বিশ্বজিত্ চৌধুরীর 'নার্গিস' অবলম্ভনে রচিত বিদ্রোহী কবি নজরুলের সুদীর্ঘ ও চরম নাটকীয় প্রেম কাহিনীর সংকলিত সংস্করণ-
'একজন কবি ও নারী'
(২য় পর্বের ধারাবাহিকের আজ শেষ পর্ব)
থমথমে উদভ্রান্ত চেহারায় বাসর ঘরে ঢুকল নজরুল।এতকাল কবির চোখে যে প্রেম দেখে স্বপ্ন বুনেছে নার্গিস,সে চোখ আজ ক্রোধে উন্মক্ত।তবু নার্গিস নিজেকে সামলে নেয়।নজরুল বিচলিত হয়ে নার্গিসকে প্রস্তাব দিল,'চলো,রাত ফুরোবার আগেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।'পরমুহূর্তেই নার্গিস দিশেহারা হয়ে পড়ে ২টা দিন থাকতে চাইল।নজরুল বলল,'আমার পক্ষে আর ১ দিনও এই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়।যদি সাথি হতে চাও তো চলো ,না হয় একাই চলে যাব।কুমিল্লার অতিথিরা রাতেই ফিরে যাবে।'নার্গিসের বিস্ফোরিত চোখ গভীর বেদনায় কবির বুকে আশ্রয় চায়।কবি অনড়।সে যাবেই।'যেতেই আমাকে হবে,তবে শ্রাবণ মাসে আসছি,তোমাকে নিয়ে যাব,মাত্র কটা দিন,ভেবো না।'
যে রাত প্রতিটি নারীর জীবনে আমরণ স্মৃতির উপলক্ষ হয়ে থাকে,সেই স্মরণীয় রাতে অবিস্মরণীয় কাণ্ড ঘটিয়ে নজরুল চলে গেল।
অতি প্রিয়জনের জন্যে অপেক্ষার রজনী দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।ফুরোতে চায় না।নার্গিস তার হৃদয় মন্দিরে এতকাল যার জন্যে পূজা দিয়েছে সে মানুষটি কি তা জানে?ভেবে নার্গিসের শুধু চাপা কান্নায়ই আসে মুখের হাসি উবে যায়।
এরই মধ্যে খবর এল ধূমকেতুতে প্রকাশিত 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতার জন্যে ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহী মামলায় কবিকে ১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।আরও একটা অপ্রত্যাশিত খবর নার্গিসকে বিচলিত করে তুলে।নিজের মন সেটা মানতে চায় না।তবু দুলি মানে আশালতার সাথে নজরুলের প্রেমের গুঞ্জন সে কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না।কিছুদিনপর খবর এল আহলে কিতাব মতে একজন মুসলমান কবির সাথে প্রমীলার (আশালতা) বিয়ে হয়ে গেল।কুমিল্লা-কলকাতা সবখানে এ নিয়ে তীর্যক ও সরস মন্তব্যে পত্রপত্রিকার পাতা ভরে উঠেছে।অজ পাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ে,ভালোবেসে যাকে নার্গিস নামে ডেকেছিল সে নির্বাক হয়ে যায়।দুর্বিষহ বেদনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু উপেক্ষিত থেকে যায়।নিথর দেহের মাঝে আবেগি মন হাহাকার করে উঠে।কিছুতেই সে সান্ত্বনা খোঁজে পায় না।
অহর্নিশ যন্ত্রণায় তবু দিন চলে যায়।নার্গিসের জন্যে বিয়ের প্রস্তাবও আসে।কিন্তু সেই যে শৈশবে অন্য একটি মানুষকে গ্রহণ করেছিল মনে প্রাণে,এত অবহেলা সত্ত্বেও মুছে ফেলতে পারে না তাকে।মাত্র কিছুদিনের স্মৃতির এতই বিস্তার!
কলকাতা থেকে নজরুলের চিঠি এল।ভালোবাসার সরল স্বীকারোক্তি ও স্মৃতিপটে জমে থাকা কিছু ঘটনার বয়ান আছে তাতে।নার্গিসের মনে দ্বিধা খেলে যায়।'তবে কি কবি চায় আমি শুধু তারই থাকি?আত্মত্যাগের এই মহত্ত্ব চাপিয়ে দিতে চায় আমার ওপর?'
সব বাঁধা উপেক্ষা করে নজরুলের সাথে দেখা করতে ছুটে যায় নার্গিস।ধুকধুক বুকে উত্তাপ চেপে রেখে চোখে চোখ পড়ল।নজরুল বলল,'তুমি ফিরে যাও নার্গিস,আমি ঢাকা আসছি,তখন একটা ব্যবস্থা করব ....।'
নার্গিস প্রশ্ন করে,'সত্যিই আসবে?'
আবারও একই কথা বলল নজরুল,'সে ঢাকা আসবে ...
আমি আজ আসি'বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কবির কথায় নার্গিস আস্থা রাখতে পারছে না।সে জানে অবলা নারীকে এ শুধু সান্ত্বনার বাণী শোনানো।
ছোট মামা আজিজুল হাকিম নামের এক পরিচিত জনের সাথে নার্গিসের বিয়ে ঠিক করেন।মামার লাইব্রেরির ম্যানেজার।নার্গিসেরও দ্বিমত নেই।চলতে চলতে অবচেতন মনে কখন যে সেই মানুষটিকে আপন করে নিয়েছে বুঝতেও পারে নি।বিয়ের সব বন্দোবস্ত হল।নজরুলের কাছ থেকে তালাকনামাও আনা হয়েছে।এই হাকিমই তাকে নজরুলের ঢাকায় আসার খবর দিয়েছিল।রানু সোম নামে এক মেয়েকে রাত-বিরাতে গান শেখাতে যেত কবি।কবির এই খামখেয়ালী জীবন পাড়ার লোক মানতে পারেনি।কবিকে মেরে রক্তাক্ত করেছিল।শোনা গিয়েছে ফজিলাতুন্নেসারও প্রেমে পড়েছিলেন কবি।জ্যোতিষবিদ্যা জানা নজরুলের কাছে হাত দেখাতে চেয়েছিলেন।প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল কবি।খ্যাতিমান সুদর্শন যুবককে অবলীলায় ফিরিয়ে দেন ফজিলাতুন্নেসা।প্রত্যাখাত হয়ে বির্পর্যস্ত হয়ে পড়েন কবি।নার্গিস অবাক হয়ে এসব কথা শুনে শুধু।অন্য কিছু জানতে আগ্রহ দেখায় না।কিন্তু বিয়ের আগের দিন নজরুলের চিঠি এল।কেপে উঠল শরীর।
'জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম,তাই মরণে পাব সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব।প্রেমের ভুবন তুমি বিজয়িনী আমি পরাজিত।আমি আজ অসহায়।
বিশ্বাস করো আমি প্রতারণা করিনি।আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে,পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।তোমার নব অভিযাত্রা শুভ হোক ।'
নিত্য শুভার্থী
নজরুল
নার্গিস অপলক তাকিয়ে থাকে।কী নির্মম স্বার্থপর-নার্গিস এক মনে ভাবে।চোখের সামনে পুরনো সব স্মৃতি ভেসে উঠে।এক জীবন অন্ধকারে জাগিয়ে রেখেছে তাকে।যখন সে আলোতে আসতে চাইছে তখন আবারও কবির নির্লিপ্ত আকাঙ্ক্ষা -'জীবনে পেয়ে হারালাম,তাই মরণে পাব।'
¤¤