তালেবানদের তালিবানগিরি নিয়ে কখনও কিছু বলার ইচ্ছা ছিলোনা, তবুও বলতে হচ্ছে। কেন, সেটা আরেকদিন বলব।
উপরের তিনটা শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে, অন্তত গত এক দশকে। তালেবান বা জঙ্গীবাদের উত্থান নিয়ে বাজারে একটা ফালতু মিথ আছে, আর সেটা হল তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি, এখন নিয়ন্ত্রনের বাইরে এই ফ্রাঙ্কেস্টাইন দানব।
তার আগে বলি, আজকের এই উগ্রতার পেছনে ২টা পরিত্যাক্ত বস্তুর দায় সবথেকে বেশী। ১)পারভেজ মোশাররফ দ্যা বাতিল মাল, প্রত্যক্ষ ভাবে এই বস্তুটার দায় সবথেকে বেশী, ২)গণতন্ত্রের অভাব বা সামরিক ডিক্টেটরশিপ, স্থুলভাবে এইটা সবথেকে বড় কারণ।
এখন আসা যাক তালেবানের স্বরুপ সন্ধানে। প্রথম প্রশ্ন হল, তালেবান কি এই মাত্রই বিশ বা একুশ শতকে জন্ম নিলো? তাদের বিলিফ, আইডিওলজি কি বিশ/একুশ শতকের সৃষ্টি? উত্তর না, নট এট অল। তাহলে সমস্যা টা কী? হঠাত এই উগ্রতা কেন?
এই তালেবানিজম হাজার বছর আগেও ছিল। শত বছর আগেও ছিল। শতকের পর শতক জিইয়ে ছিলো। বাজারের শস্তা ধারণা, সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার অস্ত্রে জন্ম নেয় পাক-আফগান তালিবান। ভুলটা এখানেই। কথাটা আংশিক সত্য। আমেরিকা এই র্যাডিকাল গ্রুপটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো, কিন্তু তাদের জন্ম দেয়নি।
এখন কথা হল তালেবানের এই আস্ফালন কেন হঠাত? মনে আছে, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের প্রথানমন্ত্রী কে ছিলেন? এই নওয়াজ শরিফ। তার আগে বেনজির ভুট্টো। তার আগে ফের শরিফ। ১৯৯৯ সালের আগে কী বিশ্ববাসী পাকিস্তানি তালেবানের এই নৃশংস রূপটা দেখেছে? না!
পুরো বিষয়টার মধ্যে দুইটা মাত্রা আছে। একটা হল তালেবানদের বর্বরতা, পশ্চাৎপদতা। এই বিষয়ে আসার আগে বলা দরকার, এনিমিটির শুরু কোত্থেকে।
তালেবানদের সুপ্ত উগ্রতা বিনা উসকানিতে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তোলে প্রথম পাকি জেনারেল সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মুশাররফ। প্রথমত নিজের স্বৈরতন্ত্র রক্ষায় সেইসময় জর্জ বুশ জুনিয়রের কাছেআসার বাসনায় 'সেকুলার' ক্লাবে যোগ দেয় যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ট্রাডিশন এবং গঠনের সাথে সাংঘর্ষিক; এবং সেইটা তালেবান ভালোভাবে নেয়নি। এরপর লাল মসজিদের রক্তক্ষয়ী অভিযান চালায়, যা তালেবানকে এক ধাক্কায় শত্রুর কাতারে ঠেলে দেয়। আর নিজের তাখত রক্ষার্থে মোশাররফের সেনাবাহিনী নিয়মিত নিষ্ঠুর অভিযান চালাতে থাকে পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতে। একবার মনে আছে, ২০০৫ সালের দিকে, সরকারের সাথে আলোচনারত অবস্থায় কোন্ এক প্রদেশের গভর্নর বুগতি নিহত হয় সেনা অভিযানে। এসব কারণে তালিবানরা স্থায়ী শত্রুতে পরিণত হয়, আর বাকি বিশ্বের সাথে বন্ধুহীনতা তাদের আরও মরিয়া করে তোলে।
এইবার আসাযাক সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়টাতে। তালেবানরা কি চায়? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ১৯৯৯ সালে পারভেজ মুশাররফের ক্যু এর আগ পর্যন্ত এরা কোনও বড় ধরণের সহিংসতা ঘটায়নি। তাহলে তখন তারা কী পেত, যা এখন পাচ্ছে না?
কোনও সন্দেহ নাই, তালেবানদের আদর্শ পুরোপুরি মধ্যযুগীয়, বর্বর। সেখানে মানবাধিকার বলে কিছু নাই, নারী অধিকার তো সুদুর পরাহত। পশ্চাৎপদ অন্ধকারাচ্ছন্নন একটা ব্যাবস্থা তালেবানদের চাহিদা। আমরা কী দেখেছি? দেখেছি, পোলিও টিকা দেবার কর্মীদের তারা গুলি করে মারে, স্কুলে যাবার অপরাধে মালালা কে হত্যা চেষ্টা চালায়(এই মালালা যদিও চরম ওভাররেটেড কেস, সে অন্য প্রসংগ), অন্য গোত্রের ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে পাথর ছুড়ে গোটা গ্রাম সমবেত হয়ে কোনও মেয়েকে হত্যা করে, প্রেমের অপরাধে স্কুলছাত্রীকে দোররা মেরে খুন করা হয়; বর্বরতা, অসভ্যতার চুড়ান্ত রুপ।
একটা ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে যখন কাঠের ছেচকি বা উডেন স্টিক ডোবানো হয়, তখন কী ঘটে? হঠাত ফুটতে শুরু করে, তেলের চ্ছটা আসে, হাতে লাগলে হাত পুড়ে যায়। ১৯৯৯ সালের পূর্বে পাকিস্তানের কোনও সরকারই তালেবানদের অরিজিন তথা দুর্গম অঞ্চলের ট্রাইবদের ঘাঁটাতে যায়নি। কাগজে কলমে তারা পাকিস্তানি হলেও সেখানে একেবারেই নিজস্ব সিস্টেম চালু ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারের গ্রিপ ছিল কেবলই দলিল দস্তাবেজে, বাস্তবিক প্রয়োগ শূণ্য! স্থানীয় পর্যায়ে একটা নিজস্ব ব্যাবস্থা কায়েম ছিল, বাকি বিশ্ব তথা সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন; সেখানেই আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ হত। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন ওপেন ওয়ার্লডের সাথে তাদের সিঙ্ক করার চেষ্টা করা হয়। ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে কাঠের স্টিক স্পর্শ করা মাত্রই প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। যেখানে নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ, পোলিও টিকা হারাম; এমন একটা সমাজ ব্যাবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্র "সভ্যতা" ইনজেক্ট করতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে চরম।
কিন্তু এই অসভ্যতার মধ্যেও স্থিতি ছিল। শত শত বছর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কেও হস্তক্ষেপ করেনি; ফলে স্টাবিলিটি ছিল।
জোর করে সভ্যতা গেলানো যায়না, চেষ্টার ফল কখনও ভাল হয়না। এই চিরন্তন সত্যটাই ঘুরে ফিরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।