৩৭
পর কিচেনে গিয়ে ঢুকলো। এক গাদা টমেটো, শসা, কাঁচামরিচ, পিঁয়াজ, পুদিনা
পাতা, গাজর, ইত্যাদি নিয়ে বসলো ও। কাজ করছে, তবে সমস্যাটা মাথা থেকে
নামছে না। মন্টেরা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে ব্যাপারটাকে। কাছে পিঠে রুবি
বেকারের উপস্থিতি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তাকে।
রানার মন বলছে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ভিলা কাপ্রি-সিয়ানিতে।
সাংঘাতিক কিছু একটা।
ক্রিসমাস ঈভের ছুটিতে বাড়িতে থাকলেও, রানার কথা ভেবে প্রায় সারাক্ষণই
উদ্বেগের মধ্যে আছেন মারভিন লংফেলো। অতিরিক্ত, নিরাপদ একটা টেলিফোন
লাইন বসানো হয়েছে বাড়িতে, রানা ও ভিলা কাপ্রিসিয়ানি সংক্রান্ত যে-কোনো
গুরুত্বপূর্ণ খবর হেড-কোয়ার্টারে পৌঁছুনোর কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তিনিও যাতে
জানতে পারেন।
কলটা যখন এলো, ফোনের কাছাকাছিই ছিলেন তিনি। রিসি-ভারটা ছোঁ
দিয়ে তুলে নিলেন। সংক্ষেপে বললেন, ‘এম!’
নিরাপদ লাইনের অপরপ্রান্তে রয়েছে জন মিচেল। ‘একটা ঘটনা ঘটেছে,
স্যার।’
মাথা ঝাঁকালেন মারভিন লংফেলো, কথা বললেন না।
এক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে আবার বললো মিচেল, ‘আজ দু’বার যোগাযোগ
হয়। প্রথমে সাধারণ সাইফার বদল। তারপর আরেক-বার। আ ফ্ল্যাশ, স্যার।’
‘সিরিয়াস?’
‘নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, স্যার। ড্রাগনটূথের একটা রিপোর্ট ওটা। মনে
হচ্ছে দ্য ক্যাট অথবা তার কোনো সহকর্মী, ওখানে হাজির হয়েছে, ঘুর ঘুর করছে
আশপাশে। জানতে চাওয়া হয়েছে, তাকে ধরার চেষ্টা করা হবে, নাকি সে কি
করে দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।’
‘তার টিম কতো বড় কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি?’
‘বলা অসম্ভব, স্যার। তিনজন হতে পারে, সম্ভবত আরো বেশি। টিমের
একজন আহত হয়েছে, আগেই জেনেছি আমরা।’
কানে রিসিভার নিয়ে ধীরে ধীরে সোফায় বসলেন বিএসএস চীফ! ঝাড়া বিশ
সেকেণ্ড চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘নিরেট ইনফরমেশন দরকার
আমাদের, চীফ অভ স্টাফ। পেরেকের মতো কঠিন। তবে, উদ্দেশ্য যদি পূরণ
হয়, ড্রাগনটূথকে বলো চরম নিষ্ঠুর হতে। ইটালিয়ানদের সাথে আমাদের চুক্তি
এখনো বহাল আছে তো?’
‘ওদিকে কোনো সমস্যা নেই, স্যার।’
‘গুড। প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতে হবে। আরেকটা নির্দেশ আছে...।’ জন
মিচেলের উদ্দেশ্যে দশ মিনিট কথা বললেন মারভিন লংফেলো, বিশদভাবে ব্যাখ্যা
করলেন নির্দেশটা। তারপর তীক্ষè-কণ্ঠে, ‘পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবে আমাকে,’
বলে ক্রেডলে রেখে দিলেন রিসিভার। চোখ বুজে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন
বিএসএস চীফ। ভাবছেন, বিদেশী এক যুবক, তার জন্যে এতো কেন উদ্বেগ বোধ
করেন তিনি, কেন এতোটা কাতর হয়ে পড়েন? তার মনে বিরাট একটা জায়গা
দখল করে নিয়েছে এই ছোকরা, কারণটা কি? তাঁর কোনো পুত্রসন্তান নেই, তবে
কি যে পুত্রসন্তানের অভাব চিরকাল অনুভব করে এসেছেন তার প্রতিচ্ছবি দেখতে
পান তিনি রানার মধ্যে? নাকি সব কিছু মিলিয়ে এমন এক চরিত্র রানা, যাকে
ভালো না লেগে পারে না? গাড়ির শব্দে সংবিৎ ফিরলো তাঁর। চোখ মেলে
জানালার দিকে তাকালেন। তাঁর মেয়ে-জামাই এসে পৌঁছুলো। রানার কথা মন
থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে সোফা ছাড়লেন বৃদ্ধ, হাসিমুখে এগোলেন দরজার
দিকে।
ক্রিসমাস ট্রি-টা সস্তাদরের রঙচঙে জিনিস দিয়ে সাজালো মন্টেরা, নিজের পছন্দ
মতো শহর থেকে কিনে এনেছে সে। কাল ডিনারের জন্যে রান্নার কাজও সেরে
ফেললো সে। দু’জনের মতো সুপ আর হালকা খাবার তৈরি করে খেয়ে নিয়েছে
আগেই, এই মুহূর্তে অলস সময় কাটাচ্ছে।
ইজি চেয়ারে লম্বা হয়ে আছে রানা। ওর পায়ে হেলান দিয়ে, মেঝেতে বসে
বিশ্রাম নিচ্ছে মন্টেরা, রানার হাত তার খোলা কাঁধে নড়াচড়া করছে। মাঝে মধ্যে
কাঁধ বেয়ে নেমে আসছে হাতটা, বেশ অনেকটা।
লণ্ডনের সাথে মন্টেরার যোগাযোগ সম্পর্কে এতোক্ষণ কোনো প্রশ্ন করেনি
রানা। এখন মনে হলো, সময় হয়েছে। ‘কি প্রতিক্রিয়া হলো ওদের?’ জানতে
চাইলো ও।
‘কাদের?’
‘কাছে পিঠে রুবি বেকারকে দেখা গেছে শুনে কি বললো লণ্ডন?’
শরীরটা মোচড়ালো মন্টেরা, রানার দিকে যাতে তাকাতে পারে। ‘তোমার না
জানাই ভালো। সমস্ত দিক সামলানো হবে, রানা। গোটা ব্যাপারটা আমাদের
নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালো রানা, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো, এ-ধরনের
পরিস্থিতি ওর কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ‘সাধারণত প্রোটেকশন দেয়ার দায়িত্বটা আমিই
পালন করি, নির্দেশ যা দেয়ার সবসময় আমিই দিই।’
‘বেশ তো,’ খসখসে গলায় বললো মন্টেরা, কাল রাতে ও আজ সকালে তার
গলার এই খসখসে ভাবটার সাথে পরিচয় হয়েছে রানার। ‘বেশ তো, রানা, দু’
একটা নির্দেশ তুমিও তো আমাকে দিতে পারো। অন্তত একটা নির্দেশের
অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছি আমি, তুমি বুঝতে পারো না?’
‘কি জানি, ধরতে পারিনি। বয়স যা-ই হোক, তোমাকে আমার খুব জাঁদরেল
মেয়ে বলে মনে হয়েছে। এমনকি...
।’
‘এমনকি বিছানাতেও? আমি জানি। তবে চাইলেই যে-কোনো ভূমিকা নিতে
পারি আমি। পরীক্ষা করে দেখবে নাকি?’
‘খানিক পর।’ গলা শুনে মনে হলো ভারি রিল্যাক্স বোধ করছে রানা।
‘জানো, মন্টেরা, বয়স বাড়ার পর কোনো ধর্মীয় উৎসবের প্রতি আমার কোনো
আকর্ষণ নেই। তবু বলবো, উৎসবটা তোমাদের হলেও, নিজেকে আমার আজ খুব
৩৮
ভাগ্যবান আর সুখী লাগছে। সম্ভবত পাশে একজন আদর্শ গার্লফ্রেণ্ড আছে, সেটাই
কারণ।’
নিজের কাঁধ থেকে রানার হাত দুটো নামালো মন্টেরা, কিন্তু ছাড়লো না।
রানার আঙুলগুলো মুখের কাছে তুলে গন্ধ শুঁকলো সে, চোখ বুজলো আবেশে।
তারপর প্রতিটি আঙুলে চুমো খেলো। সবশেষে বললো, ‘তোমাদের কোনো উৎসব
সম্পর্কে বলো আমাকে, রানা। স্মরণীয় কোনো উৎসবের কথা মনে পড়ে?’
‘পড়ে,’ বলে আড়মোড়া ভাঙলো রানা, লম্বা করা পা দুটো টান টান করলো।
‘ছোটোবেলার কথা। ঈদ,’ থেমে থেমে উচ্চারণ করছে রানা, যেন কাহিনীটা
ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। ‘গ্রামের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষ্যে বেড়াতে গেছি। অদ্ভুতই
বলবো, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় পরব।’ হেসে উঠলো রানা।
‘অদ্ভুত বলছি এই জন্যে যে সেবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিকেন পক্স, বুঝলে।
ঈদের ক’দিন আগেই অসুখ দেখা দেয়, মাত্র ভালো হয়ে উঠছি।’
‘স্মরণীয় কেন?’
হেসে উঠলো রানা, যেন স্কুলছাত্র। ‘বাবার কাছে যা যা আবদার করলাম, সব
তিনি কিনে দিলেন। শহর থেকে একটা এয়ারগানও কিনে আনা হলো।’
‘আর কি? শুধু এয়ারগান পেয়েছিলে বলে?’
‘বিছানা ছেড়ে উঠতে দেয়া হলো না আমাকে। তবে বাবা জানালাটা খুলে
দিলেন, কার্নিশে একটা টিনের কৌটা রেখে বললেন, টার্গেট প্রাকটিস করো। মাত্র
আধঘণ্টার জন্যে সুযোগটা দেয়া হলো আমাকে। সন্ধ্যায়, মা-বাবাকে লুকিয়ে,
আমার বন্ধু আতিক এলো আমাকে দেখতে। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম
আমি। ওকে দেখে আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার বাবা ঘরে
ঢুকে তিরস্কার করলেন আতিককে, বললেন ছোঁয়াচে অসুখ, সে না এলেই ভালো
করতো। কিন্তু আতিক ভয় পেলো না, কৌটোয় করে লুকিয়ে আনা সিমাই আর
ফিরনি খাওয়ালো আমাকে নিজের হাতে। সে ঘটনা ভোলার নয়। আতিক
আমাকে এতো ভালোবাসতো, আগে কখনো বুঝিনি।’ মাথা নাড়লো রানা।
‘কোনো দিন ভুলবো না। আগেও বুঝিনি, সেদিনের পরেও আর বোঝার সুযোগ
হয়নি।’ মাথা নাড়লো রানা। ‘না। কোনো দিন ভুলবো না।’
‘সেদিনের পরে মানে?’
‘আমার বন্ধু পরদিন পুকুরে ডুবে মারা যায়।’
ভাষা হারিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো মন্টেরা। রানাকে দু’হাতে শক্ত করে
আঁকড়ে ধরলো সে। তার চোখ দুটো মুছিয়ে দিলো রানা, বিড়বিড় করে বললো,
‘বহুকাল আগের কথা, মন্টেরা। এবার তোমার পালা। তোমার স্মরণীয় ক্রিসমাস
সম্পর্কে বলো।’
মোচড় খেয়ে রানার দিকে পুরোপুরি ফিরলো মন্টেরা, ওকে টেনে চেয়ার
থেকে মেঝেতে নামালো, নিজের পাশে। ‘এবারের ক্রিসমাস। কোনো ক্রিসমাসই
বড় কিছু নিয়ে আসেনি আমার জন্যে, আজকেরটা বাদে। গোটা ব্যাপারটা ভারি
অদ্ভুত লাগছে আমার। দ্রুত, যেন চোখের পলক ফেলার আগেই, কি সব আশ্চর্য
কাণ্ড ঘটে গেল। আমি যেন গেঁথে গেলাম তোমার সাথে। সত্যি বিশ্বাস করতে
পারছি না। আগে তো কোনো পুরুষকে দেখে এরকম অস্থিরতা বা ভাবাবেগে
আক্রান্ত হইনি আমি!’
পকেট হাতড়ে প্যাকেট করা উপহারটা বের করলো রানা। ‘মেরি ক্রিসমাস,
মন্টেরা।’
প্যাকেট খুলে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মন্টেরার। ‘মাই গড!’ প্রায় আঁতকে
উঠলো সে।
‘পছন্দ হয়েছে তোমার?’
‘ভালো করে চিনলে না জানলে না,’ মন্টেরার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে,
‘একেবারে হৃদয় দিয়ে বসলে?’
পরে, বেডরুমের গাঢ় অন্ধকারে, আনন্দঘন এক মুহূর্তে, ফিসফিস করলো
মন্টেরা, ‘মেরি ক্রিসমাস, রানা ডার্লিং।’
কিছু না ভেবেই জবাব দিলো রানা, ‘সবাই সুখী হোক।’
টেরেল, তাদানো আর ওদের কুকুরটা নিজেদের দায়িত্ব নিশ্চয়ই ঠিকমতো
পালন করেছে। শান্তিময় তৃপ্তিভরা রাতটায় অকস্মাৎ এমন কিছু ঘটলো না যাতে
পরস্পরের আলিঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় ওদের দু’জনকে। ক্লান্ত হয়ে এক
সময় ঘুমিয়ে পড়লো ওরা, কেউ ওদের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো না।
সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে জেগে দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো
মন্টেরা, বেশিরভাগ সময় কিচেনে কাটালো, খাবার তৈরির কাজে। নাইন এমএম
ব্রাউনিং পিস্তলটা কোমরে গোঁজা থাকলেও, মোটেও বেমানান লাগলো না।
রানাকে বিছানা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামালো সে, বললো, ‘টেবিলে খাবার
দেয়া হয়েছে। খেতে বসে যদি দেখি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, একটা কিলও মাটিতে
পড়বে না।’
খাওয়া শেষ করে মস্ত একটা হাই তুললো রানা। ‘মনে হচ্ছে এক হপ্তা
ঘুমাতে পারবো।’
‘জ্বী-না, সেটি হচ্ছে না।’ চেয়ার ছাড়লো মন্টেরা। ‘দ্বীপের আরেক প্রান্তে
নিয়ে যাচ্ছো তুমি আমাকে। এতো বেশি খেয়ে ফেলেছি, সাগরের তীরে হাঁটাহাঁটি
না করলে হজম হবে না। এসো।’ দ্রুত পায়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে,
ছোঁ দিয়ে চাবি তুলে নিয়ে ¯−াইডিং কবাট খুললো। ‘এসো, দেখি, কে কার আগে
গাড়ির কাছে পৌঁছুতে পারে!’ বলেই দরজার দিকে ছুটলো সে।
ব্রাউনিংটা তুলে নিলো রানা, কক করলো, গুঁজে রাখলো শোল্ডার-
হোলস্টারে। দেখে নিলো গাড়ির চাবিটা পকেটে আছে কিনা। তারপর মন্টেরাকে
ধরার জন্যে ছুটলো।
মন্টেরা ভেতরের গেটের তালা খুলেছে মাত্র, গেটটার দিকে নেমে যাওয়া
ধাপগুলোর মাথায় এসে দাঁড়ালো রানা। ‘থামো! আমার জন্যে অপেক্ষা করো!’
ডাকলো ও, হাসছে।
রানা তার পিছু ধাওয়া করেছে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মন্টেরা,
দৌড় দিলো গাড়ির দিকে। আচমকা বুকের ভেতর রানার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে
উঠলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত। সামনের
৩৯
মেইন গেট খোলা, হাঁ হাঁ করছে। ‘না!’ চিৎকার করলো ও, গলার সব ক’টা রগ
ফুলে উঠলো। ‘না! মন্টেরা!’ দেখলো, ফিয়াটের দরজা খুলছে মন্টেরা, হাতল ধরে
টান দিচ্ছে। চোখ আর মাথা থেকে যে কথাটা বলা হচ্ছে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে
করছে না রানার। ‘মন্টেরা, না! না-না! খুলো না
...
!’
কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে গেল। দরজাটা খুলছে, মুখ তুলে রানার দিকে
তাকালো মন্টেরা, মিষ্টি উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে মুখ, পরিতৃপ্ত পরম
সুখী একটা মেয়ে। পরমুহূর্তে ফিয়াটের ভেতর থেকে বিশাল একটা আগুনের বল
উথলে উঠলো। বিস্ফোরণের ধাক্কাটা এক মুহূর্ত পর লাগলো, পিছন দিকে ছিটকে
পড়লো রানা, তালা লেগে গেল কানে, বিধ্বস্ত ফিয়াট থেকে আগুনের শিখা
লাফিয়ে উঠে ঝলসে দিলো চোখ দুটো।
পিস্তলটা বের করার চেষ্টা করলো রানা, কিন্তু পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো
ওকে কে যেন।
তারপর সব কিছু যেন স্বপেèর ভেতর ঘটতে শুরু করলো। যেন আরেকটা
জীবনে প্রবেশ করেছে রানা। সবই দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু পুরোপুরি সচেতন নয়।
কয়েকটা গাড়ি এলো, এলো লোকজন। কেউ ইউনিফর্ম পরা, কেউ সাদা
পোশাকে। কে যেন ছুটে ভিলার পিছন দিকে চলে গেল, কানে তালা লাগলেও
রানার মনে হলো ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আর তারপর গুলির শব্দ শুনতে পেলো সে,
বাগানের দিক থেকে ভেসে এলো।
ভিলার পিছন দিকে কখন কিভাবে পৌঁছুলো বলতে পারবে না রানা, টেবিলে
ক্রিসমাস ভোজের অবশিষ্ট এখনো পড়ে রয়েছে। ¯−াইডিং দরজা দিয়ে পরিচিত
একটা মূর্তি ঢুকলো ভেতরে।
‘ড্রাগনটূথ, ক্যাপটেন রানা,’ রুবি বেকার বললো। ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু
এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না, এটাও ব্যর্থ হতে যাচ্ছিলো। আপনি আমার
কথা শুনতে পাচ্ছেন, স্যার? ড্রাগনটূথ।’
মুখ তুলে তাকাবার জন্যে সাহস সঞ্চয় করতে হলো রানাকে। ঘৃণায় কুঁচকে
উঠলো ওর চেহারা। যখন তাকালো, সারা শরীর কাঁপছে ওর। তারপর, যেন
প্রচণ্ড আতঙ্কে, চেয়ারের পিছন দিকে সরে যাবার চেষ্টা করলো ও, কুঁকড়ে ছোটো
হয়ে গেল শরীর, যেন রুবি বেকারের কাছ থেকে পালাতে চাইছে।
নয়
দগ্ধ ও বিবর্ণ ফিয়াটের চারপাশে দমকল বাহিনীর লোকজন, অ্যামবুলেন্স কর্মী
আর পুলিসকে দেখেছে রানা, তবু এ-সবের অর্থ বা তাৎপর্য পুরোপুরি বোধগম্য
হয়নি ওর। অস্পষ্টভাবে, মনের কোনো এক গভীর কোণে, উপলব্ধি করতে
পারছে প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয়ের শিকার সে। কিন্তু যতোবারই রুবি বেকারের
দিকে তাকালো, আশা করলো তার জায়গায় দেখতে পাবে ক্লডিয়া মন্টেরাকে।
মেয়েটা মারা গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না ও, কথাটা রুবি বেকার হাজার বার
উচ্চারণ করলেও। ওর কানে যে তালা লেগে গেছে, বুঝতে পেরেছে রুবি, তাই
ওর কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে চিৎকার করতে হয়েছে তাকে।
‘মেয়েটা হয় “বিড়াল” ছিলো, নয়তো বিড়ালের ঘনিষ্ঠ সহকারী,’ একই কথা
বারবার বললো রুবি, রানার মনে হলো ওর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
সাদা পোশাক পরা এক লোক ঢুকলো ঘরে, রুবির কানে কানে কি যেন
বললো সে। উত্তরে রুবিও ফিসফিস করলো। এর আগেও কয়েক বার ঘরে
ঢুকেছে লোকটা। রুবি বলছে, শুনতে পেলো রানা, ‘এম. যাদেরকে এখানে
পাঠিয়েছিলেন, তারা বিশ্বস্ত জেনেই পাঠিয়েছিলেন। আমাদের এক লোক ধরে
ফেলে, তাদের বদলে অন্য লোক কাজ করছে এখানে। ব্যাপারটা ধরা পড়ে
তাদানো নামে লোকটাকে বাগানে কাজ করতে দেখার সময়। তখনই পুরোপুরি
সতর্ক হই আমরা। পরিস্থিতি সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত ছিলো না।’ রানার দিকে
তাকিয়ে আছে সে। ‘এই অবস্থা চলে মেয়েটার সাথে কাল আমি তোমাকে দেখার
আগে পর্যন্ত।’
ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দিয়ে আরো দু’জন লোক ঢুকলো, কথা বললো রুবির সাথে।
রানার দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকালো রুবি, তারপর চোখ সরিয়ে নিলো। লোক
দু’জন চলে যাবার পর রানাকে বললো সে, বিষণœ সুরে, মেয়েটার যে-দু’জন
সহকারী ভিলায় কাজ করছিল, বন্দুক-যুদ্ধে মারা গেছে তারা। ‘আমাকে নির্দেশ
দেয়া হয়েছে, চরম নিষ্ঠুর হতে হবে, তবু আমরা চেষ্টা করেছি টিমের অন্তত একটা
লোককে যেন জ্যান্ত ধরতে পারি। দুর্ভাগ্য, পারা গেল না। আরো একটা দুর্ভাগ্য,
হ্যাঁ, দুর্ভাগ্যই বলবো, জানতে পারলাম না মন্টেরা মেয়েটা আসলেই বিড়াল
কিনা
...
,’ চেহারায় বিব্রত ভাব দেখা গেল। ‘
...
এখনো বুঝতে পারছি না, নিশ্চিত
হবার কোনো উপায় সত্যি আছে কিনা। বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটাই খেয়েছে সে।
বলা যায় কিছুই তার অবশিষ্ট নেইÑবা যে-টুকু আছে তা সনাক্ত করার জন্যে যথেষ্ট
নয়। দুঃখিত।’ রানার মনে হলো, রুবি বেকার যেন ক্ষমাপ্রার্থনা করছে।
চেয়ারে চুপচাপ বসে রয়েছে রানা, তাকিয়ে আছে সিলিঙের দিকে, যেন
রুবির কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। বিড়বিড় করে একবার বললো, যেন একটা
রোবট, ‘প্রতিদিনের কোড বলেছে আমাকে সে, ভুল করেনি একবারও।’
‘টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা ছিলো, বড় ভিলাটায় বসে সবই ওরা
জেনে ফেলে।’ রুবি ধূসর রঙের স্কার্ট পরে রয়েছে, গায়ে সোয়েটার, পায়ে আঁটো
করে ফিতে বাঁধা জুতো। সে বুঝতে পারছে, আশপাশের জগৎ থেকে অনেক দূরে
রয়েছে রানা। ‘ক্যাপটেন রানা? রানা? স্যার?’ আবার রানাকে সচেতন করার চেষ্টা
করলো সে। কিন্তু নড়লো না রানা, আগের মতোই তাকিয়ে থাকলো সিলিঙের
দিকে।
কিচেনে কে যেন রেডিও অন করলো। বিঙ কসবি গেয়ে উঠলেন, হ্যাভ
ইওরসেলফ আ মেরি ক্রিসমাস। রুবি দেখলো, মাথাটা এক দিকে কাত হয়ে গেল
রানার, যেন শোনার চেষ্টা করছে।
‘বন্ধ করো ওটা, ইউ ক্লাউন!’ ধমকে উঠলো রুবি বেকার, তারপর রানার
৪০
দিকে ফিরলো। ‘রেগুলার স্টাফ আর ওয়াচারদের পাওয়া গেছে, যাদেরকে
আমাদের লোকেরা দায়িত্ব দিয়েছিল। ভাগ্যই বলতে হবে যে বেঁচে আছে
ওরাÑওয়াইন সেলারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, মুখে কাপড় গোঁজা।
ওদের কাছ থেকে আমাদের লোকেরা রিপোর্ট আর চেহারার বর্ণনা পেলে আরো
অনেক কথা জানতে পারবো আমরা। এখন, এখান থেকে আপনাকে আমার বের
করতে হবে, স্যার। আমার কথা বুঝতে পারছেন তো, ক্যাপটেন রানা? আপনাকে
তো ডিব্রিফ করা দরকার আমাদের।’
এক সময় মাথা ঝাঁকালো রানা, ধীরে ধীরে, যেন সাধারণ বুদ্ধি ফিরে পাচ্ছে
ও। ওর মাথার ভেতর, কেউ জোরে কথা বললে বা কিছু ফেলে দিলে,
বিস্ফোরণের শব্দটা আবার অনুভব করছে ও, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওর দিকে
ফিরে হাসছে মন্টেরা, ফিয়াটের দরজা ধরে টানছে, পরমুহূর্তে বিস্ফোরণের
মাঝখানে ঢাকা পড়ে গেল। কানের ভেতর শোঁ শোঁ একটা আওয়াজ পাচ্ছে রানা,
যেন স্থায়ী হয়ে গেছে ওটা। চোখ নামিয়ে রুবি বেকারের দিকে তাকালো ও।
‘আমি, ব্যক্তিগতভাবে, মারভিন লংফেলোর সাথে কথা বলতে চাই,’ ঠাণ্ডা নিস্তেজ
কণ্ঠে বললো ও।
‘এখুনি নয়, রানা
...
ইয়ে, স্যার। এখুনি নয়। প্রথমে আপনাকে আমাদের
সরিয়ে নিতে হবে। কাজটা বিপজ্জনক, অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। এম. নির্দেশ
দিয়েছেন, ডীপ কাভারে থাকতে হবে আপনাকে। এটা একান্ত প্রয়োজন।
আপনাকে আমরা লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে দেবো, ইনভিনসিবলে ওঠার সময়
আপনি যাতে নতুন করে উদয় হতে পারেন। আর এক হপ্তা পর।’
রানার মাথা দোলাবার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, বুঝতে পেরেছে। যদিও ওর
পরবর্তী প্রশ্নটা উল্টোটাই প্রমাণ করলো। ‘সে যদি বাস্ট-এর সদস্য হয়, কি
ঘটলো? ওরা কি তাহলে তাকে ভুল করে মারলো?’
‘পরে, স্যার। পি−জ। এখানে আপনার থাকাটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক।
আমাদের হেলিকপ্টার আপনাকে নিতে আসছে। মেইনল্যাণ্ডে নিরাপদ বেস আছে
আমাদের, সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে আপনাকে। ওখানে একটা ডিব্রিফিং টিম
অপেক্ষা করছে, তাদের সাথে ভালো ডাক্তারও আছেনÑযদি আপনার চিকিৎসা
দরকার হয়...
।’
‘আমার চিকিৎসার দরকার নেই, ফার্স্ট অফিসার রুবি বেকার।’
‘উইথ রেসপেক্ট, স্যার, অন্তত একবার ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করানো
দরকার আপনাকে।’ হেলিকপ্টারের শব্দ হলো, ভিলার ওপর চক্কর দিচ্ছে।
‘পিস্তলটা আমি নিই, স্যার?’ প্রশ্ন করলো মোটাসোটা, শক্ত-সমর্থ এক
লোক।
‘আমি বেঁচে থাকতে নয়!’ এবার সত্যি সত্যি রেগে উঠলো রানা। ‘আমি শিশু
নই, বোকার মতো কিছু করতে যাচ্ছি না।’ চোখ গরম করে চারদিকে তাকালো
ও। ‘আমরা তাহলে অপেক্ষা করছি কেন? চলো।’
বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ভিলার মাথার ওপর পুরনো একটা অগাস্টা
চপার দেখলো রানা, নেমে আসছে। চপারের গায়ে ইটালিয়ান নেভির মার্কিং।
রুবি বেকারের একজন লোক হাত তুলে ইশারা করলো, হ্যারনেস সহ
একজন ক্রুকে নামানো হলো চপার থেকে, তারপর রানাকে তোলা হলো।
হেলিকপ্টার ঘুরছে, যাবে উপকূলের দিকে, শেষ বারের মতো দোমড়ানো-
মোচড়ানো পোড়া কালো ফিয়াটটা দেখতে পেলো রানা। রাস্তার দুই দিকে
ব্যারিকেড তুলে টহল দিচ্ছে পুলিস।
এক ঘণ্টা পর ক্যাসার্টার কাছাকাছি ছোটো একটা সামরিক ঘাঁটিতে পৌঁছুলো
রানা। আকাশ থেকে ঘাঁটিটাকে সামরিক বলে মনেই হলো না। ছয়-সাতটা
বিল্ডিং, সিকিউরিটি পেরিমিটার দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়াও
আছে। গেটের গার্ডরা সশস্ত্র হলেও, ইউনিফর্ম পরা নয়।
বড়সড় একটা কামরা দেয়া হলো রানাকে, প্রচুর বাতাস ঢোকে, তবে আরাম-
আয়েশের আয়োজন যথেষ্ট নয়। টেলিফোন বা টিভি নেই, বাথরুমটা ছোটো,
চোখ জুড়ানো কোনো প্রিন্ট বা ফটো নেই দেয়ালে। কিভাবে যেন ওর কেসটা
গোছগাছ করে আনা হয়েছে ভিলা থেকে, দরজার পাশে পেলো সেটা রানা।
বিছানায় শুয়ে পা দুটো টান টান করলো ও, ব্রাউনিংটা নাগালের মধ্যে রাখলো।
অন্তত অস্ত্রটা কেড়ে নেয়নি ওরা। টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটা পেপারব্যাক
পড়ে রয়েছেÑতার মধ্যে তিনটে থ্রিলার। একটা উইলবার স্মিথের, একটা
ফরসাইথের, শেষটা গ্রাহাম গ্রীনের। বাকি বইগুলোর মধ্যে জেমস জয়েসের
ইউলিসিস আর টলস্টয়ের ওঅর অ্যাণ্ড পীস-ও দেখলো রানা। নিজের মানসিক
অবস্থা সম্পর্কে সচেতন রানা, জানে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে মনটাকে অন্য
কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে কিছুক্ষণ, কিন্তু বইগুলো ওকে কোনো সাহায্য
করতে পারবে বলে মনে হলো না। কারণ, প্রায় সব ক’টা বইই পড়া আছে ওর।
তাছাড়া, প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছে, পড়ায় মন দেয়ার মতো মানসিকতাও নেই।
তবু অচেনা লেখকের একটা বই তুলে নিয়ে চোখ বুলালো রানা। ঘুম আসবে না
জানে।
পড়তে পড়তে কখন যেন আবার নিকট অতীতের স্মৃতি ফিরে এলো মনে।
ফিয়াটটা দেখতে পেলো রানা। সিঁড়ির ধাপে রয়েছে ও। লোহার গেটটা খোলা,
হাঁ-হাঁ করছে। মিষ্টি হাসি ভরা উদ্ভাসিত চেহারা মন্টেরার, ফিয়াটের দরজা
খুলছে। তারপর আগুনের বলটা ঢেকে ফেললো তাকে। উঁহুঁ, স্মৃতি তাকে নিয়ে
খেলছে। সত্যিই কি তাই? দৃশ্যটা ঠিক এরকম ছিলো কি? উঁহুঁ, না। রানার দিকে
ফিরে হাসছিল মন্টেরা, খালি হাতটা নাড়ছিল। তারপর কি? বিস্ফোরণের ধাক্কায়
পিছন দিকে ছিটকে পড়লো ও? না, আরো কি যেন ঘটেছে। নতুন করে স্মরণ
করার চেষ্টা করলো রানা।
হাসতে হাসতে ফিয়াটের দরজা খুলছে মন্টেরা। ধোঁয়া। আগুনের বলটার
সাথে প্রচুর ধোঁয়া ছিলো। কি ধরনের বোমা ব্যবহার করলো ওরা, এতো ধোঁয়া
হলো কেন? সেমটেক্স বা আরডিএক্স হলে এতো ধোঁয়া বেরুবার কথা নয়। এই
ব্যাপারটা অবশ্যই রিপোর্ট করতে হবে ওকে। এমন হতে পারে, ইদানীং
টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনগুলো নতুন ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করছে। সে যাই
হোক, বিস্ফোরণের সাথে সাথে টেরোরিস্ট সম্রাজ্ঞী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
৪১
দরজায় নক হলো। ‘কাম,’ বললো রানা, এক হাতে ব্রাউনিং-এর সেফটি
অফ করলো, দরজার দিকে তাক করলো অস্ত্রটা।
লোকটা লম্বা, ¯−্যাকস আর সোয়েটার পরে আছে। গায়ের রঙে গাঢ় একটা
ভাব চোখ এড়ালো না রানার, মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখা যায় এরকম।
তবে লোকটার গলায় বিশুদ্ধ অক্সফোর্ড ইংলিশ।
‘ক্যাপটেন রানা?’ জানতে চাইলো সে।
মাথা ঝাঁকালো রানা।
‘আমি মারিয়ো।’ চলি−শের মতো বয়স হবে, হাবভাবে সামরিক সতর্কতা
আনার চেষ্টা রয়েছে, যেন বুঝিয়ে দিতে চায় সিভিলিয়ান নয় সে। হাসলো
লোকটা, কিন্তু তাতে কোমলতার বা খুশির কোনো ভাব ফুটলো না। ‘মারিয়ো
মন্তাজ, যদিও বন্ধুরা আমাকে টমেটো মন্তাজ বলে ডাকে। শব্দ নিয়ে চাতুরি,
বুঝলেন না! টমেটো মন্তাজ। হে-হে।’
‘কি ঘটছে এখানে?’ ভাবলেশহীন সুরে জিজ্ঞেস করলো রানা।
‘ডাক্তার ভদ্রলোকেরা আপনাকে একবার পরীক্ষা করবেন। আমি শুধু জানতে
এসেছি আপনি সুস্থ বোধ করছেন কিনা। মানে, ডাক্তারী পরীক্ষার জন্যে আপনি
রেডি কিনা।’
‘আসলে তুমি কে, মন্তাজ? আমি কোথায়; তুমি কোথায়, এখানে আসলে কি
ঘটছে?’
‘বেশ, আমি হলাম সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড।’
‘কিসের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড?’
‘এটার,’ বলে জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে বাইরেটা দেখালো মারিয়ো মন্ত
াজ।
‘এটা কি?’
‘কেন, কেউ আপনাকে বলেনি?’
‘বললে তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না।’
‘ও, হ্যাঁ, ঠিক। আমরা আসলে কিছুটা অনিয়মিত।’
‘ইররেগুলার? কি রকম ইররেগুলার?’
‘ন্যাটোর অধীনে, ঠিক? হাইলি ক্লাসিফায়েড, বলতে পারেন। ভেরি হাইলি
ক্লাসিফায়েড। কোনো বই বা খাতাতেও আমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না, ঠিক?’
‘বলে যান!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রানা। হিপ্পি সহ্য করা যায়, কিন্তু সামরিক
হিপ্পি অসহ্য।
‘সিও আমেরিকান, ঠিক?’
‘কিসের সিও?’
‘বলতে পারেন, ম্যানেজ করি আমরা। দুনিয়ার লোক যদি কাউকে দেখতে
না চায়, তাকে আমরা লুকিয়ে ফেলি। স্রেফ গায়েব করে দিই। এ-ধরনের কাজ
করতে হয় আমাদের, ঠিক?’
‘যেমন আমাকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে?’
‘হুঁ, হ্যাঁ, ঠিক। ক্যাপটেন রানা, বলুন তো, ডাক্তারী পরীক্ষার জন্যে আপনি
তৈরি?’
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানা বললো, ‘চলো কোথায় নিয়ে যাবে।’
ডাক্তার একজন নয়, কয়েকজন। তিন ঘণ্টা ধরে রানাকে পরীক্ষা করলো
তারা। এটা-সেটা অনেকগুলো টেস্টও করা হলো। ইএনটি স্পেশ্যালিস্ট বললো,
‘আপনি ভাগ্যবান। এয়ারড্রামের কোনো ক্ষতি হয়নি। যা শুনলাম, মিরাকলই
বলতে হবে।’ এই লোকটাকে সামরিক বাহিনীর সদস্য বলে চিনতে ভুল হলো না
রানার।
হাসপাতাল বিল্ডিঙের আরেক প্রান্তে নিয়ে আসা হলো রানাকে। পরিবেশ
দেখেই বুঝে ফেললো, সাইকিয়াট্রিস্ট-এর পাল−ায় পড়তে হবে ওকে। রাগ হলো
ওর। দেয়ালের ছবিগুলোই ফাঁস করে দিলো ব্যাপারটাÑপরিষ্কার নীল আকাশ,
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। এক ধারে এক গাদা ফুল ফুটেছে।
সাইকিয়াট্রিস্টদের পাল−ায় আগেও অনেকবার পড়েছে রানা, পরীক্ষার ধরন-
ধারণ সম্পর্কে জানে। ইঙ্ক ব−ট নিয়ে আসা হলো দেখে মনে মনে হাসলো ও, কি
উত্তর দেবে ঠিক করে ফেললো মনে মনে।
‘প্রতিটির দিকে ভালো করে তাকান, তারপর বলুন কি দেখছেন আপনি।’
তরুণ সাইকিয়াট্রিস্ট রানার সামনে ডেস্কের ওপর একটা করে ইঙ্ক ব−ট রাখলো।
রোগীর অবস্থা যদি সিরিয়াস হয়, প্রজাপতিটাকে মনে হবে প্রার্থনারত পতঙ্গ। আর
চুম্বনরত দম্পতিটিকে মনে হবে মারাÍক অস্ত্র। দু’বারই জবাব দিলো রানা, ওগুলো
তার চোখে কুমারী মেয়ের স্তন বলে মনে হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হবার পর তরুণ
সাইকিয়াট্রিস্ট হাসলো। ‘আপনি আসলে বিরক্তবোধ করছেন তাই না, ক্যাপটেন
রানা?’
‘অবশ্যই। দেখুন, এরচেয়েও বড় মানসিক আঘাত পেয়েছি আমি। ভালো
লাগতে শুরু করেছে, এমন একটা মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে ফেললে আর সব
লোকের যে অবস্থা হয়, আমারও সেই একই অবস্থা। হঠাৎ, দ্রুত ঘটে গেছে
ব্যাপারটা। এতো দ্রুত যে মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। তারপরই শোক, নিজের
প্রতি ধিক্কার। শক তো আছেই। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে প্রচণ্ড বিরক্তিই শুধু নয়,
রাগও হচ্ছে আমার। রাগ হচ্ছে নিজের ওপর, বোকামির জন্যে। রাগ হচ্ছে
ওদের ওপর, আমার জন্যে ফাঁদ পাতায়। ন্যাচারাল, তাই না?’
মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো সাইকিয়াট্রিস্ট। ‘আপনি যেতে পারেন, ক্যাপটেন
রানা। রাগ হলো সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কাজেই আসুন পরস্পরের সময় বাঁচাই
আমরা।’
রানা অবশ্য বললো না যে ওর মনে সন্দেহ রয়েছে, কেউ হয়তো ধুলো
দেয়ার চেষ্টা করছে ওর চোখে। ব্যাপারটা পরে পরিষ্কার হয়ে যাবে, সময়মতো।
ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল মারিয়ো। ‘সিও আপনার সাথে একটা কথা
বলতে চান, স্যার।’
‘একটা কথা, নাকি অনেকগুলো?’
চোখ পিটপিট করলো লোকটা। ‘হ্যাঁ, তাই তো, অবশ্যই!’
বিল্ডিঙগুলো বেশ লম্বা, ইঁটের কাঠামো, একজন ডিজাইনার যেন ছ’টা মডেল
৪২
পেরিমিটার ফেন্সিং-এর ভেতর এলোমেলোভাবে বসিয়ে দিয়েছে। সব ক’টা
একতলা, দু’দিকে জানালা থাকলেও রানা লক্ষ করলো ভেতর দিককার
কামরাগুলো জানালাবিহীন, দিনের আলো শুধু করিডরে ঢোকার সুযোগ পায়।
লিভিং কোয়ার্টার আর হাসপাতালে বিভিন্ন ভাষায় লেখা অনেকগুলো নোটিশ দেখা
গেল, কেউ যেন করিডরে কথা না বলে। কারণটা পরিষ্কার। শব্দ চুরির বিরুদ্ধে
সম্ভাব্য সব রকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে ভেতরদিককার কামরাগুলোয়।
উঠনটা পেরুবার সময় কোন্ বিল্ডিঙটা কি কাজে ব্যবহার করা হয় আন্দাজ
করার চেষ্টা করলো রানা। একটা স্টাফদের জন্যে, আরেকটা সিনিয়র স্টাফদের
জন্যে, হাসপাতাল, অসংখ্য অ্যান্টেনা দেখে বোঝা গেল তিন নম্বরটা
কমিউনিকেশন সেন্টার, গেস্টদের জন্যে একটা (যেখানে ওকে থাকতে দেয়া
হয়েছে), আর শেষেরটা, প্রবেশপথ থেকে সবচেয়ে দূরে, এক্সিকিউটিভ অফিস।
আন্দাজটা বোধহয় নির্ভুল, কারণ মারিয়ো মন্তাজ রানাকে শেষ বিল্ডিঙটার
দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। মারিয়ো, ভাবলো রানা, অতোটা বোকা নয় প্রথম যতোটা
তাকে মনে হয়েছিল।
এক্সিকিউটিভ অফিসে অনেকগুলো কামরা, মাঝখানের বড় একটাতে বসে
কমাণ্ডিং অফিসার। দরজায় নক করলো মারিয়ো, আমেরিকান উচ্চারণে ভেতর
থেকে সাড়া দিলো কেউ। বললো, ‘ওকে।’ শান্ত, ধীর কণ্ঠস্বর, নরম।
‘ক্যাপটেন মাসুদ রানা, রয়্যাল নেভি, স্যার,’ গাধার ডাক ছাড়লো মারিয়ো।
মুখে হাসির একটা পোঁচ মাখলো রানা, ওর পিছনে মারিয়ো দরজা বন্ধ করার
পর দেখলো কামরার ভেতর একা ও। দেয়ালে কোনো মনোমুগ্ধকর ছবি নেই,
নেই ফুল গাছ সহ টব। একদিকের বিরাট দেয়াল ঢাকা পড়ে আছে দুটো
ম্যাপেÑএকটায় স্থানীয় ইটালিয়ান এরিয়া, অপরটা ইউরোপ। দ্বিতীয় ম্যাপটায় সব
কিছু বিস্তারিত দেখানো হয়েছে, ম্যাপের গায়ে প্রচুর সামরিক প্রতীক চিহ্নও
দেখলো রানা। বাকি ছবিগুলো সবই কোনো না কোনো ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাথে সম্পর্কিত। ব−্যাকহক আর চিনুক হেলিকপ্টারগুলো বড় করে দেখানো
হয়েছে, চিনুকগুলোর দরজা থেকে উথলে বেরিয়ে আসছে যুদ্ধের পোশাক পরা
সৈনিকরা। কাছে পিঠে বিস্ফোরিত হচ্ছে মর্টার বোমা।
‘চলে আসুন, ক্যাপটেন রানা। আপনাকে এখানে পেয়ে ভারি খুশি হলাম।’
ছোটোখাটো মানুষটা, ডেস্কের পিছনে চেয়ারে এমনভাবে হেলান দিয়ে ছিলো,
প্রথমে তাকে দেখতেই পায়নি রানা।
রানা এগোচ্ছে, চেয়ারে সিধে হলো কমাণ্ডিং অফিসার, তারপর দাঁড়ালো,
হাতটা বাড়িয়ে দিলো রানার দিকে। অভিজাত ম্যাগাজিন, আর্ট পেপারে ছাপা,
দামী কাপড় তৈরির কোনো কোম্পানীর বিজ্ঞাপন থেকে উঠে এসেছে যেন
লোকটা। সুটটা প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত টেইলারিং শপ থেকে বানানো
হয়েছে, ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা আর্মির বেতন থেকে ওটার মজুরী দেয়া সম্ভব
নয়। একই কথা শার্ট আর টাই সম্পর্কে, দুটোই বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানানো
হয়েছে, দ্বিতীয় কারো ঠিক এ-ধরনের শার্ট বা টাই দেখতে পাওয়া যাবে না।
জুতো জোড়া নকল নয়, খাঁটি গুচি, হাতে সেলাই করা।
দামী পরিচ্ছদের ভেতর লোকটা বেঁটে, রোগা, টাক শুরু হয়েছে মাথায়।
গলার স্বরটা নরম শোনালেও, চেহারার মধ্যে প্রায় হিংস্র, রগচটা একটা ভাব চাপা
থাকেনি। ‘আপনাকে দেখে সত্যি খুশি হয়েছি, ক্যাপটেন রানা। দিনের শুরুতে
আজ যে অসুবিধেয় পড়েন, সেজন্যে দুঃখিত। ছুটি কাটাতে এসে এ-ধরনের
বিড়ম্বনা কারই বা ভালো লাগে। তবে, আমার অনুমান, আমরা যে-পেশায় আছি,
ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়, এমনকি ক্রিসমাসের ছুটিতেও। সে যাই হোক,
নর্থাঙ্গার-এ আপনাকে স্বাগতম, ক্যাপটেন।’
‘নর্থাঙ্গার?’ পুনরাবৃত্তি করলো রানা, গলায় অবিশ্বাসের সুর।
‘গোপন গাইডবুকে এই নামই দেয়া হয়েছে আমাদের। সে যাই হোক, আমি
হার্ল ক্যাসিডি।’ আকৃতি ছোটোখাটো হলে কি হবে, রানার মনে হলো প্রচণ্ড
শক্তিশালী গরিলার সাথে করমর্দন করছে সে। ‘বসুন, ক্যাপটেন। দু’একটা
ব্যাপারে আলোচনা দরকার আমাদের।’
বসলো রানা। চেয়ারটা কোনো এফ/ফরটিন-এর পাইলট এক সময় ব্যবহার
করতো, সেটাকে খানিক বদলে এখানে ফেলা হয়েছে। আরামদায়ক, মনে মনে
স্বীকার করলো রানা। ‘কি ব্যাপারে আলোচনা, মি....
ইয়ে...
?’
‘নো র্যাঙ্ক। পদ ইত্যাদি পছন্দ করে না ল্যাঙলি। আপনি আমাকে শুধু হার্ল
বলে সম্বোধন করুন। পদের কথা যদি তোলেনই, আমি হলাম অফিসার কমাণ্ডিং
নর্থাঙ্গার। আমার কাজ হলো বসে থাকা, শীতকালে হি হি করা, গরমের দিনে
ঘামা, আর সচল স্পাইদের আসা-যাওয়া লক্ষ করা। আপনি, ক্যাপটেন, আমাদের
সচল স্পাইদের মধ্যে একজন ভিআইপি।’
‘আমার আসলে নিরেট কিছু এভিডেন্স দরকার, হার্ল। ভ্রাম্যমাণ স্পাই
হিসেবে পরিচয় দিলে অনেক সময় মারা পড়তে হয়।’
‘সেটা কোনো সমস্যা নয়। প্রমাণ দেয়া যাবে। আপনাকে আমি রানা বলতে
পারি তো, বাই দ্য ওয়ে?’
‘কেন নয়।’
ডেস্কের পিছনে স্টীলের ফাইলিং কেবিনেটটা খুললো কমাণ্ডিং অফিসার।
রানা লক্ষ করলো, তিনটে চাবি আর দুটো ডিজিটাল টাচ-প্যাড ব্যবহার করতে
হলো লোকটাকে। এখানকার পরিবেশ অদ্ভুত লাগছে রানার, প্রথম থেকেই।
কোনোভাবেই যেন মিলছে না।
‘এই নিন। দুটোই আছেÑসাইফার, ডিসাইফার।’
কাগজ দুটো নিলো রানা, অরিজিন্যাল সাইফার-এর ফেইলসেফ ডাবল-চেক
লক্ষ করলো। কোনো সন্দেহ নেই, সরাসরি মারভিন লংফেলোর কাছ থেকে
এসেছে। তরজমা করা অংশটা পড়তে শুরু করলো রানা।
‘ফ্রম বিএসএস ইউকে টু ওসি নর্থাঙ্গার বেস মেসেজ কনটিনিউজ থ্যাঙ্ক ইউ
ফর অ্যাসিস্ট্যান্স রেফারেন্স আওয়ার মাছরাঙা স্টপ উড অ্যাপ্রিশিয়েট আ ডিব্রিফ
কপি মি ওনলি স্টপ দিস অফিসার মাস্ট বি কেপ্ট ইন ডাউনলোড আনটিল
জানুয়ারী টু স্টপ উইল সিগন্যাল হাউ হি ইজ টু প্রসিড অ্