somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশের কয়েকটি বধ্যভূমি ও কিছু কথা (পর্ব ১)

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জল্লাদখানা বধ্যভূমি
জল্লাদখানা বধ্যভূমি বা পাম্পহাউজ বধ্যভূমি ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি বধ্যভূমি।এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিরীহ বাঙালিদের নির্যতনের পর এখানেই গণকবর দেয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ।স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুরের বিহারী অধ্যুষিত এলাকাগুলো সাধারণত বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।

১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৯ সালের ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের সহযোগিতায় মিরপুরের দুটি জায়গায় খননকাজ চালায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর এবং দুটি বধ্যভূমি আবিষ্কার করা হয়। তারপর এই দুইটিসহ পুরো মিরপুরে মোট চারটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়। কথিত আছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙ্গালিদের পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর বিহারি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ,তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে নিষ্ঠুর ভাবে জবাই করে বড় বড় সেফটি ট্যাঙ্কির ভিতরে ফেলে রাখত।এই বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫৩৯২টি অস্থিখণ্ড, মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলংকার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার পুনরায় জল্লাদখানা কর্মসূচি শুরু করে এবং স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন এর সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ। এর পূর্বপাশে রয়েছে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান এর যুগ্মভাবে করা একটি ভাস্কর্য “জীবন অবিনশ্বর”। ২০০৭ সালের ২১শে জুন এই স্থাপনাটির দ্বার উন্মোচন করা হয় ।


জাটিভাঙ্গা বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজাকার, আলবদর এবং আল শামসের সহায়তায় হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিঙ্গিয়া, চন্ডিপুর, আলমপুর, বাসুদেবপুর, গৌরিপুর, মিলনপুর, খামারভোপলা, শুখানপুখুরীসহ বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার বাঙালি নর-নারী এবং শিশু ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।পথিমধ্যে তারা জাটিভাঙ্গা গ্রামে বিশ্রামের জন্য অবস্থান করার সময় রাজাকার, আলবদর এবং আল শামস বাহিনী পাকিস্তানি আর্মিদের খবর দেয় । পাকিস্তানি বাহিনীর দুই ট্রাক সৈন্য এসে ৩০০০-৩৫০০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাথরাজ নদীতে ফেলে দেয়।ওই সকল নিহতদের স্মরণে ১৯৯৬ সালে পাথরাজ নদীর তীরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় ।

গল্লামারী বধ্যভূমি

গল্লামারী বধ্যভূমি খুলনা জেলার অন্তর্গত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এর পাশেই অবস্থিত ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে খুলনা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিও স্টেশন "গল্লামারী রেডিও সেন্টার" ভবনে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে গল্লামারী নদীতে ফেলে দেয়া হতো। শহরের দুইকিলোমিটার অভ্যন্তরে গল্লামারী খালের পাশে এই বধ্যভূমি অবস্থিত।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থানেই ছিল রেডিও পাকিস্তানের খুলনা শাখা। এই বধ্যভূমিকে ঘিরে গড়ে উঠে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। গণহত্যা এবং নির্যাতন কেন্দ্র বেতার ভবন হয়ে উঠে বিশবিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন। এখানে অনেক মুক্তিকামী মানুষ ও সাধারণ জনগণকে হত্যা নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। মূলত রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সহযোগিতায় এসব হত্যাকাণ্ড করা হয়েছিল। এখানে জবাই করে বেশিরভাগ মানুষ মারা হত। প্রথম দিকে শুধুমাত্র রাতের বেলাতে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা হলেও শেষের দিকে তারা দিনে রাতে সমানে নির্বিচারে হত্যা করেছে। সারাদিন শহর এবং গ্রাম হতে লোকদের ধরে এনে জেলখানা, হ্যালিপোর্ট ও ইউএফডি ক্লাবে জড়ো করা হত আর রাত হলে তাদের হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত। । প্রতি রাতে প্রায় শতাধিক মানুষ হত্যা করা হত।


আরো ছিল নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা খুলনায় ফিরে আসেন। সে রকমই একজন প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সাত্তার শিকদারের ভাষ্যমতে,

চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। খাবার নাই, পানি নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই। মানুষ আর মানুষ। কারো বুক কাটা, কারো গলা কাটা। কোন কোন লাশের পঁচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

খুলনা শহর মুক্ত হবার পর গল্লামারী খাল এবং এর আশেপাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ওই স্থানে আনুমানিক ১৫,০০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর রেডিও সেন্টার বর্তমান বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্র নগরীর নূরনগর এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়।সেখানে ১৯৯৫ সালে প্রথম একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।


খুনিয়া দিঘী বধ্যভূমি
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমি খুনিয়া দীঘি বধ্যভূমি ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ৪৫ কিমি দূরে রানীশংকৈল উপজেলার ভান্ডারা গ্রামে অবস্থিত ।
প্রচলিত আছে, প্রায় দুইশত বছর আগে স্থানীয় এক জমিদার ৬ একরের বিশাল এই দীঘিটি খনন করেন। এই এলাকার ব্যবসায়ীরা নির্জন এবং জঙ্গলাকীর্ণ দীঘির পাশ দিয়েই ব্যবসা করতে যেতেন রায়গঞ্জে। একবার কে বা কারা এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দীঘির পাড়ে ফেলে রেখেছিল। তখন থেকে এই দীঘির নাম হয়ে যায় খুনিয়া দীঘি।১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তবর্তী হরিপুর উপজেলা, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা, রানীশংকৈল উপজেলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আত্রমণে দিশেহারা হয়ে, পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী রানীশংকৈলে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিদিন শত শত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে থাকা লোকদের ধরে আনা হতো রানীশংকৈল আর্মির সেই ক্যাম্পে। সেখানে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পরে লাশ গুলোকে খুনিয়া দীঘিতে ফেলে দেয়া হতো ।মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করার জন্য রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডাঃ আব্দুর রহমান এবং তার সহোদরকে খুনিয়া দীঘির পাড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় । দীঘি পাড়ের শিমুল গাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হত। কখনো কখনো হত্যার পূর্বে লোকজনকে কবর খুঁড়তে বাধ্য করতো। হত্যার পরে দীঘির পাড়ের উঁচু জমিতে মাটি চাপা দিতো ।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মি রাজাকার, আলবদর আর আলশামসেদের সহায়তায় ২০০০ থেকে ৩০০০ মানুষকে খুনিয়া দীঘিতে হত্যা করা হয়। তার ফলে মানুষের রক্তে দীঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি। রক্ত, লাশ, কঙ্কালে ভরপুর খুনিয়া দীঘি নামটি আরো সার্থক হয়ে উঠে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীঘি থেকে উদ্ধার করা মানুষের হাড়গোড় দীঘির পাড়ে একটি গর্ত করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শহীদদের স্মরণে দীঘি পাড়ের সেই জায়গাটিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় । ১৯৭৩ সালে জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন।

তথ্যসূত্রঃ
তথ্যসূত্রঃ
তথ্যসূত্র।
তথ্যসূত্রঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×