somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধের প্রস্তুতি - (পর্ব ১)

১০ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি কথা প্রচলিত আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। তোমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে তোমাদের জন্য বর্তমান সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই জুন মাস থেকে আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তোমরা যেমন কর্ম করবে সেই অনুযায়ী ফল পাবে। পরীক্ষা শেষ এর উপর জ্যৈষ্ঠ মাস যাকে মধুমাস বলা হয়। যদি মনে কর মধুমাসের মধু খেয়ে বেড়াই পরীক্ষার প্রস্তুতি আস্তে ধীরে নেই তাহলে ভুল করবে। জীবনে মধু মাসের মধু আহরণের অনেক সুযোগ পাবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ জীবনে একবারই পাবে। তাই এই একটি সুযোগ হেলা ফেলা করে ছেড়ে দিও না।

মনে কর তুমি পাসপোর্ট করাবে। সবাই বলে অনেক নাজেহাল আর ভোগান্তির কাজ। এটা কিভাবে করাতে হয়, কি কি প্রক্রিয়া তুমি জানো না তখন তুমি কি করবে? এর আগে যে পাসপোর্ট করেছে তার অভিজ্ঞতা শুনবে। কি কি ভুল করা যাবে না, কি কি বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা তুমি আগে থেকে জানবে। এরফলে তোমার কাছে পাসপোর্ট করানোর কাজ সহজ মনে হবে আর তুমি ভোগান্তি এড়িয়ে সহজেই কাজটি করতে পারবে। এরজন্যই অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। আমি তোমাদের আজ বড় ভাই হয়ে কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করবো। প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কেন তোমাদের উদ্দেশে লিখছি? আমার কি লাভ?

আমি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে প্রশিক্ষক হিসেবে আছি। আমার চাকরির পোস্টিং নিয়ে বর্তমানে যশোরে আছি এবং বেশ ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে আমি তোমাদের উদ্দেশে এই লেখা না লিখলেও পারতাম। কিন্তু আমি এবারের এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়া কিছু ছোট ভাই বোনদের বলতে শুনেছি- আমি এ+ পাবো না তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য না। ঐটা এ+ পাওয়া ছেলে মেয়েদের কারবার।

আবার আরেকজনকে বলতে শুনেছি- হাজার হাজার মানুষ পরীক্ষা দেয় এর মধ্যে আমি কিভাবে চান্স পাব? শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ? এর চেয়ে মধু খেয়ে বেড়াই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অনেক লবিং লাগে। আমার লবিং নেই তাই চেষ্টা করেও লাভ নেই।

কিছু মানুষ যুদ্ধে নামার আগেই পরাজয় মেনে নিচ্ছে অথচ এই যুদ্ধে জয় তার জন্যই ছিল। বিশ্বাস কর- এ+ না পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যায়। তুমি যদি মনে প্রাণে চাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তখন ঐ হাজার হাজার ছেলে-মেয়েদের টপকে তুমি বিজয় অবশ্যই ছিনিয়ে আনতে পারবে। যারা যুদ্ধে নামার আগেই পরাজয় মেনে নিচ্ছে তাদের উদ্দেশেই আমার এই লেখা। আমার এই লেখা পড়ে একজনও যদি অনুপ্রাণিত হয় এবং সেই অনুযায়ী এগিয়ে চলে তবেই আমার সার্থকতা আসবে।

আমি নিজেও এইচএসসি পরিক্ষায় এ+ পাইনি। স্কুলে থাকতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনিনি। এখানে পড়ার স্বপ্নও দেখিনি। এই আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি তাহলে তুমি অবশ্যই পারবে কারণ তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানো, এটা নিয়ে স্বপ্ন দেখো।

আমি ঢাকার ভাষানটেক এলাকায় থাকি। আমার এলাকার সবাইকে দেখেছি- ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বাড়ির কাছে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হতে। আমিও ভাবতাম- একদিন ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে এই কলেজেই ভর্তি হব। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনিনি আর এখানে পড়ার স্বপ্নও দেখিনি। এখানে পড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম এসএসসি পরীক্ষার পর। কিভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম সেটা জানা তোমাদের জরুরি কারণ কোন কিছু পেতে হলে সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে, চাইতে হবে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন কিভাবে দেখি সেটা আমি একটি চমকপ্রদ কথা দিয়ে শুরু করি। ২০০৪ সালে আমি SSC পাশ করি আবার ঐ বছরেই HSC পাশ করি। কি ভ্রু কুচকালে? এই কথা শুনে সবাই ভ্রু কুঁচকায়। তখন তাদের উদ্দেশে একটি মুচকি হাসি দিয়ে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করি।

২০০৪ সালের এস এস সি পরীক্ষা দেবার পর পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন রেজাল্ট দিতে তিন মাস সময় লাগতো। খাচ্ছি, ফিরছি, ঘুরছি। পড়ালেখা বলতে 'পদ্মা নদীর মাঝি' পড়া শুরু করেছিলাম। এভাবে চলছে দিন।

২০০৪ সালের ১০ মে আমি জহুরের নামাজ পড়ে মাত্র বাসায় ঢুকলাম। এখনো দুপুরের ভাত খাইনি। আমার স্কুলের পিয়ন আমার বাসায় এসে হাজির। স্কুলের হেড স্যার আমাকে অভিভাবকসহ জরুরী ভিত্তিতে যেতে বলেছেন। আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। অভিভাবকসহ কেন যেতে বলবেন? এখন তো আমি আর স্কুলের ছাত্র না। তাছাড়া আমি তো আমার জানা মতে কোন অন্যায় করিনি যে কেউ বিচার নিয়ে আসবে। আমি পিয়নকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারলাম না। যেহেতু জরুরী তাই ভাবলাম দেখা করে এসে ভাত খাব।

আমি ভয়ে ভয়ে স্যার এর রুমে ঢুকলাম। স্যার আমাকে দেখে একটু হাসি দিলেন। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। স্যার এর সামনে দুইজন লোক বসে আছেন। এরমধ্য একজন পরিচিত, আরেকজন অপরিচিত। স্যার আমার আব্বা-আম্মাকে বসতে বললেন।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমাকে একটা প্রশ্ন করি ঝটপট উত্তর দিবে। কাল এইচ এসসি পরিক্ষা শুরু হবে। তোমাকে যদি কাল পরীক্ষা দিতে বলা হয় তুমি কি পারবে?
আমি এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি? পাগল নাকি? এটা কি সম্ভব? আমি পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস ছাড়া কিছুই পড়ি নাই, আর আমি দিব পরীক্ষা। আমি হা করে স্যার এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার এই করুণ অবস্থা দেখে হেডস্যার এর সামনে বসা লোকটি বলে উঠলো- ছেলেটিকে আর বিব্রত কইরেন না, আসল কথা বলে ফেলেন।
তখন হেডস্যার বললেন- এই ভদ্র লোকের একটি ছেলে আছে। সে অন্ধ। সে তো আমাদের মত লিখে পরিক্ষা দিতে পারবে না। অন্ধরা ব্রেইল পদ্ধতিতে পরিক্ষা দেয় সেটাতো আমাদের দেশে চালু নেই। তাই তারা শ্রুতি লেখক এর মাধ্যমে পরিক্ষা দিয়ে থাকে।
আমি বললাম- কাল পরিক্ষা আর আজ কেন শ্রুতি লেখক খোঁজার জন্য এত তড়িঘড়ি।
তখন ভদ্রলোকটি বললেন- শ্রুতি লেখককে হতে হবে অবশ্যই জুনিয়র। আমরা আমার ছেলের খালাতো ভাইকে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ওর খালাতো ভাই দেখতে মোটা এবং দেখে বয়স্ক মনে হয় বলে ওকে পরিক্ষা দিতে দিচ্ছে না। বলছে এমন কাউকে নিতে যে জুনিয়র এবং দেখতে বাচ্চা বাচ্চা। তোমাকে দেখে মনেই হয় না তুমি মাত্র এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছো, মনে হয় মাত্র ক্লাস এইটে পড়।

আমি একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলাম। তখন হেডস্যার আমার বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনার ছেলেকে আগামী একমাস এই ভদ্রলোকের বাসায় থাকতে হবে। চিন্তা করবেন না, ওর থাকা খাওয়ার কোন সমস্যা হবে না। আপনারা মত দিলে ওকে যেতে দিতে পারি।

আমার আব্বা-আম্মা বললেন- এটা তো খুশির খবর যে আমার ছেলে একজনের উপকার করে দিচ্ছে। আমরা রাজি।
তখন লোকটি বললেন- হাতে একদম সময় নেই। আজকের মধ্যে তোমার প্রবেশপত্র করতে হবে। তোমার দুইকপি ছবি লাগবে। আছে বাসায়?
- বাসায় তো ছবি ওয়াশ করা নেই।
- দৌড় দিয়ে ছবি ওয়াশ করে আনতে পারবে না, যত টাকা লাগে দিব সমস্যা নেই।
আমি দৌড় দিয়ে স্টুডিও এর দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি আসলে কি হতে যাচ্ছে। আমি কি আসলেই পারবো?? শুনে শুনে কিভাবে পরিক্ষা দেয়া সম্ভব?? তাছাড়া অনেকে বলে আমি কানে একটু কম শুনি। প্রায় দেখা গেছে কেউ একটা বলছে আর আমি শুনছি আরেকটা।

স্টুডিও এর দোকানের লোক পরিচত ছিল। দশ মিনিটের মধ্যে আমি ছবি নিয়ে আসলাম। তখনো ভাত খেতে পারি নাই। পেটে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। যেহেতু সময় কম, তাই খাবারের কথা কাউকে কিছু বলি নাই। ওনাদের গাড়ি ছিল। আমি গাড়িতে চড়ে ওনাদের সাথে যাচ্ছি। আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল।

সত্যি কথা বলি- আমি খুব সাধারণ ঘরের সাধারণ একটি ছেলে। জীবনে কখনো প্রাইভেট গাড়িতে চড়িনি এর আগে। প্রথম প্রাইভেট গাড়িতে চড়েছি এই উচ্ছ্বাস আর কি ঘটতে যাচ্ছে সেই উচ্ছ্বাস আমি যে কোনটা নিয়ে চিন্তা করবো সেটা বুঝতে পারছিলাম না। গাড়িতে চড়ে লোকটি ওনার ছেলে সম্পর্কে বলতে লাগলেন। ওনার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়ে। আর ছোট ছেলে অন্ধ।

আমি বললাম, তিনি কি জন্ম থেকেই অন্ধ? আর ওনার নাম কি?
- ওর নাম রিফাত, ভালো নাম তালুকদার রিফাত পাশা। ও জন্ম থেকেই অন্ধ না। ও যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন ওর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। এর চিকিৎসা নেই। ফলে ও অন্ধ হয়ে যায়। বলতে বলতে লোকটির চোখে পানি চলে আসলো। আমিও চোখের সামনে ভাসানোর চেষ্টা করছি রিফাত ভাইয়ার মুখ। তিনি দেখতে কেমন? আগামী একটা মাস তার সাথে থাকতে হবে? আমি মনে মনে ঠিক করলাম- রিফাত ভাইয়ার খুব ভালো একজন বন্ধু হবো। তিনি কি আমার বন্ধু হবেন? এখন আমার চিন্তা রিফাত ভাইয়াকে নিয়ে।

আমাদের গাড়ি চলছে ঢাকা শহরের যানজটকে পাল্লা দিয়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ড অফিসে এসে হাজির হলাম। তখন প্রায় বিকাল চার টা বেজে গেছে। অফিস সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রবেশ পত্র করতে হবে দ্রুত তারপর সেই প্রবেশপত্রের একটি কপি পরিক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। আমাদের পরিক্ষা কেন্দ্র ছিল বিএএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা আর রিফাত ভাইয়া উত্তরা বয়েজ কলেজের ছাত্র ছিলেন। আমি তখনো রিফাত ভাইয়ার সাথে পরিচিত হতে পারিনি। তিনি কোথায় যেন গেছেন।

আমি বিস্ময় নিয়ে বোর্ড অফিসের সব কাজ দেখছি। এই বোর্ড অফিস থেকেই কিছুদিন আগে আমাদের এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র গিয়েছে। পরিক্ষার খাতা সারিসারি ভাবে সাজানো। এই সারিসারি খাতার মধ্যে কোন একটা খাতা হয়ত আমার। সেই সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এর পরীক্ষা কন্ট্রোলার ছিলে শাহ মুহম্মদ ফরহাদ। তিনি খুব রসিক মানুষ। এই মানুষটার স্বাক্ষর আমাদের প্রবেশপত্রে ছিল। এখন তাকে সামনাসামনি দেখছি। এই ঘটনাগুলো আমার বন্ধুবান্ধবদের খুব জানাতে ইচ্ছে করছে। আমার বন্ধু আদনান, হারুন ওরা জানলে নিশ্চয়ই অনেক অবাক হবে। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। তাই সবাইকে জানাতে পারছি না।

আমি শাহ মুহম্মদ ফরহাদ স্যার এর রুমে বসে আছি। রুমটা বিশাল বড়। তিনি আমাকে বললেন- দুপুরে খেয়েছো।
এখনো না খেয়ে আছি তারপরেও আমি ভদ্রতার খাতিরে বললাম-খেয়েছি।
তিনি আমাকে অবাক করে বললেন- না খেলেও খাওয়াতে পারতাম না, খাওয়ার মত কিছু নেই। তারপর তিনি বললেন- তুমি যেই কাজ করছো এটা সদকায়ে জারিয়া, এর সওয়াব তুমি আজীবন পেতে থাকবে। তুমি তোমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনকে জিজ্ঞেস করে দেখ, এই সুযোগ সবাই পায় না।

আমার অনেক ভালো লাগলো। ঠিকই তো আমার বন্ধু আদনান, হারুন ওরা কেউ কি এই কাজ করতে পেরেছে। তারপর তিনি আমাকে তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন এবং বললেন-কোন সমস্যায় পড়লে দেখা করতে। ১৫ বছরের এক কিশোরের জীবনে সেই ভিজিটিং কার্ড পাওয়া অনেক সুখের ব্যাপার।

এরপর আমরা বোর্ড অফিসের ভবন থেকে বের হয়ে আসলাম। ভবনের নিচে রিফাত ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারাতে একটা মায়াবীভাব। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি তার কাছে গেলাম। তিনি আমার হাতটি ধরলেন তারপর বললেন- পারবে তো?
আমি বললাম- পারবো।
আমরা গাড়িতে চড়ে সোজা পরীক্ষা কেন্দ্রে এর দিকে ছুটলাম। যাওয়ার পথে আমার বাসা পরে। তাই যাওয়ার পথে আমার কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিলাম। ওনাদের বাসা উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে। বাড়ির নামটা সুন্দর 'গোধুলী'।

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করলাম। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি উত্তরা হচ্ছে অভিজাত এলাকা। এখানে তাদের সাথে কিভাবে মানিয়ে চলবো তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। রিফাত ভাইয়ারাও বেশ ধনী। উত্তরাতে চার তালা বাড়ি, মগবাজারে ছয়তালা বাড়ি। রিফাত ভাইয়ার বাবা মানে আংকেল এই ভাড়ার টাকাতেই চলেন আর তাবলীগ করেন। রাত পোহালেই ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষা। সিলেবাস কি আমি কিছুই জানি না। রিফাত ভাইয়া আমাকে সিলেবাস বুঝানোর চেষ্টা করছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন- এমনভাবে পরীক্ষা দিও যেন অন্তত জিপিএ ৩.০০ পাই কারণ, তিনি এসএসসি তে ৩.১৩ পেয়েছেন এবার যদি ৩.০০ পয়েন্ট না পান তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তখন ৬.০০ পয়েন্ট লাগতো।

আমি বললাম- আমরা যদি টার্গেট করি ৩.০০ তাহলে হবে কি করে? আমাদের টার্গেট করা উচিত ৪.০০ তাহলে ৪.০০ না পাই অন্তত এর ধারে কাছে থাকতে পারবো। ইংরেজির ফ্লো চার্ট এবং টেবিল দেখে আমার মাথা ঘুরাচ্ছিল। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম। টেবিলে চারটা কলাম, কিভাবে করবো? ফ্লো চার্ট জিনিস টা কি বুঝতে পারছিলাম না। যত টুকু পারা যায় আমি সিলেবাস জানার চেষ্টা করলাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করলাম তারপরে খাওয়া দাওয়া করে রেডি হলাম। রিফাত ভাইয়া আমাকে জোর করলেন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে । আমি পড়লাম। ইংরেজি পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছে। ফুল এনস্যার করেছি। ইংরেজীতে সবচেয়ে বিরক্ত লেগেছিল রি এরেঞ্জ করতে।

তোমরাই চিন্তা কর- রিএরেঞ্জ এর চৌদ্দটা লাইন চৌদ্দ বার পড়ে শোনানো তারপর রিফাত ভাইয়া একবার বলে ‘জি’ হবে আগে তারপর আবার বলে না ‘বি’ হবে আগে। বিরক্ত লাগলেও প্রকাশ করেনি। একটা গ্রুপ ওয়ার্ক এর মত আমরা কাজ করেছিলাম। আমাদের জন্য আলাদা রুম দিয়েছিল। সেখানে আমি আর রিফাত ভাইয়া ছাড়া আর কেউ ছিল না। কারণ, আমাদের কথার শব্দের অন্যদের সমস্যা হবে। প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বেশ সাহস পেলাম। মজার ব্যপার হচ্ছে সবাই বলে বাংলার সিলেবাস অনেক বড়, ফুল এনস্যার করা যায় না। আমি শুনে শুনে পরীক্ষা শেষ হবার ৫ মিনিট আগে শেষ করেছি।

রিফাত ভাইয়ের বাসায় মোট ৩৫ দিন ছিলাম। এই ৩৫ দিনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে। পড়াশোনা করার জন্য একজন মানুষের এত আগ্রহ তা রিফাত ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। দুইজন মিলে টিম ওয়ার্ক করে আমরা পড়েছি। আমি টেপ রেকর্ডার করে পড়া রেকর্ড করে দিয়েছি রিফাত ভাই তা বারবার শুনে মুখস্থ করে ছিলেন। রিফাত ভাইয়ের বাসা থেকে একটি অভ্যাস সাথে করে নিয়ে এসেছি তা হল বই পড়ার অভ্যাস। আগে পাঠ্যবই এর বাহিরে অন্য বই পড়ার অভ্যাস খুব সীমিত ছিল। রিফাত ভাইদের পারিবারিক পাঠাগার ছিল। সেখানে অনেক বই ছিল। সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ে অবসর সময় কাটাতাম। ধীরে ধীরে পরীক্ষাগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছিল আর আমার মনের ভয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। ভালো ফলাফল করতে পারবো তো?

রিফাত ভাইয়ের বাসা থেকে ফিরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করতাম যেন রিফাত ভাই এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়। ওনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এত আগ্রহ দেখে আমারো অনেক আগ্রহ হল আমাকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। রিফাত ভাই এইচ এস সি পরীক্ষায় ৩.৭০ পেয়ে পাশ করলেন (অপশনাল বিষয় বাদে) তিনি তো মহাখুশি। আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত ফর্ম তুলে পরীক্ষা দিতে পারবেন।
তখন মোবাইল ফোনের এত চল ছিল না। রিফাত ভাই এর কোন নাম্বার আমার কাছে ছিল না। শুধু ওনার বাড়ির ঠিকানা আমি জানতাম। একদিন ওনার বাসায় গিয়ে জানতে পাই ওনারা মগবাজার বাসায় চলে গিয়েছেন। আমিও আমার কলেজের পড়াশোনা, টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। মাঝে মাঝে রিফাত ভাই এর কথা মনে পড়ে তিনি কি আসলেই ঢাবিতে চান্স পেয়েছেন কিনা তা আর জানা হল না। আমিও এইচ এস সি পাশ করে প্রথম বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম এবং তার পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসলাম। বন্ধু বান্ধব এর কাছে রিফাত ভাই এর গল্প বলতাম কিন্তু তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন তা বলতে পারতাম না। এভাবে দিন গিয়ে মাস যায়। মাস ঘুরে বছর। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষ এর পথে।

একদিন সূর্যসেন হল থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি একজন অন্ধ ভাই হলের ভেতর প্রবেশ করছে। তাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। আমি তার কাছে যেতেই আবিষ্কার করলাম আরে ইনি তো আমাদের রিফাত ভাই। তার কাছে গিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। তিনিও আমাকে চিনতে পারলেন। একজন আরেকজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই দৃশ্য সত্যি রোমাঞ্চকর ছিল এবং দেখবার মত দৃশ্য ছিল। কথা প্রসঙ্গে জানতাম পারলাম তিনি সার্টিফিকেট তুলতে এসেছেন। ওনার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে তিনি অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন। বিধাতার কি লিখন দেখুন! একসাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি কিন্তু কেউ কাকে দেখলাম না গত চার বছর। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর শেষে আমার বিবিএ শেষ হবার পথে তখন রিফাত ভাই এর সাথে দেখা।

আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব করি এর জন্য যে আমি যার শ্রুতিলেখক হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম তিনি আজ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে বিদ্যাঅর্জন এর সুযোগ পেয়েছেন। রিফাত ভাইকে সালাম তার এই হার না মানা পরিশ্রম, অধ্যাবসায়কে। তিনি ওনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছান সেই কামনা করি।

একজন দৃষ্টিহীন ভাই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে তাহলে তুমিও পারবে। বর্তমান সময়কে কাজে লাগাও আর মনে প্রাণে চাও তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাও। পরবর্তী পর্বে এই স্বপ্ন নিয়ে কিভাবে আগাতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করবো। সে পর্যন্ত তোমরা ভালো থাক।

আলামিন মোহাম্মদ
মোটিভেশনাল স্পিকার
মিশনপাড়া, যশোর।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×