কৌশলে, যতোক্ষণ না মেইন কোর্স পরিবেশিত হলো।
প্রসঙ্গটা তুললো রুবি। ‘কাল রাতে যা ঘটেছে সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’ কথা
বলার সময় অন্যদিকে তাকালো সে, লালচে হয়ে উঠলো চেহারা।
‘কোন্ অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইছো?’ মেয়েটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে
থাকলো রানা, যতোক্ষণ না চার চোখ এক হলো।
‘সমস্ত সিকিউরিটি রেগুলেশন লঙ্ঘন করেছি আমি, স্যার। অ্যাটাক
এইটিনাইন বা ইনভিনসিবল, দুটোর কোনোটাই আমার উচ্চারণ করা উচিত
হয়নি। সত্যি আমি দুঃখিত। আসলে অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল, বিশেষ
করে আমি যখন জানি যে জাহাজে আপনাকেও পাঠানো হবে।’
‘ঠিকই বলেছো,’ একটু তীক্ষè কণ্ঠে বললো রানা। ‘ফার্স্ট অফিসার তুমি,
কাজেই ইতিমধ্যে সিকিউরিটির নিয়মকানুন সবই তোমার ভালোভাবে জানা থাকা
উচিত। তোমাকে আমার সত্যি কথা বলতে হবে, রুবি। সুন্দরী তরুণীদের ওপর
খুব একটা ভরসা রাখতে পারি না আমি, ওদের বেশিরভাগেরই মুখে লাইসেন্স
থাকে না। তোমার অন্তত জানার কথা, রয়্যাল নেভিকে সাইলেন্ট সার্ভিস বলা
হয়। চোখ খোলা আর মুখ বন্ধ, রয়্যাল নেভির এটাই তো বৈশিষ্ট্য।’
‘আমি জানি, স্যার। সত্যি দুঃখিত। এইমাত্র ভাবছিলাম, আশা করাটা যদিও
বোকামির পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু যদি আমাকে ক্ষমা করা হয়, তাহলে হয়তো
...
।’
মেয়েটাকে ঠিক বুঝতে পারছে না রানা। বেশি কথা বলা তার কি স্রেফ
একটা স্বভাব, নাকি প্রথম শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী? ‘তাহলে কি?’
‘না, ইয়ে, কাল রাতের ঝগড়াটা মিটে গেলে আবার আমরা
...
।’
‘কাল রাতের কথা ভুলে গেলে নিজের ভালো করবে তুমি, অন্তত যতোক্ষণ না
বিবেকের দংশন থেকে পরিত্রাণ পাও।’ বেশি কড়া কথা বলা হয়ে গেল কিনা
ভেবে ঠোঁট টিপে হাসলো রানা। ‘এসো, গোটা ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি
আমরা। তারপর, সবকিছুই সম্ভব। সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে পারি
আমরা। কোনো সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়।’
হতভম্ব দেখালো রুবি বেকারকে, পে−টটা ঠেলে উঠে দাঁড়ালো সে, বিড়বিড়
করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ওয়ার্ডরুম থেকে। শান্তভাবে ডিনার শেষ
করলো রানা, টেবিল ছেড়ে অ্যান্টিরুমে ঢুকলো, কফির সাথে খানিকটা ব্র্যাণ্ডি
মেশালো, তারপর ফিরে এলো নিজের কোয়ার্টারে। কাল ছুটির দিন, কিন্তু ওকে
খুব ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হবে।
ব্রেকফাস্ট সেরে আটটার মধ্যে রয়্যাল ন্যাভাল স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো ও।
ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে ঢুকে ভালোই লাগছে রানার, ভালো লাগার কারণটা
খুঁজতে গিয়ে উপলব্ধি করলো, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ম্যান অভ রুটিন’, সে
ঠিক তাই। সামরিক বাহিনীতে নাম লেখাবার পিছনেও এটা একটা কারণ ছিলো,
যদিও মুখ্য কারণ ছিলো দেশের সেবা করা, দেশের সীমান্ত এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা
করা।
রয়্যাল নেভিতে পদমর্যাদার সুবিধেটুকু উপভোগ করছে রানা। যদিও এই
মুহূর্তে সুবিধেটুকু নিচ্ছে না ও। সিভিল ড্রেসে রয়েছে রানা, সতর্কতার সাথে
নিজের বিএমডবি−উ চালাচ্ছে, একটা চোখ পড়ে রয়েছে রিয়্যার ভিউ মিররে।
বিদেশ-বিভুঁইয়ে রয়েছে ও, ঘাড়ে বিপজ্জনক একটা অ্যাসাইনমেন্ট, তার ওপর
যাচ্ছে গোপনে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ করতে।
গাড়ি চালিয়ে চেডার-এ চলে এলো রানা, শেষ বসন্তের রোববারে রাস্তায়
লোকজন খুব কম দেখে খুশি হলো মনে মনে। মেইন রোড থেকে বাঁক নেয়ার
সময় কাউকে দেখলো না, গাড়ি নিয়ে এগোলো সুদৃশ্য একটা অট্টালিকার দিকে।
গ্যারেজের বড় দরজা খোলাই পেলো রানা, ক্রিমসন কালারের একটা
ল্যানসিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে জন মিচেল। গাড়ি বদলাতে এক মিনিটও
লাগলো না রানার, ল্যানসিয়া নিয়ে বেরিয়ে এলো ও। ওর বিএমডবি−উটা গ্যারেজে
ঢোকালো মিচেল। রাস্তায় আর কোনো গাড়ি নেই, পথিকরাও এদিকে মনোযোগ
দিলো না। মাথায় একটা ফিশিং হ্যাট পরলো রানা, চোখে গাঢ় রঙের চশমা।
কোনো কথা হলো না, রাস্তায় উঠে এসে রানা দেখলো ওর গাড়িটাকে আড়াল
করার জন্যে গ্যারেজের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে মিচেল।
এক ঘণ্টা পর, এমফাইভ মটরওয়ে ধরে ছুটছে রানার ল্যানসিয়া। বাঁক নিয়ে
এমফোর-এ উঠে এলো ও, এই হাইওয়েই ওকে পৌঁছে দেবে লণ্ডনে। উইণ্ডসোর
এগজিট-এ পৌঁছুতে পনেরো মিনিট লাগলো, এরপর থেকে ঘুরপথ ধরে এগোলো
রানা, দেখতে চায় কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। অনেকটা সময় নষ্ট করে বেলা
এগারোটায় উইণ্ডসোর-বাগশট রোডে ফিরে এলো আবার, ডান দিকে ঘুরে ঢুকে
পড়লো পাথুরে গেটের ভেতর।
গেটের ভেতর সারি সারি ওক আর পাইন গাছ। মূল বাড়ির এক পাশে গাড়ি
থামালো রানা। কাঁকরের ওপর পা ফেলার শব্দ তুলে পোর্টিকো-য় উঠে এলো ও,
কলিংবেলের বোতামে চাপ দিলো। দু’সেকেণ্ডের মধ্যে খুলে গেল দরজা, সামনে
১৭
দাঁড়িয়ে রয়েছে মারভিন লংফেলোর নাতনি সুসান হার্ট। রানাকে দেখতে পাবার
আগে থেকেই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে তার চেহারা, জানে দরজা খুলে কাকে
দেখতে পাবে। ‘কেমন আছো, সুসান?’ কলেজে পড়ে মেয়েটা, চোখে চশমা,
চেহারায় ইন্টেলেকচ্যুয়াল ভাব।
‘ভালো, মি. রানা,’ চশমার ভেতর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া হাসছে। ‘কই,
আপনি তো আর সময় করে একদিন এলেন না! কথা দিয়েছিলেন বৈষ্ণবদের
সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন আমাকে, মনে আছে?’
সুসানের পিছু নিয়ে হলে ঢুকলো রানা। ‘সময় করতে পারিনি, সত্যি
দুঃখিত। ঠিক আছে, আগামী মাসের শেষ হপ্তায় আসবো, কেমন?’
‘মনে থাকে যেন!’ আবদারের সুরে বললো সুসান, মেহগনি কাঠের বিশাল
দরজায় নক করলো।
‘কাম,’ কামরার ভেতর থেকে ভারি গলা ভেসে এলো মারভিন লংফেলোর।
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো রানা। টেবিলটা জানালার কাছে, দুটো
মাত্র চেয়ার, কামরায় আসবাবপত্রের কোনো বাহুল্য নেই। টেবিলের ওপর বড়
একটা অ্যাটলাস, দেয়ালে বেশ কয়েকটা ন্যাভাল প্রিন্টস। মারভিন লংফেলোর
হাতের কাছে দুটো টেলিফোন।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন বিএসএস চীফ, করমর্দন করলেন রানার সাথে,
ইঙ্গিতে বসতে বললেন। ‘আশা করি দেখা করতে চাওয়ার জোরালো কারণ
দেখাতে পারবে তুমি, রানা। তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে, কোনো ডিসট্রেস
সিগন্যাল না পেলে যোগাযোগ করা যাবে না।’
‘মি. লংফেলো, আমি...
।’
‘যদি বলতে চাও কেউ তোমাকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুঁড়েছে, দরকার নেই
বলার, কারণ ঘটনাটা আমি জানি। এ-ও আমি জানি যে, এর জন্যে দায়ী হতে
পারে তোমার পে−নের ইলেকট্রনিক ত্র“টি...
।’
‘উইথ রেসপেক্ট, মি. লংফেলো। ওটা কোনো ইলেকট্রনিক ত্র“টি ছিলো না।
আরো কারণ আছে। কারণ ছাড়া ফিল্ড রুল লঙ্ঘন করবো না আমি, আপনি
জানেন।’
রানা আগেই বসেছে, এতোক্ষণে মারভিন লংফেলোও বসলেন। ‘সেক্ষেত্রেও
তুমি বরং সব কথা
...
।’ ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠে তাকে বাধা দিলো লাল
টেলিফোনটা। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন তিনি, কথা না বলে দু’বার ‘হুম’
করলেন, তারপর ক্রেডলে নামিয়ে রাখলেন রিসিভারটা। ‘কেউ তোমার পিছু
নেয়নি। ভালো কথা, মিসাইলের ব্যাপারে তুমি যদি নিশ্চিত হওÑআমি অবশ্য
নইÑকিভাবে কি ঘটলো জানাও আমাকে। তারপর বলো, আর কি বিষয়ে আলাপ
করতে চাও।’
শুরু থেকে যা যা ঘটেছে বলে গেল রানা। কেউ সাইডউইণ্ডার মিসাইল ছুঁড়ে
আকাশ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল ওকে। না থেমে দ্বিতীয় প্রসঙ্গে চলে এলো
ও, ফার্স্ট অফিসার রুবি বেকারের আচরণ সম্পর্কে জানালো। ‘সে বলছে,
পনেরোজন রেনকে ইনভিনসিবলে পাঠানো হবে বলে ঠিক হয়েছে। বলছে,
ব্যাপারটা সবাই নাকি জানে। আমি যাবো, তা-ও নাকি কারো অজানা নয়। ভেবে
দেখলাম আপনার সাথে আলোচনা করা জরুরী। সবাই যদি জানে, তাহলে এটা
আর গোপন অ্যাসাইনমেন্ট থাকলো কিভাবে?’
মারভিন লংফেলো কিছু বলছেন না দেখে আবার শুরু করলো রানা।
‘বোঝাই যাচ্ছে, বাস্ট-এর লোকজনও ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা।
তার মানে যে-কোন মুহূর্তে, চাইলেই, আমাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারে
তারা। সে চেষ্টা এরই মধ্যে একবার তারা করেছে।’
ঝাড়া এক মিনিট চুপ করে থাকলেন মারভিন লংফেলো, তারপর গলাটা
পরিষ্কার করলেন। ‘সবচেয়ে ভালো হয় ফার্স্ট অফিসার রুবি বেকারকে তালিকা
থেকে বাদ দিলে,’ গম্ভীর সুরে বললেন তিনি। ‘কিন্তু সে যদি লক্ষ্মীদের একজন না
হয়, আমাদের উচিত হবে তাকে তার ভূমিকায় থাকতে দেয়া, সেক্ষেত্রে তার ওপর
নজর রাখার সুযোগ পাবে তুমি। যদিও গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে ভারি
ইন্টারেস্টিং লাগছে, বিশেষ করে এটা দেখার পর।’ সতর্কতার সাথে একটা
ফাইল খুলে পিন দিয়ে আটকানো দু’পাতা কাগজ বের করলেন তিনি, বাড়িয়ে
দিলেন রানার দিকে।
স্ট্যাণ্ডার্ড মেইন্টেন্যান্স ফর্ম, রানার সী হ্যারিয়ার পরীক্ষা করার পর বিস্তারিত
রিপোর্ট লেখা হয়েছে। পড়ার সময় টেকনিক্যাল বিবরণগুলোর ওপর বিশেষ
মনোযোগ দিলো রানা। ত্র“টিপূর্ণ এক জোড়া ট্র্যান্সপণ্ডার-এর উলে−খ করা হয়েছে,
ওগুলো ইন্টারন্যাল ওয়ার্নিং সিস্টেমের অংশবিশেষ। দ্বিতীয় কাগজটার শেষ দিকে
সারমর্ম লেখা হয়েছেÑ
‘কোনো ধরনের দুর্ঘটনাবশত মিসাইল নিক্ষিপ্ত হবার আগেই সংশি−ষ্ট
হ্যারিয়ারের ট্র্যান্সপণ্ডারে গোলযোগ দেখা দেয়া সম্ভব বলে মনে হলেও, সামগ্রিক
পরিস্থিতি দৃষ্টে একথা ধরে নেয়াই যুক্তিযুক্ত যে বম্বিং রান-এর সময় বা তারও
আগে ত্র“টিটা দেখা দেয়। ওপরে উলে−খিত ট্র্যান্সপণ্ডারের একটা বা দুটোতেই,
ত্র“টি দেখা দেয়ার পর পাইলটরা প্রায়ই রিপোর্ট করে মিসাইল কাছে আসছে বা
তাদেরকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে। এলাকার কোনো পে−নে মিসাইল
ছিলো না, এটা মনে রাখলে আলোচ্য ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছে বলে ধরে নিতে
হয়।Ñরুবি বেকার (ফার্স্ট অফিসার রেনস)।
‘বুঝলাম না, মিস্টার লংফেলো। রুবি বেকার আমার সাথে একমত নয়,
কারণটা সে-ই ভালো জানে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, ট্র্যান্সপণ্ডার
কোনো গোলমাল করেনি। মিসাইল একটা সত্যি ছোঁড়া হয়েছিল, ব্যাপারটা মিথ্যে
প্রমাণ করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ফার্স্ট অফিসার রুবি বেকার। প্রশ্ন হলো,
কারণটা কি? সে কি নিজের পিঠ বাঁচাবার চেষ্টা করছে?’
রিপোর্টটা ফেরত নিয়ে তীক্ষèদৃষ্টিতে সরাসরি রানার দিকে তাকালেন মারভিন
লংফেলো। ‘তুমি, রানা, পুরোপুরিÑশতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত?’
‘যে-কোনো বাজি ধরতে রাজি আছি।’
মাথা ঝাঁকালেন মারভিন লংফেলো। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে রুবি বেকারকে
ইনভিনসিবল থেকে দূরে সরিয়ে রাখাটাই স্বাভাবিক হবে, কিন্তু আমি চাই
১৮
আয়োজনটা অপরিবর্তিত থাকুক। অন্তত সতর্ক হবার সুযোগ পেয়েছো তুমি।’
দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলো সুসান, হাসি মুখে বললো, ‘লাঞ্চের সময়
হয়েছে।’
‘রোববার হলেও, বেশি কিছু খাওয়াতে পারবো না তোমাকে, রানা,’ মারভিন
লংফেলো বললেন। ‘তবে, তোমার পছন্দ হবে বলে মনে হয়। তুমি আসছো শুনে
সুসান নিজের হাতে রান্না করেছে, তোমরা যাকে “ভ্যাট” বলো। সরষে বাটা দিয়ে
হিলসা। ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য রোস্ট বীফও আছে। আছে নতুন আলু আর
স্যালাড। চলবে তো?’
‘কিন্তু, মি. লংফেলো,’ চেহারায় বিব্রত একটা ভাব নিয়ে বললো রানা,
‘আমার তো খাবার কথা ছিলো না!’
‘সেটা সুসান জানে।’
দোরগোড়া থেকে সুসান বললো, ‘আমার কি দোষ। গ্রাণ্ডপা’র প্রিয় কেউ
এলে উনি তাকে না খাইয়ে ছাড়েন না। যেমন, জেমস বণ্ড। কে ওঁর প্রিয়, কে
নয়, আমি জানি বলেই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আয়োজনটা করেছি।’
‘ঠিক আছে, চলুন বসা যাক,’ মারভিন লংফেলোর দেখাদেখি চেয়ার ছাড়লো
রানা, তারপর বললো, ‘জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, বণ্ড কোথায় বলুন তো? সে
থাকতে আমাকেই বা কেন অ্যাসাইনমেন্টটা
...
?’
‘অসুস্থ। ওর ওপর দিয়ে গত ক’মাস বিরাট ধকল গেছে।’ রানাকে পাশ
কাটিয়ে দরজার দিকে দ্রুত এগোলেন মারভিন লংফেলো, বোঝা গেল এ-প্রসঙ্গে
আর কিছু বলতে চান না তিনি।
সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ ভালোই রেঁধেছে সুসান, তবে ঝাল হয়নি।
ভাতগুলোকে চাল বলাই ভালো, সেদ্ধ হয়নি। তবু যতোটুকু পারলো খেলো রানা,
ভদ্রতা বজায় রেখে সুসানের প্রশংসাও করলো।
আবার যখন একা হলো ওরা, কৌতূহলী মনের প্রশ্নটা ধীরে ধীরে উচ্চারণ
করলো রানা, ‘ইনভিনসিবলে পনেরোজন মেয়েকে পাঠানো হচ্ছে, কারণটা
বলবেন আমাকে? আমি নিজে কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, কিন্তু জানি ব্রিটিশ
নাবিকরা বিশ্বাস করে ন্যাভাল ভেসেলে মেয়েলোক মানেই ভাগ্যে খারাবি আছে।’
‘হ্যাঁ, জানি, নাবিকরা ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখে না। তোমার প্রশ্নটা
জটিল, রানা। জটিল এই অর্থে যে সব কথা এমনকি তোমাকেও এখনো জানানো
হয়নি। এখনি জানাবার সঠিক সময় কিনা তা-ও আমি বুঝতে পারছি না। অবশ্য
তুমি ইনভিনসিবলে ওঠার আগেই জানাবো বলে ভেবেছিলাম।’ কফির কাপে ঘন
ঘন চুমুক দিলেন তিনি। ‘আমার জানামতে রাশিয়ানরা কমপক্ষে একজন ফিমেল
অ্যাটাশে নিয়ে আসছে। কিন্তু পনেরোজন ব্রিটিশ রেন আর একজন রাশিয়ান
মেয়ে, সমান হলো কি?’
‘কি করে!’
‘কাজেই তোমাকে সব কথা এখুনি আমার জানাতে হয়। কিন্তু মনে রেখো,
তথ্যটা ক্লাসিফায়েড। এতোটাই ক্লাসিফায়েড যে আর কিছুর সাথে তুলনা চলে
না। অন্তত শান্তির সময়ে।’
একটানা আধ ঘণ্টা ধরে কথা বলে গেলেন বিএসএস চীফ মারভিন
লংফেলো। তাঁর কথা শুনে শুধু বিস্মিত নয়, অসম্ভব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো রানা।
আগামী কয়েক হপ্তা এই উদ্বেগ ওর পিছু ছাড়বে না।
সেদিনই সন্ধ্যা ছ’টায় ইয়োভিলটনে ফিরে এলো রানা, এবারও চেডার-এ
গাড়ি বদল করলো ও। গোটা অ্যাসাইনমেন্টটা সম্পর্কে এই প্রথম পরিষ্কার একটা
ধারণা পেয়েছে, উপলব্ধি করছে বাস্ট-এর সাথে ওর মোকাবিলাটা হবে জীবনের
সবচেয়ে কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধ। এরকম বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্ট আর কখনো
পায়নি রানা।
উইণ্ডসোর গেট পার্কে মারভিন লংফেলোর সাথে রানা যখন আলোচনা করছে, ঠিক
একই সময়ে প−াইমাউথ-এ মিটিং করছে আরো একদল লোক। একজন
এঞ্জিনিয়ার, পেটি অফিসার, চব্বিশ ঘণ্টার ছুটি পেয়ে একটা পাবলিক হাউসে লাঞ্চ
খেতে বসেছে। দিনটা রোববার, কাজেই লাঞ্চের আগে লোকজন একটু বেশি পান
করে, কিন্তু আলোচ্য ব্যক্তিটি নিজের স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়ালো না। খাওয়া-দাওয়া
সেরে যখন সে বেরিয়ে এলো, চেহারায় বেশ ফুর্তির ভাব লেগে রয়েছে।
ইতিমধ্যে দু’জন বন্ধু জুটেছে তার।
পেটি অফিসার প−াইমাউথে থাকে না, তবে আর সব নাবিকদের মতো শহরটা
তার ভালোই চেনা আছে। বন্দরে কোনো মেয়েমানুষ না থাকলে রোববারটা একা
একা লাগে। পেটি অফিসারের স্ত্রী লণ্ডনে চাকরি করে, কাজেই তার কথা ভেবে
কোনো লাভ নেই। বারে জোটা বন্ধু দু’জন সিভিলিয়ান, একজনের নাম মাইকেল
রবসন, তার ফার্ম টারবাইনের প্রয়োজনীয় পার্টস সরবরাহ করে, সেই সূত্রে পেটি
অফিসারের সাথে তার একটা মিল আছে। দ্বিতীয় লোকটার নাম বিল হ্যামণ্ড।
বিলও একটা কোম্পানীর প্রতিনিধি, তার কোম্পানী ফাইবার অপটিকস তৈরি
করে। মাইকেল আর বিল পুরনো বন্ধু, একই জায়গায় প্রায়ই দেখা হয় দু’জনের,
কাজ নিয়ে প−াইমাউথে আসলেই।
নতুন বন্ধুরা মেয়েমানুষ, মদ, জাহাজ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে
ভালোবাসে, কাজেই তাদেরকে পেটি অফিসারের মনে ধরলো। নতুন বন্ধুত্বের সূত্র
ধরে তাদেরকে লাঞ্চ খাওয়ানোর আমন্ত্রণ জানালো সে। ‘খাওয়া-দাওয়া সেরে
দেখি কোথাও কোনো কচি মাল পাওয়া যায় কিনা,’ নাবিকসুলভ অশ−ীল শব্দ
সহযোগে নিজের মনের চাহিদা প্রকাশ করলো সে। ‘প্রফেশন্যাল হোক আর
অ্যামেচার, কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।’
‘আরে, তাহলে তো তোমাকে আমরা সাহায্য করতে পারি,’ বললো
মাইকেল। ‘বিল আর আমি তো প্রায়ই এখানে রাত কাটাই। আমাদের দুর্বলতা বা
হবি, যাই বলো, কি হতে পারে কল্পনা করে নাও।’
পেট ভরে খেলো ওরা, আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে নাভির নিচেটা ছাড়া
অন্য কোনো প্রসঙ্গ প্রায় তুললোই না কেউ। ‘তোমার বউ যদি কোনো দিন
জানতে পারে, তখন কি করবে?’ পেটি অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো বিল।
‘ওরে সর্বনাশ! জানতে পারলে ডাণ্ডা মারবে মাথায়। ওর ভাইগুলো গুণ্ডাপাণ্ডা
১৯
ধরনের, লেলিয়ে দেবে আমার পিছনে। উঁহুঁ, কোনোভাবে জানতে দেয়া চলবে
না।’
তাকে ওরা একটা প্রাইভেট ক্লাবে নিয়ে গেল। দু’জনেই ওরা ক্লাবটার
সদস্য। অল্পবয়েসী কয়েকটা মেয়ে দেখানো হলো পেটি অফিসারকে, সবক’টা
পেশাদার হলেও দেখতে খারাপ নয়। এর আগে স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের
সাথে শোয়নি পেটি অফিসার, কাজেই ভয় এবং আগ্রহ দুটোই তার মধ্যে
মাথাচাড়া দিলো। নতুন বন্ধুরা অভয় দিলো তাকে, সাহস যোগালো। ‘অভ্যেস
নেই বলে অমন লাগছে। এরপর দেখবে আমাদের সাহায্য ছাড়াই এখানে এসে
বাছাবাছি করছো। এখন বলো, কোন্টা তোমার পছন্দ।’
মাইকেল থামতেই বিল বললো, ‘আর যদি খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে
থাকো, দু’তিনটে নিয়ে ঘরে ঢোকো। সব খরচা কিন্তু আমাদের, দোস্ত।’ গলা
ছেড়ে হেসে উঠলো সে।
স্বর্ণকেশী এক মেয়েকে পছন্দ করলো পেটি অফিসার, তার বয়স ষোলোর
বেশি হবে না, তবে যে-কোনো টিন-এজারের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ বলে
সুনাম আছে।
দু’মুখো আয়নার পিছনে লুকানো ছিলো ক্যামেরাটা। ছোট্ট এই প্রাইভেট
ক্লাবে প্রায়ই ওটা ব্যবহার করা হয়। মেয়েটার সাথে প্রায় ঘণ্টা দুই সময় কাটালো
পেটি অফিসার, বিদায় নেয়ার সময় জানালো, ‘ভারি তৃপ্তি বোধ করলাম।’
নতুন বন্ধুদের আমন্ত্রণে রাতে এক সাথে ডিনার খেলো পেটি অফিসার।
খেতে বসে আগামী রোববার কিভাবে কাটাবে তার প−্যান করলো ওরা। এরপর
আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। বড় আকারের ন্যাভাল টারবাইন এঞ্জিন সম্পর্কে
কথা বললো ওরা। প্রসঙ্গটা তুললো বিল।
ওরা জানে, ন্যাভাল টারবাইন এঞ্জিন সম্পর্কে পেটি অফিসার একজন
এক্সপার্ট।
পাঁচ
নভেম্বরের শেষ দিকে ‘হেলথ ডিপেণ্ডস অন স্ট্রেংথ’ আবার ধরা পড়লো লিসনিং
পোস্টে, কমপিউটার তার কাজ শুরু করলো, চব্বিশঘণ্টার মধ্যে প্রতিলিপিটা
পৌঁছে গেল বিএসএস চীফ মারভিন লংফেলোর ডেস্কে।
এবারও কথা বললো কেনেথ কালভিন আর ফারাজ লেবানন।
‘আপনি নিশ্চয়ই মনে করেন না নাবিক লোকটা, রানা, আমাদের এই জটিল
অপারেশনের জন্যে একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে?’ জিজ্ঞেস করলো কেনেথ
কালভিন।
‘আমি আমার শত্র“ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাই,’ ফারাজ লেবানন কথা বলছে
ফিসফিস করে। ‘রানাকে রয়্যাল নেভির সাধারণ একজন অফিসার মনে করার
কোনো কারণ নেই। তার ইতিহাস ও রেকর্ড সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর
আসছে। এমন হওয়া বিচিত্র নয়, ইনভিনসিবলে তাকে লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে
রাখা হতে পারে।’
‘সিলেকটেড বডিগার্ড সেকশনের লিডার?’
‘সম্ভবত।’
‘বোঝাই যায়, আপনি তাকে বিপজ্জনক হুমকি বলে ধরে নিয়েছেন, তা না
হলে তাকে এতো তাড়াতাড়ি সরাবার প−্যান করতেন না।’
‘ব্যাপারটাকে আমি মিলিটারি অপরচিউনিটি হিসেবে দেখি। সুযোগ একটা
ছিলো। কিন্তু সফল হইনি।’
দীর্ঘ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকলো কেনেথ কালভিন, তার-পর বললো,
‘শুনুন, ফারাজ, আমি চাই না অপারেশন লস-এর দ্বিতীয় পর্যায়টা ব্যর্থ হোক বা
কমপ্রোমাইজ করা হোক। আমাদের সংগঠন ব্রাদারহুড-এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
তো আছেই, কিন্তু তাছাড়াও আমার ব্যক্তিগত বিপুল টাকা ঢালা হয়েছে এর
মধ্যে। আমি যে গোটা ব্যাপারটা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে চাই তা
কখনো গোপন করার চেষ্টা করিনি। ব্রাদারহুড-এর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে
আমার, আমি জানি এই সংগঠনের দ্বারা বিশ্ব সমাজকে নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজানো
সম্ভব, দুনিয়ার সমস্ত অন্যায় আর শোষণ চিরতরে দূর করা যাবে, কিন্তু সেই সাথে
নিজের জন্যে আমি একটা সম্পদের পাহাড়ও গড়ে তুলতে চাই, কারণ তা না হলে
আমার সাধনার ফসল সংগঠনটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো যাবে না। কাজেই
আমি চাই কোনো রকম ঢিলেমি যেন না হয়, প−্যানের পরবর্তী পর্যায়টা যেন
চলবে... ।