দেখতে দেখতে এসে গেল আরেকটি উৎসব। হ্যাঁ, ঈদুল আজহা মানে কোরবানির কথাই বলছি। পশুর হাট, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, বাড়ির আঙিনায় এখন চোখে পড়ছে সুন্দর সুন্দর গরু-ছাগল। কোরবানির পশুর রশি ধরে বাচ্চারা হইচই করছে। কেউ শখ করে মাঠে চরাতে নিচ্ছে। ছাগলকে খেতে দিচ্ছে গম, কলার খোসা কিংবা কাঁঠালপাতা। নানা রঙের নানা আকারের এসব পশু দেখে মন ভরে, চোখ জুড়ায়। কোনোটির গায়ে তেল মেখে চমৎকার কেশবিন্যাশও করা হয়েছে। আবার কোনোটি সাজানো হয়েছে রঙিন কাগজ, জরি, লালসালু কিংবা রং লাগিয়ে। পরিচিতজন তো বটেই পথচারীরাও জানতে চাইছেন ‘দাম কত হলো ভাই?’ কেউ আবার মুঠোফোনে তুলে রাখছে নিজেদের কোরবানির পশুর ছবি।
কোরবানি এলে চারপাশে আরও অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ে। এসময় অলিগলির কলঘরগুলো সরগরম হয়ে ওঠে। চাল, মরিচ, মসলা, হলুদ গুঁড়ো করার কাজ চলে বিরামহীন। আগে এসব কাজের জন্য ছিল ঢেঁকি কিংবা বড় আকারের লোহার হামানদিস্তা। অবশ্য এখন বাজারে মোড়কজাত সব মসলা পাওয়া যায়। তারপরও ভালো মান, কম দাম আর ঐতিহ্যের কারণে কলঘরগুলো টিকে আছে।
এখন গাঁয়ের কামারশালায় ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। হাপরের ওঠানামার যেন আর শেষ নেই। এখানে মাংস কাটার জন্য দা, বটি, ছুরি ধার করতে আনছেন গৃহস্থরা। নগরে এ কাজের জন্য আছে আধুনিক শানঘর। এসময় বাজারে রুটি তৈরির বেলন, কাঠের পিঁড়ি, লোহার তাওয়ার চাহিদা বেড়ে যায়। ব্যস্ততা দেখা যায় গরুর শুকনো ঘাস-খড়, ভুসি, খৈল; মাংস রাখার চাটাই, কাটার জন্য কসাই, পশুর চামড়াÑএসব নিয়েও।
ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ সংগ্রহ করছেন বাস, রেল কিংবা লঞ্চের টিকিট। সবাই তো চান মা-বাবা-স্বজন আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। তারপরও কারণে-অকারণে অনেকে তা পারেন না। বাধ্য হয়ে কর্মস্থলে কিংবা বাসা-বাড়িতে কাটান ঈদের ছুটি। এটা তো ঠিকÑমন পড়ে থাকে নাড়ির কাছে, বাড়িতে। তাদের কারও অতীত স্মৃতি মনে পড়ে আর তাতে মন পোড়ে। আবার কেউ পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়েন দেশভ্রমণে মানে বেড়াতে। ছুটে যান কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সাফারিপার্ক, কুয়াকাটা, হিমছড়ি, নীলগিরি, সুবলং, আলুটিলা, ময়নামতি, জাফলং আর সুন্দরবনে। দূরে কোথাও যেতে না পারলে হাতের কাছেই তো কত শত অদেখা স্থান রয়ে গেছে। তাই তো ঈদে জমজমাট থাকে পর্যটন আর বিনোদনকেন্দ্রগুলো। জমজমাট অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকে দেশি টেলিভিশনের পর্দাগুলো।
কোরবানির ঈদে ছোটদের করণীয় তেমন বেশি নেই। তবে সতর্কতার যেন শেষ নেই। একটু অসতর্ক হলেই সাংঘাতিক বিপদ। ধরা যাক দা, বটি, ছুরি ইত্যাদি হাতিয়ারের কথা। চোখের পলকেই ঘটে যেতে পারে রক্তপাত। আবার গরু-ছাগলকে আদর করতে গিয়ে যদি লাথি, গুঁতো খেয়ে অক্কা পেতে হয়! অতএব সাধু সাবধান।
ঈদুল আজহাকে অনেক নামে ডাকা হয়। যেমন: ঈদ আল-কুরবান, ঈদ আল-নাহ্র, ইদুজ্জোহা, বাকরা ঈদ, বকরিদ, বক্রীদ ইত্যাদি।
ঈদ ও আজহা আরবি শব্দ। ঈদ অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আজহার অর্থ কোরবানি বা উৎসর্গ করা। হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ তা’লার আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে বড় ছেলে হজরত ইসমাঈলকে (আ.) কোরবানি করতে উদ্যত হন। মক্কার কাছের মিনা নামক স্থানে ৩৮০০ (সৌর) বৎসর আগে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে হজরত ইবরাহিমকে (আ.) ছেলের বদলে একটি পশু কোরবানির আদেশ দেন। আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে মুসলিমরা পশু কোরবানি দেন। এটি সমদের জন্য ওয়াজিব। এমনকি হাজিদেরও কোরবানি দিতে হয়। (সূত্র: বাংলাপিডিয়া)
উট, গরু, মহিষ অনধিক সাতজনের পে এবং মেষ, ছাগল, দুম্বা একজনের পে কোরবানি দেওয়া হয়। কোরবানির গোশ্তের তিন ভাগের এক ভাগ মালিক, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বাকি এক ভাগ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সব মাংস বড় বড় ফ্রিজে বা ঠান্ডা আলমিরাতে ভরে রাখলে হবে না কিন্তু! কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করা বা অন্যকে দান করা যাবে। কিন্তু চামড়া, গোশ্ত, হাড্ডি, চর্বি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভোগ করা জায়েজ নয়। আমাদের দেশে কোরবানির পশুর চামড়া বা তার অর্থ দরিদ্রদের কিংবা মাদ্রাসা বা এতিমখানার ছাত্রদের দান করা হয়।
কোরবানি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পাড়ার মসজিদের ইমাম, মা-বাবা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ করাই উত্তম। আজকাল বিভিন্ন বইও পাওয়া যাচ্ছে হাত বাড়ালেই।