মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে গতকাল সোমবার শ্রীনগরে জনতা ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম মতিউর রহমান (৪৫)। সংঘর্ষে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিকসহ আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি।
স্থানীয় জনগণ একপর্যায়ে শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তবে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। এ ছাড়া পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর ও সাংবাদিকের একটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় পুলিশের গাড়ি থেকে তিনটি শটগান খোয়া যায় বলে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।
অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। গোটা এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত ৭০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে বাধা এবং সংঘর্ষের ঘটনায় চার হাজার ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রতিবাদে অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয় আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটি। এলাকাবাসী অবরোধ পালন করতে রাস্তায় নামলে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান বাদল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংঘর্ষে ঠিক কতজন গ্রামবাসী আহত হয়েছে, তা এখনো আমরা জানতে পারিনি। শত বাধায়ও আমাদের আন্দোলন থামানো যাবে না। এখনো পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হয়নি। তবে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর প্রতিরোধে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
পুলিশ, এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটির অবরোধের ঘোষণায় গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সকাল ১০টার দিকে শ্রীনগরের হাসাড়া বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয়। বাড়ৈখালী, নবাবগঞ্জ ও দোহারের আশপাশ এলাকা থেকে অনেক মানুষ তাতে যোগ দেয়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রথমে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং একপর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশ জনতার দিকে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে এবং ব্যাপক লাঠিপেটা করে। স্থানীয় জনতাও পুলিশের ওপর হামলা চালায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, বিকেল সোয়া ৩টার দিকে আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাজাহান বাদল, বাড়ৈখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মাস্টারসহ কয়েকজন নেতা মোটরসাইকেলে হাসাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় টহল দিয়ে হাত-মাইকে বিক্ষোভরত জনতাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। এরপর অবরোধকারীরা বাড়ি ফিরে যায়। পরে পুলিশ মহাসড়কে ফেলে রাখা গাছ সরিয়ে নিলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
নিহত মতিউর রহমান ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন। সংঘর্ষের সময় গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এসআই মতিউর রহমান দুই সন্তানের জনক। তাঁর বাবার নাম গোলাম রসুল। গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার চরআতি খাপাড়ায়। তাঁর পরিবারের সদস্যরা সবাই নওগাঁয় থাকেন।
সংঘর্ষে গুরুতর আহতদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন মুন্সীগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শফিউল আলম, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) দেওয়ান লালন আহমেদ, সিরাজদিখান থানার এসআই কামাল, এএসআই মনির, পুলিশ সদস্য আজিজুল ইসলাম, মনির, মনিরুজ্জামান, রিজার্ভ পুলিশ সদস্য আনোয়ার, মফিজুল ইসলাম, আর্মড পুলিশ সদস্য রফিকুল ও শাকিল, সাংবাদিক সাজেদুল ইসলাম ও শফিউদ্দিন লিটু।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, দুপুর পৌনে ১টার দিকে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া জনগণ শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ছনবাড়ী এলাকায় অবরোধকারীরা মিছিল নিয়ে শ্রীনগর বাজারের দিকে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে অবরোধকারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ বেশ কয়েকটি রাবার বুলেট ছোড়ে। এরপর অবরোধকারীরা ষোলঘর এলাকায় ভাঙচুর চালায়। শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ী এলাকা থেকে সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ছিল অবরোধকারীদের দখলে। গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে তারা মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে।
যাত্রীদের দুর্ভোগ : মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। লোকজনকে হেঁটে বিভিন্ন বিকল্প পথে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। সকাল ৯টা থেকে কিছু বাস মাওয়া থেকে লৌহজং-টঙ্গিবাড়ী হয়ে মুক্তারপুর সেতু দিয়ে নারায়ণগঞ্জের পাগলা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করে। বাসগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়।
কেরানীগঞ্জ অচল : আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে গতকাল বিল রক্ষা কমিটির ডাকে সাড়া দিয়ে এলাকাবাসী ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ করলে সকাল ১০টা থেকে কেরানীগঞ্জ অচল হয়ে পড়ে। ঢাকা থেকে সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চলগামী এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা-মাওয়া পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। কেরানীগঞ্জের বুক চিরে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু ও চীন মৈত্রী সেতু দিয়ে যান চলাচলও বন্ধ ছিল। কদমতলী গোল চত্বর, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ও ধলেশ্বরী সেতু এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
হাসপাতালের চিত্র : শ্রীনগরে সংঘর্ষের ঘটনায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ডে) আহত অবস্থায় ছয় পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে এসআই মতিউর রহমান মারা যান। হাসপাতালে ভর্তি অন্যরা হলেন সুবেদার আবদুল হক, নায়েক গাজীউর রহমান, কনস্টেবল আলিমুদ্দিন, সাহাবুদ্দিন ও মাফিজুল্লাহ। এর মধ্যে সুবেদার আবদুল হকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আরো ছয় পুলিশ সদস্যকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁরা হলেন এসআই মোস্তফা কামাল পাশা, হাবিলদার মনির হোসেন, নায়েক মফিজুল, হাবিলদার আবুল কাশেম ও কনস্টেবল আজান। তাঁদের মধ্যে এসআই কামাল মোস্তফা পাশার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে হাসপাতালে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।
এদিকে নিহত পুলিশ সদস্য ও আহতদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের আইজি সাংবাদিকদের বলেন, মুন্সীগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যদের ওপর অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীরা হামলা করেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সকাল থেকেই ওই এলাকায় পুলিশের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ চলছিল। ডিএমপির রায়ট (দাঙ্গা দমন) বিভাগ থেকে পুলিশের পিকআপে করে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছি। শ্রীনগর বাজারের কাছাকাছি গেলে এলাকাবাসী আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রথমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর পুলিশ নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করলে আবারও হামলা চালায়। দ্বিতীয় দফায় তারা লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক মারধর করে।’