
ট্রেনে উঠেই নাফিসের চোখ চলে গেল এক অতি রুপবতী বালিকার দিকে।নাফিস আর হামিদ দুই বন্ধু এক সাথে সিলেট যাচ্ছে।হামিদ নাফিসকে ডাকছে, "এই নাফিস এদিকে আয় ।আমাদের সিট তো পাশের বগিতে"। নাফিস কিছু শুনছে না । এই মুহূর্তে সে ভাবছে ট্রেনে উঠার পর কোন ধরণের প্রেম কাহিনী সিনেমায় ঘটে।তার দেখা বিশাল সিনেমার ভান্ডার থেকে খোঁজার চেষ্টা করছে সে।না খুঁজে পাচ্ছে না কিছু। নাফিস যা খুঁজে পাচ্ছে তা হচ্ছে একজন অপরিচিত বালিকার সাথে কিভাবে কথা শুরু করছে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়া ছেলেটি। কল্পনায় কথা চলছে।এদিকে হামিদ ডেকেই যাচ্ছে। নাফিসের সেদিকে কোন খেয়াল নাই। এসব সময়ে মানুষের কোনো দিকে খেয়াল থাকে না।কারণ এই সময়ে মানুষের মনে একধরণের ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে তা কত আসে সেটা বিজ্ঞানীরা বের করতে চান নি । বিজ্ঞানীরা জাতিগত ভাবেই হৃদয়হীন । চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার যখন ১৯৭০ সালে রিখটার স্কেল আবিষ্কার করেন তখন তার মনে একটু প্রেম ভালোবাসা থাকলে তিনি সেখানে হৃদয়ের ভূমিকম্প মাপার একটা ব্যবস্থা করে যেতেন।কিন্তু তিনি সেটা করেন নি । জাত রাখলেন !
নাফিস হামিদের সাথে চলে গেল পাশের বগিতে।সত্যি বলতে নাফিস আসলে তখনও যায় নি । দেহটাকে টেনে কোথাও নিয়ে গেলেই মন সেখানে চলে যায় না। দেহ আর মনের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে বলেই বাংলা সিনেমার সেই নায়িকা সদর্পে ঘোষণা করতে পেরেছিল "শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না"। নাফিসের সিট যে বগিতে সে বগির নাম্বার ঘ।নাফিসের ঘ বগিকে বলতে ইচ্ছে করছে ,"হে ঘ বগি ,তুই আমার দেহ পেলেও আমার মনটা গ বগিতেই রয়ে গেছে" ।
হামিদ এসে বলল,এই নাফিস কি হয়েছে তোর?
নাফিস বলল, তুই কে?
হামিদ বলল,মানে? আমি কে মানে?
নাফিস বলল, তুই না আমার বন্ধু ? তাহলে , আমার মধ্যে এই যে এত বড় ভূমিকম্প চলছে তুই কিছুই খেয়াল করলি না ? কি বালের বন্ধু তুই ?
হামিদ হা হা হা করে হাসতে লাগল।তারপর বলল ,মামা ,এই তাহলে কাহিনী।যাও তুমি পাশের বগিতে চলে যাও ।
নাফিস বলল,এখন যদি তাকে সেখানে না পাই ?
হামিদ বলল, পাবি না কেন? সে তো বসাই ছিল ।
নাফিস বলল, থাক একটু পর যাই।
হামিদ বলল, যা ব্যাটা এখনই যা।শুভ কাজে দেরি করতে নাই ।
নাফিস বলল, তুইও চল।আমার একা ভয় লাগে।
হামিদ বলল,হ্যা তোর বাসরও আমি করব ।আমি তুই আর তোর বউ ।
নাফিস বলল , থাক তুই ভাই। আমি গেলাম ।
নাফিস তার নিজের বগি থেকে পাশের বগির দিকে ছুটল। আন্তঃনগর ট্রেনের এই একটা সুবিধা আছে।এক বগি থেকে আরেক বগিতে খুব সহজেই যাওয়া যায়। আন্তঃ কথাটার মান সম্মান রাখল আর কি ! বগি পার হতেই নাফিস দেখল সেই মেয়েটি বসা একটু সামনের সিটেই। নাফিসের এর আগে কোন মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু আজকে তাকে বলতে হবেই । নাফিস এগিয়ে গেল। মেয়েটির সামনে গিয়ে বলল ,"আপনাকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। আপনি কি সুমুর কাজিন আমরিন না ?" নাফিসের সে অপরুপা হঠাত একজনের কথা শুনে বুঝতে পারছিল না কি বলবে । সে বলল , "আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন ?"
নাফিস বোকা বনে গেল। কিন্তু তারপরও সাহস নিয়ে বলল ,"হ্যাঁ তোমাকেই তো । তুমি আমরিন না ? ঐ যে মনে আছে ? আমি নাফিস, সুমুর ফ্রেন্ড।সাস্টে পড়ি। তোমার সাথে দেখা হয়েছিল ।তুমি বললে ভাইয়া ,ভালোই হয়েছে আমাদের বাসাও সিলেট।আমাকে যে সিলেটে তোমার বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলে।কি মনে নাই ?"
মেয়েটি বলল ,"ভাইয়া আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আসলে আমি আমরিন নই। আমি জেবিন। আর সুমু নামের আমার কোন কাজিনও নাই । তবে হ্যাঁ আমার বাড়ি সিলেট ।"
নাফিস তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।এরপর বলল, " ধুর এই ভুলটা কি করে হলো ! এরপর সে জেবিনকে " আচ্ছা সরি" বলে তার নিজের বগিতে ফিরে গেল । সেখানে হামিদকে এই কাহিনী বলার পর হামিদ তো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসার অবস্থায়। তারপর বলল গাধা, কেউ এভাবে কথা বলে নাকি ! হামিদ বলল ,"আচ্ছা বাদ দে। গিটার টা বের কর ।গান ধর ।দুঃখের গান" । নাফিস বলল, " না রে ভালো লাগছে না কিছুই "। হামিদ বলল, "আরে গাধা তুই একটা গান গাইবি ,এমন ভাবে গাইবি যাতে সেটা পাশের বগিতে গিয়ে আঘাত হানে ।আমরা দুই বগির মাঝখানের জায়গাটাতে গিয়ে গাইব।দেখি মেয়েটার কনসেন্ট্রেশন নিতে পারি কিনা । "
এদিকে জেবিন কেন জানি একটা ধাক্কা খেল। এই ছেলেটাকে সে চিনে না সেটা সত্যি।কিন্তু কেন জানি তার এই ছেলেকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। অপরিচিত মানুষের পরিচিত মনে হওয়াটা ভালো লক্ষণ না । জীন পরীদের আছর লাগার মত । যেকোন বিপদ হতে পারে সামনে।তবে জেবিন খুব আবেগী মেয়ে না ।সে এর রহস্য বের করে ফেলল। জেবিন যে ছেলেটাকে তার পাশে কল্পনা করে সবসময় সে ছেলেটা অনেকটা এরকম । একটা ধূসর রঙের পাঞ্জাবি।তার উপর কালো কালো রঙের একটা শাল। আর পরনে একটা নীল জিন্স। পায়ে এক জোড়া দুই ফিতার স্লিপার । রহস্য উদ্ধার হয়ে গেছে এখন জেবিনের কাজ এই ছেলেকে মাথা থেকে বিদায় করে দেওয়া। জেবিন বিদায় দিয়ে ফেলছিল কিন্তু এমন সময় একটা গানের সুর বাতাসে ভেসে আসল । ছেলেটা তপুর গাওয়া "একটা গোপন কথা" গানটি গাইছিল। জেবিনের খুব প্রিয় একটা গান। জেবিন খেয়াল করল এই ছেলেটার গলায় গানটা খুব ভালো ভাবে মিলে গেছে। তার মনে হচ্ছে ছেলেটা তপুর চেয়ে ভালো গাইছে। জেবিন ছেলেটাকে তার মন থেকে বিদায় করতে পারল না ।ছেলেটাকে আবার ফিরিয়ে আনল সে। পেছন থেকে ডাক দেয়া নাকি শুভ লক্ষণ না ! হায় হায় কি করল জেবিন ! অশুভ কিছু যদি হয়ে যায়।
জেবিনকে অবাক করে দিয়ে নাফিস আবার এসে বলল, আসলে আমরিন বা সুমু নামের কাউকে আমিও চিনি না ।আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তাই মিথ্যে বলা।
জেবিন এবার একটা হাসি দিয়ে বলল,তাই নাকি! আমি কি বোকা আমি ধরতেই পারলাম না ।
নাফিস বলল, বোকার কিছু নাই ।আমি একটু বেশি চালাক আর কি । হা হা হা ।
জেবিন মুগ্ধ হয়ে ছেলেটার কথা শুনছিল ।জেবিন ভাবছে একটা ছেলের কথা বলা এত সুন্দর হবে কেন ! এদিকে নাফিসও কথা বলেই যাচ্ছে। সে ভাবছে, একটা মেয়ের চোখ জোড়া এত সুন্দর হবে কেন !
কথা বলতে বলতে তারা দুজনেই সিলেট স্টেশনে নেমে গেল । নাফিস ভাবছে কখন যে সময় ফুরিয়ে গেল। তাদের কথা হয়েছে আধা ঘন্টা। এই আধাঘন্টায় যতটুকু কথা বলা যায় বলে নিলো তারা। কিন্তু কেউই যোগাযোগ রক্ষা করার কথা মনে রাখল না কিংবা এমন রাস্তার গল্পগুলো কেউ বাড়িতে টেনে নিতে চায় না। কিন্তু দুজনেই বাসায় ফেরার পর মনে করল, ভুল হয়ে গেছে।
পুনশ্চঃ গল্পটা এখানেই শেষ না।কারণ জেবিন আর নাফিস এখনো কথা বলেই যাচ্ছে, আলাদা আলাদাভাবে। কিন্তু কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না ।নিজেদের ভুলের জন্য নিজেদের দোষারোপ করছে তারা।একজন মানুষের সাথে নাকি পাঁচবার দেখা হয়। তাদের দুজনকে লেখক বাকি চারবার দেখা করার অপেক্ষায় রাখবেন বলে গল্প শেষ করে দিয়েছেন।এরকম কোন নিয়ম থাকলে উপরওয়ালাও হয়তো তাদের আবার দেখা করার সুযোগ দিবেন। সে অপেক্ষায় জেবিন ,নাফিস আর লেখক।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




