জীবনের বাস্তবতা কাউকে শেয়ার করতে ভয় হয় তার পরেও অনেক সময় মুখ ফস্কে বলে ফেলি। অনেক সময় এটা হীতে বিপরীত হয়ে দেখা দেয়। তার পরেও আমার জীবনের একটা চরম বাস্তবতা আজ আপনাদের মাঝে শেয়ার করছি।
ব্যবসায়ী হিসাবে আমার হাতেখড়ি ২০০৮ সালে। সবেমাত্র চাকরী ছেড়ে ব্যবসায় নেমেছিলাম। অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মাঝে পার হয়ে গেছে আমার সাতটি বছর। রপ্তানী ব্যবসায়ে আমার রয়েছে খুবই ভাল অভিজ্ঞতা। ভাল বায়ারের সন্ধান এবং কাঁচামাল সংগ্রহ করার সোর্সিং আমার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ। আমার মূল বিজনেস ছেড়ে বেশী লাভের আশায় অন্য বিজনেসে ডাইভার্ট হতে চেয়েছিলাম। কথায় বলে, নদীর এপার দাড়িয়ে ওপারকে খুব ভাল মনে হয়। যাই হোক, আসল কথায় আসা যাক।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। বাংলাদেশে আলুর বাম্পার ফলন। কৃষকের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক সেই সাথে আমাদের মতো এক্সপোর্টারদেরও। মালয়েশিয়া হচ্ছে বাংলাদেশী আলুর এক বিরাট বাজার। আমি দীর্ঘদিন যাবত মালয়েশিয়ায় একজন ভাল বায়ার খুঁজতেছিলাম। অনেক কোটেশন এবং ইনকয়ারী পাঠিয়েছি কিন্তু বায়ারদের কাছ থেকে কোন রেসপন্স পাই নাই !! মনের মাঝে একটা খটকা লেগেই ছিল যে এত আলু মালয়েশিয়াতে যাচ্ছে কিন্তু বায়ারদের কোন রেসপন্স নাই কেন? বলা বাহুল্য বাংলাদেশ সরকার আলু রপ্তানীর উপর ২০% ভর্তূকী দিয়ে আসছে গত তিন চার বছর যাবত। আলুর ব্যবসায়ীরা সাধারণত ক্যাশ ব্যাক পাবার এই লোভনীয় অফারের পিছনে ছুটে চলেছে দিনের পর দিন। আমিও তাদের মত একজন, মাথার ভিতর একটাই ক্যালকুলেশন। আলু যে দামে কিনব সেই দামে বিক্রি করলেও ২০% লাভ। ২০% না হয় বাদই দিলাম, অন্তত ১৫% তো টিকবে? এমন একটু সুযোগ সবাই সন্ধান করে। আমিও নেমে পড়লাম উত্তর বঙ্গের আনাচে কানাচে আলুর সাপ্লাইয়ার ঠিক করার জন্য। পেয়েও গেলাম বিশ্বস্ত সাপ্লাইয়ার যারা রপ্তানীযোগ্য আলুর প্রসেসিং করতে পারে চমৎকার ভাবে। সাহস আরো বেড়ে গেল, বায়ার যা চায় আমি এখন তা দিতে পারব।
আমি আলু এসোসিয়েশনের এক্সিকিউটিভ কমিটির একজন সক্রিয় মেম্বর হওয়ার সুবাদে আমার সাথে পরিচয় হয় অন্যান্য সকল ব্যবসায়ীবৃন্দের। এক পর্যয়ে জানতে পারি মালয়েশিয়াতে যারা আলু রপ্তানী করে আসছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সেটাপ রয়েছে অর্থাৎ বায়ার এবং সাপ্লাইয়ার একই ব্যক্তি। প্রত্যেক ব্যবসায়ী তাদের পকেটের পয়সা খরচ করে নিজ উদ্যোগে আলু মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়। ওখানে হোলসেল মার্কেটে বা কোন চাইনীজ/বার্মীজ/পাকিস্তানী বায়ার আলুটা রিসিভ করে এবং তাদেরকে ১৫ থেকে ৩০ দিন সময় দেওয়া হয় আলুটা বিক্রি করার জন্য। এসকল ক্ষেত্রে আলু ব্যবসায়ীগণ থাকেন চরম বিপদে কারন মাল এবং টাকা দুটোই থাকে বায়ারের ক্যাপচারে। তবে বায়ার যদি নিজেদের আত্মীয় স্বজন হয় তাহলে টাকাটা ফেরত পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে বায়ার যদি অসৎ উদ্দেশ্য চারিতার্থ করতে চায় তাহলে আপনাকে আলু বিক্রির একটা টাকাও ফেরত দিবে না বরং আলু পঁচে গেছে এবং পঁচা আলু সরাতে এত এত খরচ হয়ে গেছে বলে একটা ফর্দ ধরিয়ে দিবে। এমন সব অভিজ্ঞতাই আমাকে শেয়ার করেছিল কলিগগণ।
আমি আলিবাবা সার্চ করে বেশ কিছু বাঙ্গালী বায়ার পেলাম। তাদের ওয়ান বাই ওয়ান ফোন দিলাম এবং মালয়েশিয়ায় আলুর বাজার কেমন জানতে চাইলাম। একজন বাদে সবাইকে কেমন পাকনা মনে হল। আমি জানতে পারলাম তার নাম রাজ্জাক, বাড়ি বগুড়ায়। তিনি নাকি দীর্ঘদিন আলু ব্যবসায়ের সংগে জড়িত। প্রতি সপ্তাহে চার কন্টেইনার আলু উনি বিক্রি করে। সাপোর্ট পেলে মাসে ২০ কন্টেইনার আলুও বিক্রি করা তার জন্য কিছুই না। ওনার কথা শুনে আমার মনে হতে লাগল যে একজন ভাল লোকের স্বাক্ষাত আমি পেয়েছি। অন্তত মালয়েশিয়ার বাজারে ঢুকতে গেলে একটা উইন্ডো প্রয়োজন। রাজ্জাককে আমি মালয়েশিয়ার উইন্ডো হিসাবে ট্রিট করতে থাকলাম। পার্টনারদের বললাম প্রথমেই আমাদের মালয়েশিয়া ভিজিট করা উচিত। রাজ্জাক আমাকে বলল, আসার সময় দুই কন্টেনার আলু যেন নিয়ে আসি তাহলে উনি চোখের পলকে কিভাবে বিক্রি করে দিতে পারে তা স্বচোক্ষে দেখার সুযোগ আমাদের হবে এবং তার উপর আমাদের আস্থা বেড়ে যাবে। প্রস্তাবটা আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হল। সমস্যা হচ্ছে রাজ্জাক সাহেবের কাছে টিটি পাঠানোর মতো পর্যাপ্ত টাকা নাই। তাকে না দেখে আমরা টাকা দিতে অশ্বস্তি বোধ করতে থাকলাম। তার পরেও ব্যবসা করতে হলে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে। তাই আমরা হুন্ডি করে তাকে দুই কন্টেইনারের যে মূল্য আসে তার ৩০% টাকা পাঠিয়ে দিলাম। উনি আমাদের জানাল যে একটা নতুন কোম্পানী উনি গঠন করেছে এবং সেই কোম্পানীর মাধ্যমেই তিনি আমাদের টিটিটা পাঠাবেন। আমাদের কেন যেন একটু সন্দেহ হল। কারন টাকা হাতে পাবার পর টিটি না পাঠিয়ে ভক্কর চক্কর কথাবার্তা? এছাড়াও উনি জানাল যে একজন চাইনিজ বায়ারের সাথেও তিনি ১০ কন্টেইনারের একটা কন্ট্রাক্ট করেছে। অন্য আরো একজন বায়ার ১২ কন্টেইনার নেবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। এসকল কথাবার্তা শুনে আমার সন্দেহ দুরভীত হল এবং আমি বেশ উৎসাহ বোধ করলাম। সকল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমরা তিন পার্টনার উত্তরবঙ্গে গিয়ে আলু কিনে চিটাগাং পাঠিয়ে দিলাম। শিপিং লাইন আমার পরিচিত হওয়ার সুবাদে রেফার কন্টেইনার পেতে দেরী হল না। যথারীতি উক্ত আলু সুন্দর ভাবে স্টাফিং হল। বাধ সাধল টিটি, কারন টিটি আমার ব্যাংকে না এলে ইএক্সপি ইস্যু হবে না এবং ডকুমেন্টসও পোর্টে পাঠাতে পারব না। রাজ্জাক সাহেব অনুনয় বিনয় করে বলেন যে ওনার ব্যাংকে একটা ঝামেলা হচ্ছে তাই টিটি পাঠাতে পারছে না। একথা শুনেই মনের ভিতর আবারো খটকা লাগল, তবে কি রাজ্জাক আমাদের ধোকা দিল? পার্টনারশীপ বিজনেস আমাদের সুতরাং আমার অবস্থা বুঝতেই পারছেন। দেরী না করে আমাদের একজন পার্টনার মালয়েশিয়া ফ্লাই করল। রাজ্জাক সাহেবকে তিনি খুঁজে পেলেন এবং জানতে পারলেন কি কারনে উনি টিটি পাঠাতে পারছেন না। অবশেষে রাজ্জাক সাহেব তার একজন মুখডাকা মামাকে অনুরোধ করলেন যেন তার কোম্পানীর মাধ্যমে একটা টিটি পাঠায়। তিনি রাজী হলেন এবং তার কোম্পানীর থ্রুতে আমাদের টিটি পাঠিয়ে দিলেন। আমরা ব্যাংকের যাবতীয় কাজ সেরে সোজা চলে গেলাম মালয়েশিয়ায়।
রাজ্জাক সাহেব আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে তার সেই মুখডাকা মামাকে সংগে নিয়ে তার সদ্য কেনা টয়োটা এভেঞ্জা গাড়িতে করে কুয়ালালুমপুরের একটা হোটেলে উঠিয়ে দিলেন। আমাদের সংগে তার কথা হয়েছিল যে আমরা মালয়েশিয়া যাবার পর তিনি আমাদের বায়ারের কাছে নিয়ে যাবেন। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল উনি বায়ারের কাছে আমাদের নেয় না। আমি আগেই জানতাম ওনার শ্যালিকা ওখানে থেকে লেখাপড়া করে এবং একজন ভাগ্নেও (বউয়ের ভাগ্নে) রাজ্জাক সাহেবের সংগে থাকে। আমি যাবার সময় তার শ্যালিকার অর্ডারের ১০/১২ হাজার টাকার জামা কাপড়ও কিনে নিয়ে যাই। আমাদের একদিন দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান এবং শ্যালিকার সংগে পরিচয় করিয়ে দেন। ঐদিন বিস্তারিত আলোচনা হয় আমাদের বিজনেস ডেভলপমেন্টের বিষয় নিয়ে। ওনাকে যখনই জিজ্ঞেসা করা হয় বায়ারের স্বাক্ষাতের বিষয়ে, উনি সুকৌশলে এড়িয়ে যান। কন্ট্রাক্ট এর কপি দেখতে চাই উনি দেখান না। আমরা ভাবি হয়তো উনি ভাবছে আমরা ওনাকে পল্টি দিয়ে বায়ারের কাছে সরাসরি চলে যাব আর উনি কিছুই করতে পারবে না। এজন্য আমরা তাকে বার বার আশ্বস্ত করি যে আমাদের দ্বারা এমন কাজ হবে না। রাজ্জাক সাহেব যে বায়ার পেয়েছে তার অফার ছিল ঐ সময় ২৬০ ডলার পার টন যেখানে আমি অন্যান্য বায়ারদের কাছ থেকে ১৯০ ডলাররের বেশী অফার পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম রাজ্জাক হয়তো খুব ভাল একজন বায়ার পেয়েছে যিনি ক্যাশ পেমেন্ট করেন। আমরা অন্ধের মতো রাজ্জাক গুরুকে ভক্তি করতে শুরু করলাম।
ইতিমধ্যে মাল পোর্টে পৌঁছে যায় অথচ মাল ছুটাতে তার গলদঘর্ম হবার দশা। আমাদের সংগে দেখা না করে বায়ারের কাছে, পোর্টে এবং সিএনএফ অফিসে দৌড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের কিছুটা গুরু গম্ভীর সুরে বলে "আমার কাজ হচ্ছে মাল বিক্রি করা এবং বায়ার ঠিক রাখা, আপনাদের চিন্তার কোন কারন নাই ইত্যাদি ইত্যাদি" এভাবে প্রায় ১৫ দিন পার হয়ে যায় উনি মাল ছুটাতে পারে না। কারন জানতে চাইলে বলেন, যে কোম্পানীর নামে আলু এসেছে উক্ত কোম্পানীর কাগজপত্রে সমস্যা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা জানতে চাই মাল কোথায় আছে? উনি বলে পোর্টে। আমার পার্টনার ১৮ দিনের মাথায় একটু চড়া সুরে মাল স্বচোখে দেখানোর জন্য তাকে চাপ দেয়। পরেরদিন সকলে উনি আমাদের সব জায়গায় নিয়ে যাবে বলে কথা দেয়। রাতে তাকে পারফেক্ট সময়টা জানতে চাই কারন আমরা থাকি বাংলা মার্কেটে আর উনি থাকে পানতাই হিলপার্ক। উনি আমাদের জানায় যে ভোর বেলা উনি একাই বেরিয়ে যাবেন। আমাদের চান্দি গরম হয়ে যায়। ডিশিসন নেই আমরা ভোর বেলা ওনার বাসার সামনে পাহারা দিব যে কখন বের হয়। যথারীতি আমরা খুব ভোরে পানতাই হিলপার্ক একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই। ওনার বের হবার রাস্তার মুখে আমরা পাহারা দিতে থাকি। উনি পিছন থেকে আমাদের একজনকে দেখেই উল্টা দিকে দৌড় দেয়। সব হিসাব নিকাশ গোলমাল হয়ে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। যা কখনো ভাবিনি তাই ঘটতে যাচ্ছে !! আমি এল প্যাটানের রাস্তার একদিকে এবং আমার পার্টনার অন্যদিকে পাহারা দেই। রাজ্জাক সাহেব একটা গলির ভিতর থেকে বের হয়েই আমার সামনে পড়ে। আমি তাকে ধরে ফেলি এবং মুখ কালো করে বলি, আমাদের দেখে দৌড় দিলেন কেন? সে কোন সদুত্তর না দিতে পেরে আমতা আমতা করে এড়িয়ে যায়। মুখডাকা মামাকে আমরা পূর্বেই তার এহেন আচরণ জানাই এবং তিনি আমাদের আশ্বস্ত করে যে আমাদেরকে সংগে নিয়ে তিনি সবার কাছে যাবে। ইতি মধ্যে মুখডাকা মামা তার গাড়ি নিয়ে পানতাই হিলপার্ক চলে আসে। রাজ্জাককে সহ আমরা সবাই সিএনএফ এজেন্টের সংগে দেখা করি। আমি বিস্তারিত তাদের কাছে জানতে চাই এবং বুঝতে পারি রাজ্জাক সাহেব তার জীবনেও কোনদিন আলু পোর্ট থেকে ছুটায়নি এ ব্যপারে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাই নাই। আমাদের হতাশা আরো বেড়ে যায়। আমি উদ্দোগী হয়ে সিএনএফ এজেন্টকে সংগে নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র তৈরী করে মাল ছুটাতে পোর্টে যাই। এর মধ্যে আমাদের জরিমানা হয়ে গেছে আলুর মূল্যের প্রায় সমান। দুই কন্টেইনার আলুর যে মূ্ল্য জরিমানাও তার সমান অর্থাৎ চার কন্টেইনার আলুর দাম এখন আমাদের গুনতে হচ্ছে! উপায় ছিল না মাল ছুটানো ছাড়া। হুন্ডি করে আবারো বাংলাদেশ থেকে টাকা নিলাম। ইতিমধ্যে মুখডাকা মামার মাধ্যমে জানতে পারলাম বায়ার পাকিস্তানী। রাজ্জাক মিয়াকে আমি ইচ্ছা মতো গালিগালাজ করলাম কারন আমার কলিগদের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। আরো অবাক হয়ে গেলাম যখন জানলাম সে হচ্ছে হোলসেল মার্কেটের সব থেকে চিটার বায়র আমীরের ছোট ভাই সাহেদ। রাজ্জাককে আমরা বার বার জিজ্ঞেসা করেছিলাম তোমার বায়ার কে? সে আমাদের কখনোই বলেনি যে বায়ার পাকিস্তানী। আমি তাকে পূর্বেই পাকিস্তানী বায়ারের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলাম এবং আমার কলিগদের দুর্ভাগ্যের ফিরিস্তি শুনিয়েছিলাম। তখনও সে বলে নাই যে বায়ার পাকিস্তানী। আসলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে আমাদের অনেক দেরী হয়ে গেছে। বুঝতে আর বাকি রইলনা যে আমরা ট্রাপে পড়ে গেছি। রাজ্জাক আসলে নাদান বেওকুফ, সে মালয় এবং ঊর্দূ কোন ভাষাই ভাল বুঝত না। পাকিস্তানী বলেছে এক আর বেওকুফটা বুঝেছে আরেক। কাউকে মাল দিলে সে বিক্রি করে টাকা দিবে এই শর্তে রাস্তার ফকিরও আপনার সাথে ব্যবসা করতে চাইবে। যাই হোক আমরা ফাসতে চলেছি............
কন্টেইনার দুটো পাকিস্তানীর দোকানের সামনে নিয়ে এলাম। আমাদের মারমুখো হাবভাব বুঝে রাজ্জাক ইতিমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। সে আমাদের বলেছিল কন্টেইনার বায়ারের দোকানে নিয়ে গেলে খোলার আগেই টাকা দিয়ে দিবে। টাকা চাইতেই সে বলল, কিসের টাকা? মাল না বিক্রি করে টাকা দেবার কথা কে বলেছে? বললাম রাজ্জাক বলেছে। সে বলল রাজ্জাককে নিয়ে আস আমি তার সাথে কথা বলব। কোথায় পাব রাজ্জাক কে? সে তো গাট্টি বোচকা নিয়ে শ্যালীকা সহ উধাও। প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেলাম। আমরা হন্ত দন্ত হয়ে হোল সেল মার্কেটের এক বাঙ্গালী ক্রেতার কাছে গেলাম, সে আমাদের বিপদ বুঝতে পেরে বলল ভাই ০.৫০ সেন্ট করে রাজী হলে আমাকে মাল দিয়ে যান। আমরা হিসাব করে দেখলাম আমাদের খরচই ২৫ টাকার উপরে আর ওকে ১০ টাকায় মাল দিব? রাজী হলাম না; হয়তো রাজী হলে কিছু টাকা হাতে পেতাম কারন তখনো আমরা জানতাম না আরো বড় ধাক্কা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার পার্টনার বায়ারের সাথে একটু হট টক করল। এগ্রিমেন্টের কপি দেখতে চাইল। আমার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল দেখে যে আমি একটা সেলস কন্ট্রাক্টের ড্রাফট পাঠিয়েছিলাম রাজ্জাককে এবং বলেছিলাম এখানে দামটা বসাবেন, সেই সাথে পেমেন্ট টামর্সটাও উল্লেখ করবেন। সে যে এতবড় নাদান ভোদাই আমি বুঝতে পারি নাই। হুবাহু আমার ড্রাফট প্রিন্ট দিয়ে কোন দাম দর না লিখে কন্ট্রাক্ট সাইন করেছে। অবশেষে পাকিস্তানী আমাদের আশ্বস্ত করল যে সে মাল বিক্রি করে ১৫ দিন পর টাকা দিবে। আমরা উপায়ন্ত না পেয়ে তার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। পাকিস্তানী উক্ত কন্টেইনার দুইটার প্লাগ কেটে ফেলল। কেন জিজ্ঞেসা করা হলে বলল, প্লাগ নাকি তার সহ চুরি করে নিয়ে যায়। যাই হোক এটা তার দায়দায়িত্ব ভেবে আমরা কিছু বললাম না। যখন সিএনএফ কোম্পানী বার বার আমাকে তাগাদা দিচ্ছিল কন্টেইনার খালাস করার জন্য। পাকিস্তানী ততই দেরী করছিল । এভাবে আরো ১৫ দিন সে কন্টেইনার দুইটা আনপ্লাগ অবস্থায় তার দোকানের সামনে ফেলে রাখল। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা দেশে চলে এলাম। কন্টেইনারের জন্য আমাদের ৪,০০০ রিঙ্গিত সিকিউরিটি দেওয়া ছিল। ১৫ দিনের জরিমানা এবং প্লাগ কাটার পানিসমেন্ট আমাদের মাথার উপর এল, অবশেষে ৪০০০ রিঙ্গিতের পুরাটাই খেসরত হিসাবে কন্টেইনার কোম্পানী কেটে রাখল। পুনরায় আমি একাই গেলাম মালয়েশিয়ায়। উদ্দেশ্য টাকা আদায় করা। পাকিস্তানী আমাকে একটা লিষ্ট ধরিয়ে দিল সেখানে দেখলাম সকল আলু পঁচে গেছে এবং বাকি আলু সে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে। পঁচা আলু সরাতে এবং লেবার খরচ বাবদ সে উল্টে আমাদের কাছে টাকা পায় এমন একটা হিসাব আমার সামনে দাঁড় করাল। আমি জানতাম মারামারি করে লাভ নাই কারন রাজ্জাক হাওয়া। কন্ট্রাক্ট হয়েছে রাজ্জাকের কোম্পানীর নামে, টিটি গেছে আরেক কোম্পানীর নামে সব মিলিয়ে আমি কাউকে ধরতে পারছি না। জীবনে এতবড় ভোদাই হয়ে যাব কল্পনাও করিনি।
আলুর মূল্য, কন্টেইনার ভাড়া, সিএনএফ খরচ, দুইবার মালয়েশিয়ায় যাওয়া আসার খরচ, মাল ছুটানো খরচ, পেনাল্টি এবং অন্যান্য খরচ মিলে আমাদের ৩০ লক্ষ টাকা জলে চলে গেল মাত্র কয়েক দিনর ভিতর। রাজ্জাকের ইতিহাস জানতে পারলাম যে সে বহু আগেই শালীকে বিয়ে করে বউকে দুই বাচ্চা সহ তালাক দিয়েছে এবং তার জন্য মামলাও করেছে তার স্ত্রী। মালয়েশিয়ায় সে এখনো পালাতক জীবন যাপন করছে। এমন চরিত্রহীন লোকের পাল্লাহ আল্লাহ পাক আমাকে ফেলবে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। এগুলো সবই আল্লাহ পাকের পরীক্ষা। এদিকে আমাদের পার্টনারশীপ বিজনেস ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। আমরা সর্বশান্ত হয়ে চোখে কাঠের চশমা পরে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছি। জীবনের ভাল সময়গুলো এখন এক স্বপ্নের মতো। সামনে শুধু দুর্বিসহ জীবন অপেক্ষা করছে। হতাশায় আমরা দিক বিদিক হারিয়ে ফেলেছি কারন আলুর ব্যবসায়ের পূর্বে আমরা অন্য আরেকটা ব্যবসায়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা হারিয়েছি। আলুর ব্যবসাটা ছিল আমাদের ঘুরে দাড়াবার শেষ প্রচেষ্টা। লসের পর লস আমাদের পার্টনারশীপের দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা আজ কেউ ভাল নাই। আগত দিনগুলোতে চোখের সামনে ঝাপসা কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। এত অভিজ্ঞতা আর পরিশ্রম জীবনে কোন কাজেই আসল না ভেবে হতাশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। মা বাবা, স্ত্রী সন্তান নিয়ে কি করব আর কোথায় দাড়াব পথ খুঁজে পাই না। অন্যদিকে তৃতীয় দৃষ্টি বুঝে নিয়েছে আমাদের ঘনঘন মালয়েশিয়া ভ্রমন বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। তারা ভেবেছে আমরা আরাম আয়েশ করতে মালয়েশিয়া গেছি অথচ তারা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝত!
আমার ব্যবসায়ীক জীবনে কখনো এত হতাশ হইনি। আমার পার্টনাররা যখনই হতাশ হয়ে গেছে আমি তাদের সাহস যুগিয়েছি। কখনো ভাবিনি আমি হেরে যাব, পারব না। প্রচন্ড উদ্যম আর সাহসিকতার সংগে সকল সমস্যার মোকাবেলা করেছি। আজ আমি ভেঙ্গে পড়েছি ঠিক সন্তান হারা পিতার মত। আমাকে সাহস যোগানোর মত আজ আমার পাশে কেউ নাই। মাকে ফোন দেই না কারন মা বলবে "বাবা আমি খুব অসুস্থ আমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে" আমি সন্তান হয়ে তাদের জন্য কিছুই করতে পারব না। বুক ফাটা আর্তনাদ আমার ভিতরের স্বত্তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি এক হতভাগা সন্তান, এক হতভাগা পিতা যে কারো মুখেই হাসি ফোটাতে পারলাম না!!
সত্য কাহিনী অবলম্বনে........................
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪৬