এই তো সেদিন ফুটপাথ থেকে গার্মেন্টস এর এক্সপোর্টের একখানা টিশার্ট কিনে বড্ড আনন্দ পাচ্ছিলাম। যেমন পছন্দ হয়েছে, দামটাও ছিলো খুশি হবার মতনই। ট্যাগে লেখা ছিলো ৩৫ ইউরো, কিনলাম ৬৫ টাকা দিয়ে! বেড়ে জিতেছি! সেই টিশার্ট গায়ে দিয়ে কালে বেড়িয়ে পড়লাম। টিশার্টখানা এমনই কুফা, ফোন এলো আমার বাশিঁ বাজানোর শিক্ষা গুরু ‘‘সফিক ভাই” ঠোটে মুচকি হাসি নিয়ে কফিনে শুয়ে আছেন। মনটা বড্ড খারাপ হলো। কোনোভাবেই তার মৃতদেহ দেখবার সাহস হলো না। মন খারাপ করে ছল ছল চোখে অফিস পালালাম। চন্দ্রিমা উদ্যানে বসে থাকলাম, মন ভালো হলো না কিছুতেই। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে, সফিক ভাই এর সঙ্গে আমার মজার মজার স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারলাম না। সারা রাত জেগে লেখা লেখি। না ঘুমিয়ে সকালে অফিসে গেলাম। আবার সেই টিশার্ট; ভাবলাম, ‘জড় বস্তুর আর কি দোষ’। আবার অফিস, নিজের ল্যাপটপে ওয়ারফেজ ব্যান্ডের ‘‘বেওয়ারিশ” গানখানা হেড ফোনে শুনতে শুনতে কাজ করছিলাম। আবারও মৃত্যু। এবার অনেক, এখন পর্যন্ত ১২৭ জন মৃত ও আহত সহস্রাধিক। সঙ্গে সঙ্গে টিশার্টখানা ছিড়ে ফালি ফালি করতে মন চাইছিলো। সফিক ভাইয়ের শোক না কাটিয়ে উঠতেই আবার এতো বড় আঘাত। কিন্তু এদের জন্য আমার তো শোক হবার কথা নয়। এরা আমার কে? কিন্তু চোখের জল আটকে রাখা সম্ভব হলো না। মিজানের সেই গান যেনো বুকের মধ্যে বাজতে শুরু করলো। সারি সারি বেওয়ারিশ লাশ। এ অনুভুতি কেমনে প্রকাশ করবো। এই গান ছাড়া-
‘‘রাতের অটুট নিস্তব্ধতায়
ভেঙ্গে গেলো কোনো এক
রাত জাগা পাখির ডাকে
শেওলা ধরা পুরোনো প্রাচিরে
ঘেরা গোরস্থানে
উঠছে নামছে গ্লানির কোদাল
তৈরি হচ্ছে নতুন আবাস
উদ্দেশ্য পরোপার, উদ্দেশ্য পরোপার।
সারে তিন হাত ঘরের মালিক
রয়েছে পাশে পড়ে
নিথর দেহ চাটাই মোড়া
বুক ভরা গুমোট অভিমানে
চাপ চাপ রক্তের করুণ আবেদন
বেওয়ারিশ আমি
আমায় পৌছে দাও
আমার মায়ের কাছে।
নেই কোনো শেষকিত্তের আয়োজন
নেই কোনো শবযাত্র
নেই আতর গোলাপের গন্ধ
নেই অশ্রুর বন্যা
অনেকে পেয়েছে কাফনের কাপড়
পায়নি যারা ময়ের শেষ আদর
তাদের পৌছে দাও, তাদের মায়ের কাছে।
রাতের অটুট নিস্তব্ধতায়
ভেঙ্গে গেলো কোনো এক
রাত জাগা পাখির ডাকে
শেওলা ধরা পুরোনো প্রাচিরে
ঘেরা গোরস্থানে
উঠছে নামছে গ্লানির কোদাল
তৈরি হচ্ছে নতুন আবাস
উদ্দেশ্য পরোপার, উদ্দেশ্য পরোপার,
উদ্দেশ্য পরোপার, উদ্দেশ্য পরোপার,
উদ্দেশ্য পরোপার, উদ্দেশ্য পরোপার।”
টেলিভিশন অন করে বসলাম খবর দেখবার জন্য। সবাই আবার ব্যস্ত দায় ছোড়া ছুড়ি নিয়ে। কার দায়? কার দায়? এই নিয়ে চেচামেচি। সঞ্চালকদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তারাই এদেশের সবচেয়ে দায়িত্বশীল মানুষ। অথচ শুধু দুর্ঘটনা ঘটলেই এইসব নিয়ে বিভিন্ন ধরনের টকশো। টকশো গুলোতে এসব দুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা। কেন অন্য সময় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না? টেলিভিশনের উপরের কোনায় কালো ব্যাজ। কিন্তু কিছু চ্যানেলে চলছে উদ্দাম নাচ-গান আর পূর্বে রেকর্ডকৃত লাইভ কনসার্ট। নাজমা আপার উচ্চ কন্ঠ, অন্যরা কৌশলী। চ্যানেলগুলোর টি-আর-পি। দায় খুজেঁ পাওয়া যায় না। এদেশের একজন মানুষ হিসাবে এ দায় আমার। ডিফেক্টিভ এবং একারণে রাস্তার ঝুড়ি থেকে কেনা পোশাক হলেও বস্ত্র বালিকাদের হাতে তৈরি টিশার্ট আমি পড়ি। তাই এ দায় আমার। আমি গামেন্টস এ চাকুরী করি না, মালিক হওয়া তো স্বপ্নেও কল্পনাতীত, আমার এমন ইমারত নেই; তবুও এ দায় আমার। ক্ষমা কোরো হে বস্ত্র বালিকারা। বিধাতা তোমাদের কে বেহেস্তবাসী হিসাবে মর্যাদা দিক।
বিরোধীদল হরতাল প্রত্যাহার করেছে, ধন্যবাদ। প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী সহ সকলেই শোক জানিয়েছে। কাল জাতীয় পতাকাও লজ্জায় মস্তকাবনত থাকবে। এতো রক্ত, এতো রক্ত - এর মাঝে রাষ্ট্রপতি শপথ নিলেন ভালো কিছু করবার প্রত্যয় নিয়ে। চা চক্রটি বাদ দিলেও কোনো ক্ষতি তো ছিলো না। কি জানি চায়ের মধ্যে হয়তো রক্তের গন্ধ থাকে না। কিন্তু আমি যে, বিকালে চা পান করতে গিয়ে রক্তের গন্ধ পেলাম। বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন বন্ধ। আবার চালু। ভালো লাগলো বিরোধী দলের কার্য্যালয়ের সামনে রক্ত সংগ্রহের উদ্যোগ দেখে। শাহাবাগেও চলছে রক্ত সংগ্রহ। এখানেই ভালো লাগা; রক্তের রং একই, ভেদা ভেদ নেই। সবা্রই কাধে কাধ, হাতে হাত।
ঠুঠো জগন্নাথ রাজউকের সফেদ দাড়িওয়ালা দাদু নিজের নানাবিধ অভাব অভিজোগে এড়িয়ে চলেছেন বিবিধ প্রশ্ন। সাংবাদিকরা খড়গহস্ত। বিজেএমই এর সাবেক সভাপতি মহোদয় কি বলে উপস্থিত সমালোচকদের জবাব দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সঞ্চালক খুশি! টি-আর-পি বাড়ছে। ভবন ধ্বসে পড়বার পেছনেও যে ক্ষমতাসীনদের কেও কেও দায়ী সেবিষয়ের অনেকে স্বচেতন। ভাগ্যিস ওই ভবনের মালিক বিরোধীদলের কেও নয়! গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন হতো না। সবাই ফয়দা লুটতে ব্যস্ত। কেউ দায় নেয় না। কি আর করা এ দায় আমার, একজন বাঙালী হিসাবে এ দায় আমার, একজন বাংলাদেশী হিসাবে এ দায় আমার, আমি পুটপাথ থেকে গার্মেন্টস এর বাতিল টিশার্ট কিনে ব্যবহার করি; তাই এ দায় আমার। তাই চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। আমার এক শিক্ষাগুরুর মৃত্যুর শোকও আমাকে এতো বিহবল করতে পারেনি।
এখানে বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে, মাটিতে লাশের মিছিল।
বাতাসে লাশের গন্ধ বিজেএমই-এর ওদের কাবাব খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ভবন ধ্বসে এক তলার উপর আরেক তলা, তার উপর আরও অনেক; মাঝে রক্তে মাখা মৃতদেহ। মালিকরা ঠিক যেমন ক্লাব স্যান্ডউইচ খায় ৩৫ ইউরো মূল্যের টিশার্ট তৈরীর মুনাফা থেকে। আর আমার মতনই লাল রক্তের মানুষ, আমার ভাই, আমার বোন, আমার বস্ত্র বালক-বালিকারা পুষ্টিহীনতায় ভুগে, জন্ডিসে ভুগে হলুদ হয়ে বাড়িতে যায় পয়সার অভাবে বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ে ঈদ করতে। ছেড়া ব্যাগে থাকে ফুটপাথ থেকে কেনা কিছু কাপড়। সেগুলোর মধ্যে মূল্য ট্যাগে লেখা থাকে ৩৫ ইউরো, সে কেনে ৪০ টাকায় হয়তো। কিংবা মেসি, কাকাদের জন্য তৈরী জার্সি গায়ে দিয়ে বস্ত্র বালক-বালিকাদের বুড়ো বাবা-কাকারা গর্বে বুক ফুলিয়ে মাটির বারান্দায় বসে থাকেন। পরিচিত কেউ এলে বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘‘ছেলে আনছে! ঢাকায় চাকরী করে গামেন্টস এ। ভালো চাকরী। মাইয়া দেইহো। বিয়া দিমু।” কেও বিয়ে করে আবার কাজে ফিরে আসে, হাতের মেহেদী না শুকাতেই স্যান্ডউইচের মধ্যে চাপা পড়ে, মালিকদের ক্লাব স্যান্ডউইচের রসনায় রক্তের ফ্লেভার ছড়ায়।
এভাবেই চলে জীবন। ভুলে যাবো কদিন পর। আবারো কর্ম চঞ্চল জীবন। ট্রেনে করে বাড়ী ফেরা। আবারো মেসি, নেইমারদের জার্সি বানানো। ৩৫ ইউরো দাম! দেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়ন। আবারো লাশ----- আবারো টকশো, দায় ছোড়া ছুড়ি, কেও দায় নেয় না। এ দায় আমার, একজন বাঙালী হিসাবে এ দায় আমার, একজন বাংলাদেশী হিসাবে এ দায় আমার, আমি পুটপাথ থেকে গার্মেন্টস এর বাতিল টিশার্ট কিনে ব্যবহার করি; তাই এ দায় আমার। তাই চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে।
বস্ত্র বালক-বালিকা, ভাই আমার-বোনেরা আমার তোদের বলি, কেনোরে ভাই এই ঢাকা শহড়ে মরতে আসিস। বাড়ি ফিরে যা, তোদের মৃত্যু এদেশে খুব সস্তা বিষয়। তোদের জীবনের মূল্য বড়জোর এক লক্ষ টাকা। আর পঙ্গু হলে কিছু নাও পেতে পারিস। ফিরে যা ভাই, ফিরে যা বোনেরা আমার। গ্রামে গিয়ে ঘুটে কুড়িয়ে খা, জমিতে কামলা খেটে খা, এক বেলা খেয়ে থাক, তাও বেচে থাক তোরা। তোদের মৃত্যুতে আমি আমার চোখের পানি যে আটকে রাখতে পারছি না। ফিরে যা। দরকার নেই শিল্প বিপ্লবের। দরকার নেই তোর প্যান্ট পড়ে ঘুরবার। বাড়ী গিয়ে ছেড়া লুঙ্গী পড়ে মাটি কেটে খা। টাকার অভাবে লেখা পড়া বেশীদূর করতে পারিসনি। তো কি করবি। অন্য পেশা দেখ। অন্য কাজ শিখে নে। তাও বেচে থাক। তোদের মৃত্যুতে আমার চোখের পানি যে আর বাধ মানে না রে। ক্ষমা কর আমায়। এ দায় আমার। ফিরে যা, ফিরে যা এই ঝল মলে মৃত্যুর শহড় থেকে। গ্রামে গিয়ে এক বেলা খেয়ে বেচে থাক। তোদের মায়ের বুক আর খালি করিসনে ভাই। যা ফিরে যা।
লেখকের নিজের ওয়েব সাইটে বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট করুন।
বাউন্ডুলে
www.baundulay.com
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৩ ভোর ৫:১১