সম্প্রতি শাহবাগে দুর্ঘটনায় ছাত্র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। যার যেখানে আঘাত লেগেছে সে সেটুকু নিয়েই বাকযুদ্ধে নেমেছে। আবেগের স্ফুরনে অনেকেই রীতিমত টালমাতাল অবস্থা। বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার অনুরোধ জানিয়েই এই পোষ্ট লেখা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অনেক দিয়েছে। একটি মধ্যবিত্ত তৈরি করেছে, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটিয়েছে, বাংলাভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের প্রস্তুতি ও নেতৃত্ব দিয়েছে। দার্শনিক আহমদ ছফা এভাবেই মুল্যায়ন করে গেছেন।
সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব গভীর ও স্পর্শকাতর। এদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। এদেশের জনগনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক আবার জনগন বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে ও নেয় সবসময়। এজন্যই ঢাবি'র ভালো ও মন্দ দুই দিক নিয়েই জনগনের মতামত ও উৎকণ্ঠাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমরা কিছু লেখার সময় প্রায়ই যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি দেখাই ও তথ্য কমের পাশাপাশি ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করি। এমন কারোই করা ঠিক নয়। অবশ্য একথা সত্য যে, আমরা বরাবরই আবেগপ্রবন জাতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই মুক্তবুদ্ধি চর্চার পাদপীঠ। সেখানে শুধু যেকোন সময়ের বর্তমানে সংশ্লিষ্টরাই প্রতিনিধিত্ব করবে এমন নয়। সাবেকরাও যাবেন ভাবীকালের প্রতিনিধিরাও যাবেন। পাশাপাশি সারেদেশবাসীও নির্বিবাদে যাতায়াত করবে এমন নিশ্চয়তা সংশ্লিষ্টদেরই দিতে হবে। এক্ষেত্রে আচরনগত অবৈষম্যতায় সকলকেই মুক্ত বিচরনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হতে হবে।
অনেকেই ঢাবি আর ক্যান্টনমেন্ট এই দুটোকে একই কাতারে নিয়ে যেতে চান। তাদের মনে রাখতে হবে ক্যান্টনমেন্টে বাইরের গাড়ি প্রবেশে বিধিনিষেধ অথবা সেনানিবাস জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু ঢাবি নিয়ে তেমন ভাবনা অবান্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা- কর্মচারীরা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দেয়, সিটি কর্পোরেশন থেকে দেশীয় স্বামর্থ অনুযায়ী নাগরিক সুবিধাও ভোগ করেন সবাই। কাজেই ডিসিসি ঢাবিতে অনধিকার চর্চা করার সুযোগ নাই।
আমাদের জেনে রাখা উচিত, ঢাবি প্রতিষ্ঠার সময় যে ঢাকা শহরের উত্তর প্রান্তে ছিল। ক্রমেই ঢাকা শহর বৃদ্ধি পেয়ে উত্তর- পূর্ব ও পশ্চিমে বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও শহরের মধ্যিখানে পড়ে গিয়েছে। তাছাড়া ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই বঙ্গের মানুষকে শিক্ষিত করতেই। সেই শিক্ষার ধারাবাহিকতায় ঢাবি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে না পারলেও রাষ্ট্র গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। ঢাবি’র একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে এটা অস্বীকার করার করার উপায় নাই।
১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে ৩টি অনুষদের অধীনে ১২ টি বিভাগে ১১০৫ জন ছাত্রছাত্রী(১জন ছাত্রী)এবং ৩ টি আবাসিক হল নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯ এ ১৬৯৩জন, ১৯৭০-৭১ সেশনে ৭৪০৭জন মাত্র ছাত্রছাত্রী ছিল। ১৯১১ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল ১,০৮,৫৫১ জন, ১৯৫১ সালে ২,৭৩,৪৫৯জন, ১৯৬১সালে ৩,৬২,০০৬জন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ধরা হয় ৩,৬৮,৫৭৫ জনের কিছু বেশি। ঢাবি ক্যাম্পাস বর্ধিত হয়ে ১৯৬১-৬২ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানে টিএসসি নির্মিত হয়। ষাটের দশকেই কলাভবন স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান স্থানে ঠিকানা নেয়। তারপর থেকে কেবলই স্থান সংকুচিত হয়েছে আর গাছপালা কেটে নতুন বিল্ডিং তৈরি হয়েছে যা এখনো চলছে। অনন্যেপায় হয়ে বিভিন্ন ভবনের ভার্টিক্যাল এক্সটেনশন করা হচ্ছে। বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের জনসংখ্যা, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা, বিভাগ ও অনুষদের সংখ্যা, ইন্সটিটিউট ও হলের সংখ্যা। কমেছে কেবলই সবুজ ঘাসের চত্বর। শিক্ষার মান সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপরে নির্ভর করে। কাজেই দেশ পরিচালন ব্যবস্থা যেমন বা যে মানের আমাদের সামগ্রিক শিক্ষায় ব্যবস্থাপনা ও মানও একই সমমানের হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
বর্তমানে ঢাবির ছাত্রছাত্রী সংখ্যা চল্লিশ হাজারের কম নয়। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি বা পৌনে দুই কোটি ধরা হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটির বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সময়ের প্রয়োজনে পরিধি বাড়িয়েছে, ঢাকা শহরও সময়ের প্রয়োজনেই বেড়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। কাজেই কোনটাকে খারিজ করে অন্যটা বাড়েনি বা কমেনি। দেশের মানুষের প্রয়োজনেই সবকিছু হয়েছে ও হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার গুন-মান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু বিরুদ্ধতা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি অর্জনকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমাদের দেশে সেরকম ভাবার অবকাশ নাই। তবে কেউই কাউকে ছোট না করেও আলচনা করতে পারি এটা দুই পক্ষকেই প্রমান করতে হবে।
আমি মনে করি আমাদের ছাত্রের, শিক্ষকের, ড্রাইভারের, মালিকের, নেতার, কর্মীর, কৃষকের, শ্রমিকের সবারই সচেতন হতে হবে। সচেতনতার পূর্ব শর্ত শিক্ষাগ্রহন। রাষ্ট্রকে সকলের শিক্ষাগ্রহনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারপরে আসবে নৈতিকতার প্রশ্নটি। যে নৈতিকতা আমাদেরকে সহনশীলতার দীক্ষা দেবে। অন্যায় করতে বাঁধা দেবে। বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের এক্ষেত্রে দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কারন সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঢাবিতে গিয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে সুনাম করলেই কেবল ঢাবির সম্মান অক্ষুন্ন থাকবে।
মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র তৌহিদুজ্জামানের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও শান্তি কামনা করছি।
এই সংক্রান্ত পোষ্টে যারা উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে কটূক্তি করে বা গালাগালি করে তারা বিকৃত মস্তিষ্কের প্রানী। তাদের এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধের পাশাপাশি তারাও সুস্থ আচরন করুন এমন প্রত্যাশাও রইল। নতুবা যেকারো অসংলগ্ন আচরনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধের সংকল্পতায় আবদ্ধ হওয়ার আহবান রইল।
যুক্তি যদি হয় পরাজিত, মুক্তি তখন হয় নির্যাতিত। সবাই যুক্তিবাদী হউন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ৮:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




