কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এমন একটা ঘটনা লোকে শুনলেও হেসে গড়াগড়ি খাবে। বিশ্বাস করাটা তো বহু দূরের কেচ্ছা। তাও কিছুটা গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
আমি মানিব্যাগ ব্যবহার করি অনেক দিন। কলেজে প্রথম বর্ষে উঠে একটা মানিব্যাগ কিনেছিলাম দেড়শ টাকা দিয়ে। তারপর অনেক দিন সেটা চালিয়েছি। গত সপ্তাহে আমার সেই পুরনো হয়ে যাওয়া ছাল চামড়া উঠানো মানিব্যাগ টা চুরি হয়ে যায়। অগত্যা নতুন একটা না কিনে আমার আর উপায় থাকে না। কিনেও ফেললাম। সোজা সাড়ে তিনশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। চামড়ার মানিব্যাগ। খুললেই কেমন যেন একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। মানিব্যাগ টা কেনার সময় দোকানদার বলেছিল এটা নাকি এক পিসই আছে। আগে কখনো এমন জিনিস দোকানে আসেনি। কিভাবে তাদের কাটনের মধ্যে এসে পড়েছে তাও নাকি জানে না। এত কথা দোকানদার বলেছিল কারণ ওটার গায়ে কোন ব্র্যান্ডের নাম কিংবা কোন লেখা জোখা ছিল না। আমি হাসিমুখেই নিয়ে নিলাম ওটা।
এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। সমস্যা শুরু হয় এরপর। আসলে এটাকে সমস্যা বলব নাকি হ্যালুসিনেশন বলব বুঝতে পারছি না। অবশ্য হ্যালুসিনেশন তো একই ভাবে বারবার হতে পারে না। ফলে মনের মধ্যে খটকা বেঁধেই রয়েছে।
ঘটনার শুরু এভাবে -
গত তরশু আমি যথারীতি নতুন কেনা মানিব্যাগ নিয়ে বের হয়েছি। রিক্সা নিয়ে বত্রিশ নাম্বার থেকে আসাদগেট যাচ্ছিলাম। আসাদগেট নেমে রিক্সাওয়ালাকে বিশটাকা দেয়ার জন্য মানিব্যাগ বের করেছি। কিন্তু মানিব্যাগ খোলার পর আমি যা দেখলাম তাকে কি চোখের ভুল বলব কিনা জানিনা। আমি দেখলাম যে একটা মাত্র বিশটাকার নোট ছিল সেটা নেই। তার জায়গায় পড়ে আছে একটা দুই টাকার নোট। পাশের খাঁজটায় একটা পাঁচশ আর তিনটা একশ টাকার নোট ছিল। অগত্যা সেদিকে নজর দিতে হল। বিশটাকার নোটের ব্যাপার টা ভুলও হতে পারে ভেবে একশ টাকার নোট তুলতে যেয়ে যেই না পাশের খাঁজটা খুলেছি, অমনি আমি মনে হয় একশ ভোল্টের একটা শক খেলাম। একি দেখছি আমি?
সবগুলো একশ টাকার নোট উধাও। সেখানে সুন্দর ভাবে রাখা আছে তিনটা দশ টাকার নোট। আর পাঁচশ টাকার নোট টা হয়ে গেছে পঞ্চাশ টাকা। এবার নিশ্চিত হলাম যে আমি ভুল দেখিনি। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলে এলাম। যেখানে যাবার জন্য বের হয়েছি সেখানে আর যাওয়া হল না। ইচ্ছে করছে না। মনটা অস্থির হয়ে ছিল। অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে ধুপ করে একটা জায়গায় বসে পড়লাম। কি হচ্ছে এসব? সব টাকা গুলো তার ক্ষুদ্রতম সংস্করণ হয়ে যাচ্ছে। আমি কি ঠিক দেখছি? নাকি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
পরের দিন। আমি রাত্রে ভাল ঘুমাতে পারিনি। অনেক উল্টা পাল্টা স্বপ্ন দেখেছি। মন টা ভাল নেই। সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মানিব্যাগ টা যে দোকান থেকে কিনেছিলাম সেখানে চলে যাবো। ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মানিব্যাগে মাত্র দশ টাকা নিয়েছি আজ। বাকি টাকা পকেটে রেখেছি। আমাকে দেখতে হবে আমি ভুল নাকি ঠিক।
সেই দোকানে গিয়ে সোজা দোকানদারকে বললাম -
সত্যি করে বলুন তো এই মানিব্যাগ কোথায় পেয়েছেন আপনারা?
- স্যার আপনি শুধু এটা জানার জন্য আবার এসেছেন?
- জী। বলুনতো এটা কোথাকার?
- এটা আসলে এক পর্যটক আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন।ভদ্রলোক মিশরীয়।
- আচ্ছা। এই মানিব্যাগের কি এমন কোন বিশেষত্ব আছে যা আপনারা আমাকে বলেননি?
- না তো স্যার। তবে একটা কথা বলা হয় নি।
- কি কথা?
- ভদ্রলোক বলেছিলেন, এটা নাকি সম্পূর্ণটাই লেদারের। সামান্য রেক্সিন কিংবা অন্য কোন জিনিস নেই।
- আচ্ছা কি জাতীয় লেদার সে সম্পর্কে কিছু বলেছে?
- তা বলেনি। তবে বলেছে কি এক বিশেষ ধরনের পশুর চামড়া থেকে বানানো। সে পশু নাকি এখন মিশরেও পাওয়া যায় না। মানে বিলুপ্ত আর কি!
- ও আচ্ছা। ঠিকাছে আসি।
বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়েই সোজা পিসির সামনে বসলাম। ইজিপ্সিয়ান এনিম্যাল লিখে সার্চ দিলাম। বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির পরিচয় আসতে লাগলো। কিন্তু এদের মধ্যে এমন কোন প্রাণী নেই যাদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত কোন ক্ষমতা আছে। পিসি ছেড়ে উঠে পড়লাম।
এরপরের দিন সকালে হাত মুখ না ধুয়েই পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে গেলাম। ওই চামড়ার মানিব্যাগে যে কিছু একটা সমস্যা আছে এ ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত হয়ে গেছি। কারণ অর্ধেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেলে মানিব্যাগ টা কি মনে করে হাতে নিলাম। খুলে দেখি সকালে যে দশ টাকার নোট টা রেখেছিলাম গতকাল, সেটা এক টাকার নোট হয়ে পড়ে আছে ।
লাইব্রেরী তে গিয়ে বহু খোঁজাখুঁজি করে মিশরীয় ফারাও ইতিহাসের উপর বিশাল এক বই টেনে বের করলাম। সচিত্র বই। তেমন কেউ এতে হাত দেয় না বলেই মনে হল। ভিতরটা খুলতেই একটা ভ্যাপ্সা গন্ধ নাকে লাগলো।
তবে এবার একটু কাজ হল বলে মনে হল। কয়েক অধ্যায় উল্টানোর পর অনেক ধরনের পশুর ডিটেইলস দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা পশুর ছবির দিকে চোখ আটকে গেল। এ কেমন ধরনের জন্তু? কতকটা পাখির মত। প্রচন্ড ধাঁ্রালো ঠোঁট বলেই মনে হয়। পিছনের দিকটা খানিক সরীসৃপের মত করে আঁকা।
এর ডিটেলস পড়ে থ হয়ে গেলাম। অন্য সময় হলে অবশ্য হেসে গড়াগড়ি খেতাম। এখন সে অবস্থা নেই।
এই জন্তু নাকি মিশরীয় ভেলকিবাজেরা পুষে রাখতেন। মানুষ কে হিপ্নোটাইজ করার কাজে লাগাত এটা। সে হিপ্নোটিজম মাঝে মধ্যে নাকি এমন গুরুতর হত যে ঐ ব্যক্তি কখনো কখনো বাস্তব থেকে একদমই হারিয়ে যেত।
এরপরের লেখাটুকু পড়ে আমি আরো জেঁকে বসলাম। এই বিশেষ ধরনের পশু মারা গেলে নাকি এর চামড়া ছালিয়ে নিয়ে ভেলকিবাজেরা একধরনের থলে তৈরি করত। এই থলেতে কোন জিনিস রাখলে তা আকারে ছোট হয়ে চোখে ধরা পড়ত। এবং এই থলে যদি মালিকের হাত ছাড়া আর কারো হাতে গিয়ে পড়ত তাহলে তার মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটত।
আর পড়তে পারলাম না। বাসায় চলে এলাম। রহস্যময় টাকার থলে টা উল্টে পাল্টে দেখছি বারান্দায় বসে। ওর ভিতরে এক টাকার নোট টা অক্ষত আছে তখনো। কি মনে করে চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সোজা হাতের নিরীখে টাকার থলে (মানিব্যাগ) টা গিয়ে পড়ল সামনের ডাস্টবিনে। হয়ত একসময় ওটা অন্য কোন সামগ্রী হয়ে অন্য কারো হাতে যাবে।
এইটুকু লিখে খাতাটা বন্ধ করে দিল কাব্য। মাঝে মধ্যে যে কিসব আজগুবি কাহিনী লেখে তা পড়ে ওর নিজেরই হাসি পায়। নিজে হাসার জন্যই অবশ্য লেখে। যাই হোক জড়তা কাটানোর জন্য বাইরে চায়ের দোকানে এসে চা অর্ডার করে ও। চা খেয়ে বিল দেবার জন্য কাব্য উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ও বিল দিচ্ছে না। দাঁড়িয়েই আছে। ওর চোখ মানিব্যাগের মধ্যে। সেখানে একটা এক টাকার নোট। কিন্তু থাকার কথা ছিল দশ টাকা।
হ্যালুসিনেশন নয় তো?