সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার বন থেকে লোকালয়ে নেমে এসেছিল এক বিরল প্রজাতির বানর। স্থানীয় লোকজন চিনতে পারেনি অদ্ভুত দর্শন প্রাণীটিকে। তারা সেটিকে পান্ডা ভেবেছিল। মহা উৎসাহে নানা কায়দা-কৌশল করে তারা আটকে ফেলেছিল বানরটিকে। তার খেসারত দিতে হয়েছে নিরীহ বন্য প্রাণীটিকেই। নিজেকে রক্ষা করতে ছোটাছুটি করতে গিয়ে পিছু ধাওয়া করা লোকের হাতে আহত হতে হয়েছে তাকে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। লোকজন আটকে ফেলে বানরটিকে।
এদিকে বন্য প্রাণী আটকের খবর পেয়ে গতকাল রোববার সকালে বিডিআর সদস্যরা এসে বানরটিকে লোকজনের কবল থেকে উদ্ধার করেন। এরপর তাঁরা সিলেট বিভাগীয় বন বিভাগের বন্য প্রাণী সংরক্ষক কমিটির কাছে বানরটি হস্তান্তর করেন। বিডিআর সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার জৈন্তাপুরের বন এলাকা থেকে এলাকার কিছু লোক বানরটিকে আটক করে। বিরল প্রজাতির এই বানরটিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ কৌতূহল দেখা দেয়। অচেনা প্রাণীটিকে তারা পান্ডা বলে ভেবেছিল। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় ২১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ওই দিনই এলাকায় গিয়ে বানরটি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
২১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল জানান, বানরটি অভুক্ত ছিল। দুই দিন বিভিন্ন রকমের খাবার খাইয়ে এটিকে সতেজ ও খানিকটা সুস্থ করে তোলা হয়। এরপর রোববার বানরটিকে বন বিভাগের হেফাজতে দেওয়া হয়।
সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন সংরক্ষক ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কমিটির সদস্যসচিব দেলওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে জানান, এটি আদৌ পান্ডা নয়। প্রাণীটি বিরল প্রজাতির মধ্যবয়সী লজ্জাবতী বানর। চিরসবুজ ও বৃষ্টিপাত কম এমন এলাকায় এদের বসবাস। বন, ঝোপঝাড়ে কদাচিৎ এরা নেমে আসে। অধিকাংশ সময় লজ্জাবতী বানর বনের লম্বা গাছগুলোর মগডালে থাকে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনে এদের বাস রয়েছে।
বন্য প্রাণীবিদ শরীফ খান জানিয়েছেন, লজ্জাবতী বানরের ইংরেজি নাম Slow loris এবং বৈজ্ঞানিক নাম Nycticebus coucang। অনেক এলাকায় একে মুখচোরা বানরও বলে। এর কারণ লোকজনের সামনে পড়লে এরা সাধারণত দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। তাছাড়া গভীর জঙ্গলে থাকে বলে এই বানরটি লোকজনের তেমন পরিচিতও নয়।
শরীফ খান জানান, লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী। বিশেষ প্রয়োজন না হলে দিনে এরা চলাচল করে না। বানর হলেও এরা মোটেই বাঁদরামিতে পটু নয়। চালচলন ও স্বভাবেও অন্যান্য বানরের চেয়ে ধীরস্থির। অন্য বানরের মতো এরা সাধারণত হাত দিয়ে খাবার মুখে তোলে না। খাদ্যে সরাসরি মুখ লাগিয়ে খায়। ছোট পোকামাকড়, ছোট পাখি ও ডিম এবং গাছের কচিপাতা এদের খাদ্য। এদের লেজ খুবই ছোট। চট করে চোখে পড়ে না। লেজ ছাড়া আকার ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। এরা গাছের ডাল পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতে পছন্দ করে। বছরে একবার একটি করে বাচ্চা দেয়। নিজেদের বসত এলাকা ছেড়ে খুব বেশি দূরে এরা যায় না। লজ্জাবতী বানর পোষ মানে। পোষা অবস্থায় কলা বা অন্যান্য ফল খেয়ে খাদ্যাভ্যাস বদলে নিতে পারে। সিলেট ছাড়াও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলেও একসময় লজ্জাবতী বানরের বসবাস ছিল। তবে দেশে এখন এই নিরীহ প্রাণীটি অত্যন্ত বিপন্ন।
গতকাল দুপুরে বিডিআর সদস্যদের কাছ থেকে বানরটি গ্রহণ করে বন কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে এটিকে লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত করা হবে।