দিনশেষে মনটা খুব ভার ভার লাগে।
সারাদিন কাজের চাপে বুঝতে পারিনি, কোথায় যেন একটা আঘাত লেগেছে। গুরুতর আঘাত!
ব্যান্ডেজ, মালিশ, ওষুধে এ আঘাত যাবার নয়।
ছোট ছোট অনেকগুলো বাচ্চা। ক্যামেরা, লাইট, অ্যাকশন বোঝে না। রোল দেবার পর হা করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে। আপদ!
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে, কখনও বকা দিয়ে ওদেরকে অন্যদিকে ফেরাতে হয়। তার মধ্যে একজন আবার কানে শোনে না - নাম ময়না। ওকে বুঝিয়েও লাভ নেই। ইশারায় কথা বললে একটু আধটু বোঝে। আমি আবার ধৈর্য্য ধরে ইশারায় বোঝাতে পারি না। অল্পতেই বিরক্ত হই।
আরো আছে-
'বাবু' - হাঁটতে পারে না। হুইল চেয়ারে বসে কাস করে।
'আনোয়ার' - চার হাত পা এক করে পশুর মত হেঁটে ব্ল্যাক বোর্ডে যায়।
ঝলসে যাওয়া মুখের একটা মেয়েও আছে। কতই বা বয়স !!! ৭ /৮। অথচ কে যেন মুখটা ঝলসে দিয়েছে।
ওদের এই মুখগুলোকে কত বেদনার্তভাবে পরিবেশন করা যাবে সেই চেষ্টাতে আমার ঘাম ছুটে যায়।
বাবু যে পা ডলে ডলে হাঁটে, এই শটটা একটা প্যারালাল ট্রলিতে নিতে হবে।
ময়নার হিয়ারিং এইড এর একটা কোজ আপ চাইই চাই।
এই ডকুমেন্টারী দেখিয়ে এনজিও বিদেশ থেকে টাকা আনবে। ভালমত ছবি না বানালে বিদেশীরা দেখবেই না।
সারাটা দিন গাধার মত খাটি। অযথা চিত্কার করি:
- 'নিয়াজ, ওয়াইড আঙ্গেলটা অর্ধেক করেন। পুরোটা দরকার নাই'।
- 'মাল্টি টেনটা দিয়েন না। সোলার দিয়ে ফিল লাইট দেন। কী বললেন, সোলার দিয়ে ফিল দেয় না। ঠিকাছে, আমরা আজ থেকে শুরু করলাম। কেউ না দিলেও আমরা দেব। লুমিয়ের ব্রাদারের আগে মুভি ক্যামেরাও তো কেউ আবিষ্কার করেনি - তাই না? কাউকে না কাউকে তো শুরু করতেই হবে।'
-'এখন লাইটটা বেশ ভাল। গোল্ডেন লাইট। ভাল দেখে একটা প্রতিবন্ধী বাচ্চা দেন তো আপা, বেশ খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। গোল্ডেন লাইটে লো অ্যাংগেল থেকে শট ধরলে খুব হৃদয় কাড়া একটা ব্যাপার হবে। বাচ্চাটার খুড়িয়ে হাঁটা হেভী আর্টিস্টিক লাগবে।'
বাজেটের সাথে পাল্লা!
ঘড়ির সাথে পাল্লা!
শিল্পের সাথে আপোষহীনতা!
রোলিং ---ফাইভ, ফোর, থ্রী, টু, ওয়ান, জেরো- অ্যাকশন।
সন্ধ্যায় হোটেলে এসে কেন যেন নিজেকে খুব সুবিধাবাদী মনে হয়।
আমার দু' দুটো হাত চোখের সামনে মেলে ধরি। ওগুলো ঠিক আছে।
দুটো পা, দুটো আস্ত চোখ, শ্রবণক্ষম কান, সুবিধাবাদী মস্তিষ্ক -সব, সব ঠিক আছে।
শুধু মনটাই মরে গেছে।
সেই হিসেবে, আমিও প্রতিবন্ধী।
সবচেয়ে গুরুতর প্রতিবন্ধী।