somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারত থেকে ঋণ নয়, বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া বেশি প্রয়োজন

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের শেষ দিনে অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি দিল্লির মৌর্য শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, তাৎণিকভাবে কোন বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সুফল বয়ে আনবে। এর উত্তরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতের ১০০ কোটি ডলারের (প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা) ঋণসহায়তা আমাদের অনেক উপকারে আসবে।’
ভারতের দেওয়া ঋণ উপকারে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে এটিকেই বড় সাফল্য ধরে নেওয়াটা কতখানি যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সবচেয়ে বড় কথা ঋণ পাওয়াটাই সফরের বড় অর্জন হিসেবে দেখা ঠিক নয়। ঋণ নয়, বাজার সুবিধা কতখানি বাড়লো সেটাই হতে হবে আলোচনার মূল বিষয়। অথচ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে বাংলাদেশ ভারতের বাজারে প্রবেশের বাড়তি কি সুবিধা পেলো সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এমনকি বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানিতে ভারত যেসব অশুল্ক বাধা দিয়ে আসছে সেগুলো কতখানি দূর হলো তাও ভাল করে জানা গেল না।
একটা সময় ছিল যখন ঋণ পাওয়াই ছিল বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য । বাংলাদেশের পরিচয় ছিল পরনির্ভর একটি দেশ হিসেবে। ৮০ এর দশকে এরশাদের শাসনামলে উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ছিল বৈদেশিক ঋণ নির্ভর, এমনকি রাজস্ব বাজেটেও ঢুকে পড়েছিল বৈদেশিক ঋণ।
১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৬ শতাংশ। এর বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি, আর প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, প্রায় ২ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ সে সময় ছিল অনেকটাই পরনির্ভর, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার ক্ষেত্রে। তখন প্রতিবছর প্যারিসে সাহায্য দাতাদের বৈঠক হতো। কোন সরকার কতখানি সফল তা মাপা হতো সেখানে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার পরিমানের উপর।
সেই বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন দেশটির বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রায় ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণ গৌণ হয়ে পড়েছে, উঠে এসেছে বাণিজ্য।
সবমিলিয়ে বলা যায় ঋণ নির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্য নির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। ঋণ পাওয়া এখন বাংলাদেশের মূল ল্য নয়, বরং বাজার সুবিধা পাওয়াই প্রধান ল্য। এই বাজার সুবিধা পেতে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারত ও চীনে বেশি বেশি পণ্য রপ্তানি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি দুই প্রতিবেশি দেশের সাথে। নিকট প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ৩শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, চীনের সাথে আড়াইশ কোটি ডলারের বেশি। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি পণ্য রপ্তানির বিদ্যমান অশুল্ক বাঁধা দূর করাও জরুরী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে এ েেত্র গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে বলে সকলেরই আশা ছিল।
যৌথ ঘোষণার ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে রেলওয়ে অবকাঠামো, রেল ইঞ্জিন ও বগি, সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের উন্নয়ন, আর্টিকুলেট বাসসহ বিভিন্ন বাস ক্রয় এবং ড্রেজিং প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করার জন্য এক বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন।’
প্রথমত: যৌথ ঘোষণা থেকে মনে হতে পারে, ভারতের দেওয়া ঋণ সরবরাহকারীর ঋণের (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) মতোই। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট শর্তযুক্ত ঋণ। সরবরাহকারী দেশের শর্ত অনুযায়ী এই ঋণ ব্যবহার করতে হয়। যেমন সরবরাহকারী দেশ হয়তো বলে দিলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তারাই ঋণ দেবে, কিন্তু কাজটি তাদের দিয়েই করাতে হবে। সুতরাং প্রশ্ন হলো, ট্রানজিট, বন্দর ব্যবহার, রেল ও সড়ক যোগাযোগসহ যে ধরণের সুযোগ সুবিধা ভারতকে দেওয়া হচ্ছে সেগুলো ভালভাবে পেতেই কি এসব প্রকল্প এবং ১শ কোটি ডলার ঋণ। যৌথ ঘোষণায় যে সব প্রকল্পের কথা বলা আছে সেগুলো বাস্তবায়ন না করলে কি ঋণ পাওয়া যাবে না। নাকি, এই ১শ কোটি ডলার যেখানে খুশী সেখানে খরচ করা যাবে।
ভারতে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে স্থল বন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, সীমান্ত এলাকার অবকাঠামোও ভাল করতে হবে। বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনষ্টিটিউশনের (বিএসটিআই) দতা ও সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন। বাণিজ্য বাড়ানোর স্বার্থে যদি ১শ কোটি ডলারের ঋণকে এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাহলেই হয়তো বাংলাদেশ লাভবান হতে পারবে।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের জন্য ঋণ পাওয়া এখন তেমন বড় কোনো সমস্যা না। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন বা রেলওয়ের সংস্কারের কথা বলে বহুজাতিক দাতাসংস্থাদের কাছ থেকে এর চেয়েও বেশি এবং সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া সম্ভব। বিশ্বব্যাংক যে সহজ শর্তের ঋণ দেয় তা ৩৫ থেকে ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হয়, আরও বাড়তি ১০ বছর পাওয়া যায়। এ জন্য সুদ নয়, সার্ভিস চার্জ হিসেবে দিতে হয় দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতের প্রতিশ্রুত এই ঋণের জন্য ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। তবে যত সহজ শর্তই হোক না কেন, বলা যায় ঋণ পাওয়া নয় ঋণ ব্যবহার করাই বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা।
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ১৭৯ কোটি ডলার ঋণ এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে। ব্যবহার করতে না পারাসহ নানা কারণে এখন পর্যন্ত ১৭৫ কোটি ডলার ঋণ বাতিল করেছে তারা। অন্যান্য দাতাসংস্থার হিসেব নিলে অব্যবহৃত ঋণের পরিমাণ ৪শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি রেলওয়ে সংস্কার প্রকল্পের প্রায় ৪৬ কোটি ডলার পড়ে আছে, ছাড় করাতে পারছে না।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, এই ঋণের অর্থ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে ব্যবহার করা যাবে। ১শ কোটি ডলার বা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) চার ভাগের এক ভাগেরও কম। তার উপর এডিপি ব্যবহার করতে না পারার অদতা তো আছেই। এডিপি বাস্তবায়নের সামর্থ্য ক্রমান্বয়ে কমছে। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। সুতরাং ঋণের টাকা এডিপিতে খরচ করার সমতাও বড় ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন। সরকার যে ভাল বিনিয়োগকারী নন সেটি মোটামুটি প্রমানিত।
সুতরাং কোনো অবস্থাতেই ভারত থেকে ১শ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া বড় ধরণের অর্জন হতে পারে না। ঋণের অভাবে অর্থনীতির কোনো কিছু থেমে নেই। আর ভারত থেকে ঋণ নয়, বাণিজ্য সুবিধা পাওয়াই হবে বেশি লাভজনক এবং কার্যকরী। সুকরাং বাজার সুবিধা পাওয়াই হওয়া উচিৎ যে কোনো দেশের ক্ষেত্রেই, যে কোনো অর্থনৈতিক আলোচনার মূল নীতি।
বাংলাদেশ বহুদিন ধরে ভারতের কাছ থেকে শূণ্য শুল্ক সুবিধা চেয়ে আসছে। বিগত আওয়ামী লীগের সময় অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকেই এই আলোচনা চলে আসছে। ভারত ৪৬০টি স্পর্শকাতর পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এ থেকে ৪৭টি পণ্যে শুল্ক সুবিধা দেবে বলে অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই ৪৭টি কি ধরণের পণ্য, বাংলাদেশ এসব পণ্য তৈরি করে কীনা, বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হলো-তা এখনো কিছুই জানা গেল না। সফরেও জানা যায়নি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কিছু জানে না। বাংলাদেশের আশা ছিল ভারতের পে কোনো স্পর্শকাতর তালিকাই থাকবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য বাজার খুলে দিতে হচ্ছে। গত নভেম্বরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিওর বৈঠকে জানুয়ারী থেকে বাজার খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ব্রাজিল। ভারতকেও একই ধরণের ঘোষনা দিতে হবে। একারণেও আশা ছিল ভারত হয়তো প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এই সুযোগটা নেবে। কিন্তু তারা কোনো ঘোষণাই দিল না।
সফরে একটি যৌথ ঘোষণা হয়েছে। এখন এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পালা। আর এ কাজটি করবে আমলারা। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, আলোচনার টেবিলে আমরা দুর্বল। সুতরাং যৌথ ঘোষণার আলোকে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সুবিধা আদায় করতে হলে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। আর তা করা না গেলে যৌথ ঘোষণায় দেওয়া যে কোনো সুবিধা আদায় করাই দুষ্কর হয়ে পড়বে।

আজ প্রথম আলোতে প্রকাশিত
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×