আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আজ পর্যন্ত জঙ্গীবাদ নামক নবআবিস্কৃত পরিভাষাটির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। যারা জঙ্গীবাদ নামক ভুতে আক্রান্ত এই এবং ভুতের কবল থেকে মুক্তির নামে সর্বশক্তি প্রয়োগে মাঠে নেমেছে, তাদের প্রচারণা, বক্তব্য-বিবৃতি ও তৎপরতা অত্যন্ত সন্দেহজনক এবং অস্পষ্ট।
প্রশ্নো হলো জঙ্গীবাদী বলে তারা কাদেরকে বুঝাতে চায়? জঙ্গীবাদী বলে যদি তারা এমন অপশক্তিকে বুঝায়
(ক) যারা বিদেশের এজেন্ট হিসাবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত।
(খ) যারা হত্যা ও লুটতরাজ করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
(গ) যারা আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমাবাজি করে ছিনতাই, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।
(ঘ) যারা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে জমি দখল, হল দখল ও বাড়ি দখলের মত ভয়ংকর অপরাধ কর্মে জড়িত।
তাহলে এই জঙ্গীবাদীদের নির্মূল করতে যে কোন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে গোটা গাতি ঐক্যবদ্ধ। কারণ, এরা দেশ ও জাতির শত্র“। এদের ক্ষমা করা যায় না।
এদেরকে নিশ্চিহ্ন করা সরকার, বিরোধীদল এবং দেশের আপামর জন সাধারণের নৈতকি দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও ওলামা-মাশায়েখদের অগ্রণী ভূমিকা সব সময় ছিল এবং থাকবে। কেননা ইসলাম শান্তির ধর্ম। কোন মানুষের জীবন ও সম্পদের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ ইসলাম আদৌ অনুমোদন করে না। এসমস্ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যারা করে, তাদেরকে চিহ্নিত করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া কঠিন ব্যাপার নয়। বিশেষ করে সরকারের জন্য। কেননা এদেরকে দমন করার ব্যাপারে সর্বশ্রেণীর লোকজনের সহযোগিতা ও সমর্থনের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় শক্তি, পুলিশ, বি. ডি. আরসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে সরকারের অধীনে। যারা এ ধরনের অপরাধ করে তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দাদের অজানা থাকার কথা নয়। আদালতে এ ধরনের আসামীদের বিচার পরিচালিত হচ্ছে। থানায় থানায় তাদের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ রয়েছে। যারা কারাগারে আছে তাদের রেজিষ্টার থেকেও এই কলংকিত জঙ্গীবাদীদের সন্ধান সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দেশের সর্বপ্রকার ক্রাইম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতাদের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের অধিকাংশই বড় বড় রাঘব বোয়াল। তারাই পালাক্রমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী হয় এবং ক্ষমতার সিংহাসনে সমাসীন হয়ে তারাই জাতিকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখায়। ফলে তাদেরকে ধরা ছোয়ার বাইরে রাখাকেই সমীচীন মনে করা হয়। কেবল রাজনৈতিক হয়রানী ব্যতীত আর কিছু করার উপায় থাকে না। কারণ ভবিষ্যৎ প্রশাসনের প্রতি সমীহ ভাব প্রদর্শন না করলে বর্তমান প্রশাসনের ভবিষ্যৎ মারাত্মক হতে পারে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সতর্কতা অবলম্বনই বুদ্ধিমানের কাজ মনে রাঘব-বোয়ালদের গায়ে কোন আচড়ও দেয়া হয় না।
জঙ্গীবাদ নিয়ে তাদের অতি উৎসাহ ও হুমকি-ধমকির অর্থ যদি এই হয় যে,
ক. ইসলামী শিক্ষার সূতিকাগার এ দেশের মাদরাসাসমূহ ধবংস করে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলা।
খ. সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের প্রভাবমুক্ত করার হীন উদ্দেশ্যে আলেম উলামাদের হেয় প্রতিপন্ন করা।
গ. অর্থ ও ক্ষমতার লোভ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ইসলাম বিরোধী বিদেশী শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
তাহলে যারা এই জঙ্গীবাদের ধুয়া তুলে দেশের সংখ্যা-গরিষ্ঠ নাগরিকদের উপর জুলুম-নির্যাতন ও প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে, তাদের অবশ্যই বুঝা উচিৎ যে, তারা আগুন নিয়ে খেলা করছে। সাহস থাকলে মুখোশ খুলে মুনাফেকী ছেড়ে সরাসরি ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে কথা বলুন। কাপুরুষের মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি শব্দের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে কেন? মানুষকে ধোঁকা দেয়া ভদ্র মানুষের কাজ নয়। পরিণামে নিজেই ভয়ানক ফাঁদে পড়তে হয়। অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করা বোকামী ছাড়া অন্য কিছু নয়।
মাদরাসা মসজিদ প্রসঙ্গ
যারা এরূপ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের এ কথাটি ভুলে যাওয়া মোটেই সমীচীন হবে না যে, এদেশে কারা সন্ত্রাসী, কারা জঙ্গীবাদী, কারা অস্ত্রবাজ, কারা দেশের অর্থলুণ্ঠন ও পাচার করে, কারা দেশের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশকে পঙ্গু বানাচ্ছে- একথা দেশের আপামর জনগণ সকলেরই জানা। এবং এসব তথ্য প্রমাণ সরকারী নথিপত্রে বিদ্যমান রয়েছে। বিগত আমলে সরকারীভাবে কওমী মাদরাসা এবং উলামা মাশায়েখদের ভূমিকার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি বারবার সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়েছে। বর্তমানেও কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের যাকাত ফিৎরা, কুরবানীর চামড়ার মূল্য, এককালীন ও মাসিক দান ও তাদের আন্তরিক সাহায্য সহযোগিতায় চলে। যারা দান খয়রাত করে, তারা এলাকার সর্বদলীয় লোকজন। তারা এসমস্ত মাদরাসাসমূহের সাথে শ্রদ্ধাভক্তি ও দরদের সাথে জড়িত। তারা এ সমস্ত মাদরাসার কার্যক্রম সম্পর্কে শতবৎসর যাবত অবগত।
এখানে একটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য যে, কওমী মাদরাসার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে গরীব-এতীম ছাত্রসহ লক্ষ লক্ষ মসজিদের ইমাম, মুআজ্জিন, খাদেম, খতীব ও শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ এবং তাদের পরিবার পরিজন; যাদের সংখ্যা কমপক্ষে দুই কোটি।
১. এই দুইকোটি মানুষ কওমী মাদরাসার মাধ্যমে স্বনির্ভরশীল স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
২. এরা কখনো সরকারী কোন অনুদান কিংবা চাকুরীর আশা করে না সুনিশ্চিতভাবে।
৩. এদের সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ ক্রাইম ও বেকারত্ব মুক্ত।
৪. এদের তিনভাগের একভাগ বিদেশে চাকুরী করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
৫. এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের জেনারেল শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশের কাজে অবদান রাখছে।
৬. এদের ৬০% স্বীয় যোগ্যতার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা ও ইসলামী তাহজীব তামাদ্দুন অব্যাহত রাখার বিরাট দায়িত্ব পালন করে। এরা নাগরিকদের সর্বাধিক শ্রদ্ধার পাত্র। যদি তাদের এই মহতি উদ্যোগ ও নিঃস্বার্থ সেবা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে সরকারের বর্তমান ঘোষিত বেকারত্বের সংখ্যা ৪কোটির স্থলে ছয় কোটিতে দাঁড়াবে এবং ক্রমাণ্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এদেশের কোন বিভাগই এককভাবে সরকারী অনুদান ও পারিশ্রমিক ব্যতীত এরূপ বিশাল অর্থনৈতিক অবদান রাখতে পারে নাই এবং পারবেও না। অপরপক্ষে কওমী আলেমদের উদ্যোগকে সরকার স্বাগত জানালে তাদের মাধ্যমে নিরক্ষরতা ও বেকারত্ব দূরীকরণে বিরাট অবদান রাখতে পারে। কিন্তু অতি পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, এক শ্রেণীর বিকৃত বিবেক তাবেদার গোষ্ঠী বিদেশী শক্তির ইশারায় মাদরাসায় জঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। যেন “যত দোষ নন্দঘোষ।” তাদের নাকে কেবল নিরীহ ওলামা মাশায়েখ, মাদরাসা মসজিদ ও ধর্মীয় সংস্থার দিক থেকে জঙ্গীবাদের গন্ধ অনুভূত হয়।