somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুহাশের যে চিঠি বাবার কাছে পৌঁছেনি

০৩ রা আগস্ট, ২০১২ সকাল ৮:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন নুহাশ। কিন্তু সে চিঠি বাবা হুমায়ূন আহমেদের কাছে পৌঁছেনি। তিনি পড়তে পারেননি দীর্ঘকাল দূরে থাকা প্রাণপ্রিয় ছেলের একান্ত কথাগুলো। মৃত্যুর আগে জেনে যেতে পারেননি তার প্রতি তার ছেলের ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি আর ভালোবাসার যন্ত্রণা-আকুতি।


সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে নুহাশের সেই চিঠি ছাপা হয়েছে। প্রাণপ্রিয় বাবা জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন
আহমেদের কাছে লেখা সেই মর্মস্পর্শী চিঠির বাংলা অনুবাদ বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। আশা করি, চিঠিতে বাবার প্রতি নুহাশের অনুভূতি, পিতৃস্নেহবঞ্চিত এক পুত্রের হাহাকার পাঠক-মনের অতলে নাড়া দেবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠির আগে একটি মুখবন্ধ লিখেছেন নুহাশ। সেখানে তিনি লিখেছেন—
বাবার প্রথম অপারেশনের অল্প ক’দিন পর জুলাই মাসে আমি চিঠিটা লিখি। বাবার পাশে থাকা আংকেল-আন্টিদের কাছে ই-মেইলে চিঠিটা পাঠানোর কথা ভেবে রেখেছিলাম। চেয়েছিলাম, সম্পূর্ণ সচেতন থাকা অবস্থায়ই বাবাকে যেন চিঠিটা পড়ে শোনানো হয়। কিন্তু সেই চিঠি আর পড়া হয়নি তার। মৃত্যুর আগে নিজের চেতনাও আর কখনই পুরোপুরি ফিরে পাননি তিনি। বাবা চিঠিটা পড়তে না পারায় আমার মনে সৃষ্টি হওয়া শূন্যতা হয়তো আর কোনোদিনই ঘুচবে না।

একান্তই ব্যক্তিগত একটা চিঠি। তবে এ মুহূর্তে আমার একান্ত অনুভূতি, যদি আমি চিঠিটা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করি, চিঠির অনুভূতি যদি অন্য কাউকে স্পর্শ করে, আমার হৃদয়ের শূন্যতা এতে হয়তো কিছুটা হলেও পূরণ হবে।

বাবা,
আশা করি তুমি এখন ভালো বোধ করছো। অবশ্য আমার নিজের শরীরও খুব একটা ভালো নেই। আমার নাকি টাইফয়েড হয়েছে। অসুখটা আমার পাকস্থলীকেও দুর্বল করে ফেলেছে। পুরো এক সপ্তাহ ধরে চালের তৈরি বিরক্তিকর একটা খাবার ছাড়া আমাকে আসলে কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি। আমার ধারণা, এটিই ‘জাউভাত’।

অসুস্থতার এই পুরোটা সময় বিছানায় শুয়ে থেকেছি আর বাধ্য হয়েছি জাউভাত গিলতে। পুরোটা সময় পার করেছি আমার পছন্দের ভালো ভালো খাবারের কথা কল্পনা করে।

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আমার গলদা চিংড়ির কথা মনে পড়লো। গলদা চিংড়ির কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মনে পড়ে গেল অনেক কিছুই, বিশেষ কিছু।

মা ও তোমার মধ্যে সবে ডিভোর্স হয়েছে। এ সময়ের পুরো পরিস্থিতিই আমার জন্য অনেক কঠিন। প্রতিটি মুহূর্ত আমার কেটেছে এই কামনা করে: খুব শিগগিরই সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। তুমি আবার আগের মতোই আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।

কিন্তু যখন সত্যি সত্যি ডিভোর্স হয়ে গেলো, তখনই অনুভব করলাম নির্মম সত্যটা। বুঝতে পারলাম, ফিরে আসার দরজাটা এবার চিরকালের জন্যই বন্ধ হয়ে গেলো।

কেমিস্ট্রির ভাষায় যাকে আমরা বলি দহন। যখন পুড়ে গেলে বস্তু আর কখনই আগের রূপে ফিরতে পারে না, এমন কিছু।

তবে আমি সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলাম অন্য একটা ব্যাপারে; আশঙ্কা ছিলো, এর পরিণতিতে তুমি হয়তো আমার থেকে দূরে সরে যাবে। আগের দৃষ্টিতে তুমি আমাকে দেখবে না---এ ভাবনাও আমাকে তাড়িত করতো প্রতিটি মুহূর্ত।

ডিভোর্সের পর দিনকয় কেটে গেছে। এ সময়ই একদিন হঠাৎ তুমি আমাকে ডাকলে। বললে, একটু আগেই বাজার থেকে ফিরেছো তুমি। সঙ্গে এনেছো বিশাল সাইজের গলদা চিংড়ি। তোমার ইচ্ছা করছে এগুলো আমাকে রান্না করে খাওয়াতে। তোমার ইচ্ছা আমরা দু’জনে মিলে যেনো তোমার বাড়িতে বসে এগুলো খাই।

কিন্তু এটা যে তখন সম্ভব ছিলো না, তুমি-আমি দু’জনেই তা জানতাম। আসলে ওই রকম পরিস্থিতিতে এসবের কথা কল্পনাতেই আসে না।

তবে ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি...

আধা ঘণ্টা পর ইন্টারকমের রিং বেজে উঠলো। দারোয়ান জানালো, বাবা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে জীবন্ত গলদা চিংড়ি। আনন্দিত, উত্তেজিত আর হতবিহ্বল আমি এক ছুটে নিচে নেমে গেলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না, গলদা চিংড়ি হাতে বাবা সত্যি সত্যি দরজা পর্যন্ত এসে পড়বে।

তুমি আমাকে বললে, ‘সত্যিই চেয়েছিলাম দু’জনে মিলে এগুলো খাব। কিন্তু এ মুহূর্তে তো আসলেই সম্ভব নয়। তবে আমি কথা দিচ্ছি, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, যাই ঘটুক না কেনো, আমি তোমার চারপাশেই থাকবো। এমন একদিন আসবেই, যেদিন আমরা আবারও আগের মতোই একসঙ্গে গলদা চিংড়ি খাবো। কিন্তু এখন তুমিই এগুলো খাও, এটাই আমি চাই।’ এরপর তুমি আমার হাতে সেই বিশাল সাইজের জীবন্ত গলদা চিংড়িগুলোকে তুলে দিলে।

কিন্তু ছোট ছোট চোখ আর লম্বা লম্বা পায়ের অদ্ভূত প্রাণীগুলো ঠিক সে মুহূর্তেই আমার কাছে অন্য অর্থ নিয়ে ধরা দিলো। প্রাণীগুলো আমার চোখে ধরা দিলো আশার প্রতীক হিসেবে। আমি বুঝলাম, বাবা, তুমি আমার জন্য আগের মতোই আছো এবং আগের মতোই থাকবে; যেমনটা তুমি সব সময় ছিলে আমার জন্য।

তোমার পাশে যেটুকু সময় আমার থাকা উচিত ছিলো, তা থাকতে পেরেছি বলে মনে করি না আমি। যখন ফোন করে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, তখন তুমি আর কথা বলার অবস্থায় ছিলে না। তারপরও যখনই আমি তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, এত বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি যে নিজের মনের কথা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারিনি। অবশ্য কখনই তোমার মতো কথার কারিগর ছিলাম না আমি।

অপারেশনের আগে তুমি যখন ঢাকায় ফিরলে, তখন তোমাকে দেখা আমার জন্য ছিলো সত্যিই বেদনাদায়ক।

তোমাকে দেখতে যেতে তোমার বাড়ির দরোজায় প্রত্যেকবার আমাকে থামানো হতো, এটাও আমাকে বেদনা দিতো। সন্তান তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এ কথা দারোয়ানকে প্রত্যেকবার বলা, সব সন্তানের জন্যই তো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।

তবে এগুলো আসলে কোনো অজুহাতই নয়, তোমার প্রতি আমার কর্তব্যভার এসব অজুহাতে আসলে লাঘব হয় না। আমার উচিৎ ছিলো আরো অনেক বেশি সময় তোমার পাশে থাকা।

বাবা, আমি চাই সব কিছু বদলে দিতে।

আমি তোমাকে জানাতে চাই, আমার অস্তিত্বে তোমাকে অনুভব করি প্রবলভাবে, তোমার পাশে আরো অনেক সময় ধরে থাকতে চাই আমি। তোমাকে আরও বোঝাতে চাই, আমার ইচ্ছে মতো তোমার পাশে থাকতে পারছি না, এই অক্ষমতা আমাকে অহর্নিশ দহন করে।

এই চিঠিটাই তোমাকে আমার দেওয়া গলদা চিংড়ি।

তোমার ছেলে, নুহাশ
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×