somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাস্যকৌতু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পেটে ও পিঠে

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রথম দৃশ্য

বাড়ির সম্মুখে পথে বসিয়া পা ছড়াইয়া বনমালী পরমানন্দে সন্দেশ আহার করিতেছেন।

বয়স সাত। তিনকড়ির প্রবেশ। বয়স পনেরো

সন্দেশের প্রতি সলোভ দৃষ্টিপাত করিয়া

তিনকড়ি । কী হে বটকৃষ্ণবাবু , কী করছ ?

বনমালীর নিরুত্তরে অবাক হইয়া থাকন

তিনকড়ি । উত্তর দিচ্ছ না যে ? তোমার নাম বটকৃষ্ণ নয় ?

বনমালী । ( সংক্ষেপে) না ।

তিনকড়ি । অবিশ্যি বটকৃষ্ণ । যদি হয়? আচ্ছা , তোমার নাম কী বলো ।

বনমালী । আমার নাম বনমালী ।

তিনকড়ি । ( হাসিয়া উঠিয়া) ছেলেমানুষ , কিচ্ছু জান না । বনমালীও যা বটকৃষ্ণও তাই , একই । বনমালীর মানে জান ?

বনমালী । না ।

তিনকড়ি । বনমালীর মানে বটকৃষ্ণ । বটকৃষ্ণের মানে জান ?

বনমালী । না ।

তিনকড়ি । বটকৃষ্ণের মানে বনমালী । — আচ্ছা , বাবা তোমাকে কখনো আদর করেও ডাকে না বটকৃষ্ণ ?

বনমালী । না ।

তিনকড়ি । ছি ছি! আমার বাবা আমাকে বলে বটকৃষ্ণ , মোধোর বাবা মোধোকে বলে বটকৃষ্ণ -তোমার বাবা তোমাকে কিচ্ছু বলে না! ছি ছি!

পার্শ্বে উপবেশন

বনমালী । ( সগর্বে) বাবা আমাকে বলে ভুতু ।

তিনকড়ি । আচ্ছা ভুতুবাবু , তোমার ডান হাত কোন্‌টা বলো দেখি ।

বনমালী । ( ডান হাত তুলিয়া) এইটে ডান হাত ।

তিনকড়ি । আচ্ছা, তোমার বাঁ হাত কোন্‌টা বলো দেখি ।

বনমালী । ( বাম হাত তুলিয়া) এইটে ।

তিনকড়ি । ( খপ্‌ করিয়া পাত হইতে একটা সন্দেশ তুলিয়া নিজের মুখের কাছে ধরিয়া) আচ্ছা ভুতুবাবু , এইটে কী বলো দেখি ।

বনমালীর শশব্যস্ত হইয়া কাড়িয়া লইবার চেষ্টা

তিনকড়ি । ( সরোষে পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করিয়া) এতবড়ো ধেড়ে ছেলে হলি , এইটে কী জানিস নে! এটা সন্দেশ । এটা খেতে হয় ।

তিনকড়ির মুখের মধ্যে সন্দেশের দ্রুত অন্তর্ধান


বনমালী । ( পৃষ্ঠে হাত দিয়া ) ভ্যাঁ —

তিনকড়ি । ছি ছি ভুতুবাবু , তোমার জ্ঞান কবে হবে বলো দেখি । এইটে জান না যে , পেটে খেলে পিঠে সয় ?


আর-একটা সন্দেশ মুখের ভিতর পুরণ


বনমালী । ( দ্বিগুণ বেগে ) ভ্যাঁ —

তিনকড়ি । তবে , তুমি কি বল পেটে খেলে পিঠে সয় না ? এই দেখো-না কেন , পেটে খেলে ( আর-একটা সন্দেশ খাইয়া) পিঠে সয়-

বনমালীর পৃষ্ঠে চপেটাঘাত

সয় না ?

বনমালী । ( সরোদনে চীৎকারপূর্বক ) না ন্না ন্না ।

তিনকড়ি । ( শেষ সন্দেশটি নিঃশেষ করিয়া) তা হবে । তোমার তা হলে সয় না দেখছি । যার যেমন ধাত । তবে থাক্‌ , তবে আর কাজ নেই । তবে এই স্থির হল কারো বা পেটে সমস্তই সয় , কারো বা পিঠে কিছুই সয় না । যেমন আমি আর তুমি ।

সহসা বনমালীর পিতার প্রবেশ


পিতা । কী রে ভুতু , কাঁদছিস কেন ?

পিতাকে দেখিয়া বনমালীর দ্বিগুণ ক্রন্দন


তিনকড়ি । ( বনমালীর পৃষ্ঠে হাত বুলাইয়া অতি কোমল স্বরে) বাবা জিগ্‌গেস করছেন , কথার উত্তর দাও ।

বনমালী । ( সরোদনে) আমাকে মেরেছে. ।

তিনকড়ি । আজ্ঞে , পাড়ার একটা ডানপিটে ছেলে খামকা মেরে গেল , বেচারার কোনো দোষ নেই-সন্দেশগুলি খেয়ে ভুতুবাবু ঠোঙাটি নিয়ে খেলা করছিল-

পিতা । ( সরোষে) ভুতু , কে মেরেছে রে ?

বনমালী । ( তিনকড়িকে দেখাইয়া ) ও মেরেছে ।

তিনকড়ি । আজ্ঞে হাঁ , আমি তাকে খুব মেরেছি বটে । কার না রাগ হয় বলুন দেখি । ছেলেমানুষ খেলা করছে-খামকা ওকে মেরে ওর ঠোঙাটা কেড়ে নেও কেন বাপু ? আপনি থাকলে আপনিও তাকে মারতেন ।

পিতা । আমি থাকলে তার দুখানা হাড় একত্তর রাখতেম না । যত-সব ডানপিটে ছেলে এ পাড়ায় জুটেছে ।

বনমালী । বাবা , ও আমার সন্দেশ —

তিনকড়ি । ( নিবৃত্ত করিয়া) আরে , আরে , ও কথা আর বলতে হবে না ।

পিতা । কী কথা ?

তিনকড়ি । আজ্ঞে , কিছুই নয় । আমি ভুতূবাবুকে আনা-দুয়েকের সন্দেশ কিনে খাইয়েছি । সামান্য কথা । সে কি আর বলবার বিষয় ?

পিতা । ( পরম সন্তোষে) তোমার নাম কী বাপু ?

তিনকড়ি । ( সবিনয়ে) আজ্ঞে , আমার নাম তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় ।

পিতা । ঠাকুরের নাম ?

তিনকড়ি । খুদিরাম মুখোপাধ্যায় ।

পিতা । তুমি আমার পরমাত্মীয় । খুদিরাম যে আমার পিসতুতো ভাই হয় ।

তিনকড়ির ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম


পিতা । চলো বাবা, বাড়ির ভিতর চলো । জলখাবার খাবে । আজ পৌষপার্বণ , পিঠে না খাইয়ে ছাড়ব না ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে ।

পিতা । আজ রাত্রে এখানে থাকবে । কাল মধ্যাহ্নভোজন করে বাড়ি যেয়ো ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে ।


দ্বিতীয় দৃশ্য

অন্তঃপুরে তিনকড়ি পিষ্টক-আহারে প্রবৃত্ত

তিনকড়ি । ( স্বগত ) ডান হাতের ব্যাপারটা আজ বেশ চলছে ভালো ।

ভুতুর মা । ( পাতে চারটে পিঠে দিয়া) বাবা , চুপ করে বসে থাকলে হবে না , এ চারখানাও খেতে হবে ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে । ( আহার)

ভুতুর বাপের প্রবেশ

পিতা । ওকি ও! পাত খালি যে! ওরে , খান-আষ্টেক পিঠে দিয়ে যা ।

পিঠে-দেওন

বাবা , খেতে হবে । এরই মধ্যে হাত গুটোলে চলবে না ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে । ( আহার )

পিসিমার প্রবেশ

পিসিমা । ( ভুতুর মা'র প্রতি) ও বউ , তিনকড়ির পাত খালি যে! হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী ? ওকে খান-দশেক পিঠে দাও । লজ্জা কোরো না বাবা , ভালো করে খাও ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে ।

পিসেমহাশয়ের প্রবেশ

পিসেমহাশয় । বাপু , তোমার খাওয়া হল না দেখছি । দিয়ে যা , দিয়ে যা , এ দিকে দিয়ে যা । পাতে খান-পনেরো পিঠে দে।

তোমাদের বয়েসে আমরা খেতুম হাঁসের মতো । সবগুলি খেতে হবে তা বলছি ।

তিনকড়ি । যে আজ্ঞে ।

দিদিমার প্রবেশ

দিদিমা । ( ভুতুর মা'র প্রতি অন্তরালে) ও বউ , পিঠে তো সব ফুরিয়ে গেছে , আর একখানাও বাকি নেই ।

ভুতুর মা । কী হবে!

দিদিমা । কী আর হবে ?

তিনকড়ির পাশে গিয়া পরিহাস করিয়া পিঠে এক কিল মারিয়া

পিঠে আর খাবে!

তিনকড়ি । আজ্ঞে না।

দিদিমা । সে কী কথা! আর দুটো খাও ।

আরো দুটো কিল

তিনকড়ি । ( গাত্রোত্থান করিয়া) আজ্ঞে না । আর আবশ্যক নেই ।


তৃতীয় দৃশ্য

পরদিন তিনকড়ি শয্যাগত। পাশে বনমালী

তিনকড়ি । ( ক্ষীণকন্ঠে) ভুতুবাবু , তোমার বাবা কোথায় হে ?

বনমালী । বদ্যি ডাকতে গেছে ।

তিনকড়ি । ( কাতর স্বরে) আর বদ্যি ডেকে কী হবে! ওষুধ খাব যে তার জায়গা কোথায় ?

বনমালী । তোমার পেটে কী হয়েছে তিনকড়িদা ?

তিনকড়ি । যাই হোক গে , কাল তোমাকে যা শিখিয়েছিলুম মনে আছে কি ?

বনমালী । আছে ।

তিনকড়ি । কী বলো দেখি ।

বনমালী । পেটে খেলে পিঠে সয় ।

তিনকড়ি । আজ আর-একটা শেখাব । কথাটা মনে রেখো — ‘ পিঠে খেলে পেটে সয় না ' ।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×