ভাই কতো নিল? উত্তর আসেঃ ১৮। “নারে এক্কেরে ঠাসা জিনিষ পাইসে। গোস্ত চাইর মণের কম হইব না। রঙটা দেখসস? পুরাই লাল্লু”- অনেক হিসাব নিকাশ করে বলি আমার সাথের বন্ধুটিকে। বলছি আমার শৈশবের কথা। ছিলাম শেরে বাংলা নগরের সরকারি কলোনিতে। আমার জন্ম, বড় হয়ে উঠা সব ঐখানে। তারপর ২০০৫ সালে বাবার অবসরে যাবার কারণে ছেড়ে আসি আমার প্রিয় এলাকা। যদিও ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। খেলাধুলা ছেড়ে দিয়েছি প্রায়। তবু ঈদ গুলোকে ঘিরে যে আনন্দ বিশেষ করে ঈদ এর আগের রাতের চাঁদ দেখার যে উল্লাস তা ভাষায় বুঝানোর না।
এলাকায় রকিব চাচা নামের একজন বিত্তশালী ছিল যার অভ্যাস ছিল ঈদ এর এক মাস আগে একটা ঠেঙা,লম্বা,সাদা বলদ অনেক দাম দিয়ে কিনে এনে বাসার সামনে দাড় করায়ে রাখা। এই চিত্রটা ছিল প্রতি বছরের। শুধু গরু আর তার দাম পরিবর্তন হতো কিন্তু আকার, আকৃতি ও রঙ সব ছিল অপরিবর্তনীয়। ভালই লাগতো দেখে এই ভেবে যে যাক ঈদ বুঝি আসলো বলে। রকিব চাচা গরু কিনসে। কুরবানির ঈদ এর চাঁদ দেখা নিয়ে হুলস্থুল হয়না কারণ ১০ দিন আগে চাঁদ দেখা হয়। তাই চাচার গরু কিনে আনা দেখে আমরা বুযতাম ঈদ বেশি দেরি নেই। ঈদ এর দিন যতো এগিয়ে আসতে থাকে এলাকায় গরুর হাম্বা হাম্বা ধ্বনির তীব্রতা তত বাড়তে থাকে। আমরা বন্ধুরা যারা গরুর ব্যাপারে অতি উৎসাহী(আমি সহ) তাদের কাজ ছিল ঈদ এর ২/১ দিন আগে থেকে মেইন রোড পাশে যেয়ে দাড়িয়ে থাকা এবং রাস্তা দিয়ে যতো গরু যায় তার দাম জিজ্ঞেস করা। আমাদের গরু সাধারণত ২ দিন আগে কেনা হতো তাই যে কোন ভাবেই হোক নিজেদের গরুটা সব চেয়ে সস্তা এটা প্রমান করাই ছিল যার যার মূল লক্ষ্য। এমন কি এই নিয়ে তর্ক থেকে শুরু করে মারামারি হয়ে যেত অনেক সময়।
বয়স একটু বাড়ার সাথে সাথে নিয়মিত গাবতলি গরুর হাটে যেতাম। তখন ঢাকায় খুব বেশি হাট বসতো না। এখন অবশ্য সবখানে গরু, ছাগল বিক্রি হয়। গরু কিনে বাসায় ওইটাকে দাবড়িয়ে নিয়ে আসাটা ছিল আরেক মজার কাহিনী। এর গরু দৌড় দেয়, ওর গরু হাটতে পারে না বসে থাকে রাস্তায়, আবার কারো কারো গরু অন্য গরুর পিঠে উঠে যায়। হয়তো এটা ওদের আলিঙ্গনের ভাষা।
মজার ঘটনা হল একটা ব্যাপার আমি বারবার ঘটতে দেখেছি তা হল ঈদ এর দিন সকালে গরুর চোখ ভেজা। এটা আমি বহুবার দেখেছি অনেক গুলো প্রচলিত কথার মাঝে একটা হল ঈদ এর আগের রাত্রে প্রাণী গুলো জানতে পারে ওদের কাল জবাই করা হবে তাই কাঁদে ওরা। সত্য হতে পারে বোবা প্রাণী অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আনন্দ উপভোগের ধরণ পাল্টায়। ছোটবেলার মত গরু নিয়ে এত হৈচৈ করতাম না ঠিক কিন্তু ছোট বাচ্চাদের আনন্দ ঠিক উপভোগ করতাম।
একবার এলাকার এক বড় ভাই ঈদ এর আগের রাত্রে গরু কিনতে যেয়ে এক গাভী কিনে আনলো। কারণ বাজারে ষাঁড় গরুর সংকট ছিল। পুরো এলাকা ছড়িয়ে পড়লো অমুক ভাই বিয়ে করসে। পরে ভালো করে খোঁজ নিয়ে জানা গেল উনি আসলে গাভী কিনে আনসে। প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত ছেলেদের যা হয় তাই হল। অহেতুক বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হল।
কানাডা আসলাম প্রায় ২ মাস। ইউনিভার্সিটি অফ আলবারটা তে কেমিস্ট্রি তে পিএচডি করতে এসেছি। আগেই জানতাম এখানের ঈদ উপভোগের করুন কাহিনী। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু ছাড়া ঈদ উদযাপন কতোটা নীরস তা বুঝতে আমার বাকি নেই। ঈদ এর দিন ভার্সিটি ক্লাস, মীটিং থাকে, ল্যাবে যেতে হয়। এবার নিজেই স্বীকার হলাম এই উদ্ভট পরিস্থিতির। সকালে নামাজ পড়েই ১১.০০ টায় মীটিং!
এখানে কেউ কুরবানি দিতে চাইলে আগে থেকে বলে রাখতে হয় স্লাটার হাউস গুলোতে। এদের এজেন্ট থাকে তাদের মাধ্যমে হয় ঘটে পুরো ব্যাপার। নিজের গরু নিজে দেখার সৌভাগ্য নেই। পে করো মাংস আসবে প্যাকেট করে বাসায়। তাও আবার ঈদ এর দুইদিন পর।
ঈদের দিন দুপুরে বাসায় সবার আগে কলিজা, মাংস এনে রান্না আর সাদা রুটি দিয়ে খাওয়া এটা আমার বাসার বহু বছরের রীতি ছিল। আমি বরাবরের মত রেকর্ড সংখ্যক রুটি খেতাম। নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙতাম প্রতিবার।
কতো সৃতি, কতো আনন্দ, কতো ঘটনা লিখতে বসলে কয়েকশো পেজ হয়ে যাবে। সময় চলে যায়, বয়সও থেমে থাকেনা কিন্তু ছোটবেলার সৃতিগুলো আজও জ্বলজ্বল করে সৃতির পাতায়। অনেকটা ধুলো পড়া ডায়েরির মত এক ফুঁতে সব ধুলো ঝেড়ে ফেলে দিলে আবার নতুন হয়ে যায় সৃতিগুলো।
এডমনটন এর জনসংখ্যা অনেক কম। আয়তনে ঢাকার দিগুন আর জনসংখ্যায় ঢাকার ২০ ভাগের এক ভাগ। খুব ছিমছাম গোছান একটা শহর। জীবনযাপনের সমস্ত সুবিধা এখানে আছে। আক্ষরিক অর্থে কোনকিছুর অভাব নেই। বাস্তবিকভাবে আমরা যারা প্রবাসী তাদের জন্য ব্যাপারটা অন্যরকম। সব কিছু আছে তবু যেন কি নেই। সেই না থাকাগুলো হল আমার মা, আমার পরিবার, আমার বন্ধুরা আর সবার উপর আমার দেশ।
আর এক সপ্তাহ পর ঈদ। রাস্তায় যখন বের হই চারদিকে জনমানব শূন্য। অনেক দূরে দূরে হয়তো কিছু মানুষ চোখে পড়ে। ভার্সিটি গেলে প্রান ফিরে আসে। অনেক মানুষ চোখে পড়ে তখন। ঢাকার মানুষ আমি জন্ম থেকে মানুষের ভিড় দেখে বড় হয়ে উঠা। তাই মানুষ না দেখলে ভালো লাগেনা।
জানি অবাস্তব চিন্তা তবু রাস্তা দিয়ে সেদিন হেটে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম হয়তো দেখব কেউ ছুটে যাচ্ছে গরু নিয়ে রাস্তার ও পাশ দিয়ে আর আমি দূর থেকে জিজ্ঞেস করবো, “ভাই কতো নিলো?” আর তৃপ্তির হাসি নিয়ে সে হয়তো বলবে ১৮।
ছবিটি ২০১১ সালের আমাদের কেনা গরুর

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



