শুধু ছন্দই কবিতা নয় কবিতার থাকে আরো অনেক উপাদান/শঙ্খ ঘোষ
:: কথোপকথনের পরে লিখেছেন সফেদ ফরাজী
কবিতায় তরুণরা, বিশেষত বাংলাদেশের তরুণ কবিরা ছন্দকে কেউ বুঝে কিংবা কেউ না বুঝে প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার বাদই দিয়েছেন প্রায়। এটা আপনি (শঙ্খ ঘোষ) কিভাবে দেখেন? সঙ্গে আরও যোগ করলাম, আমি নিজে যখন কবিতা লিখতে বসি, তখন প্রচল ছন্দের বিষয়টি মাথায় নিয়ে কবিতা লিখতে চাইলে কখনো কখনো কেমন যেন বাধার সম্মুখীন হচ্ছি বলে মনে হয়, কেন যেন মনে হয় ছন্দের জন্য, মাত্রা মেলানোর জন্য কবিতাটিতে আমি আমার মনের ভাবটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। তো ছন্দ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই। এর পর শঙ্খ ঘোষ বলতে শুরু করলেন, কবিতায় ছন্দ ব্যবহার করা, না করা, এটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ যদি মনে করে আমি ছন্দে লিখব না, সে লিখবে না। ছন্দে লিখতেই হবে এমন তো কথা নেই। তবে চিত্রশিল্পী যেমন একটি শিল্পকর্ম নির্মাণের আগে তার রঙ, রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানো বিষয়ে একটি ধারণা নিয়েই শিল্পকর্ম করতে বসেন। অবশ্য কেউ ইচ্ছে করলে রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর সুনির্দিষ্ট ধারণা ছাড়াও রঙ নিয়ে বসে তুলি চালাতে পারেন। কিন্তু রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকার পর যদি তিনি তার সেই ধারণায় তুলি না চালিয়ে অন্য কোনো প্রকারে তুলি চালান, চালাতে পারেন। তার তো বিষয়টি জানা আছে, কোনভাবে চালালে কি হয়। না জানলে সেটি হয়তো অন্য বিষয় হবে। এ জন্য বলি, ছন্দটা জানা থাকা দরকার। ছন্দটা জানা থাকলে ছন্দ ভাঙাটা সহজ হয়। শিল্পের বিষয়টিই তো পরিশ্রমের। কেউ যদি সেই পরিশ্রম না করতে চায়, করবে না। আপনার যদি মনে হয় ছন্দের জন্য আপনি আপনার মনের ভাবটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারছেন না, তাহলে ছন্দের ব্যবহার করবেন কেন? এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে যে, যারা ছন্দ ব্যবহার করেন, মিল দিয়ে কবিতা লিখেন তারা কি মনের সম্পূর্ণভাব প্রকাশ করতে পারেন না? আবার অনেকে মনে করেন কবিতায় অন্তমিলটাই বুঝি ছন্দ! তা তো নয়। প্রচল ৩টি ছন্দের ভেতরই লিখতে হবে এমন তো কথা নেই। এগুলো জেনে, এগুলো ভেঙে নতুন কিছুও হতেই পারে। ছন্দ ছাড়া যে কবিতা হবে না এমনটি নয়।
কলকাতায়ও ছন্দ বিষয়ে তরুণদের অনীহা আছে। তাদের অনেকেই আমাকে বলেছে, ‘ছন্দের দিন শেষ, বিশ্ব কবিতা থেকে ছন্দ উঠে যাচ্ছে, তাহলে আমরা কেন ছন্দ নিয়ে পড়ে থাকব।’ কিন্তু মজার বিষয় হলো, গত ৪০-৫০ বছরের বিদেশি কবিতার যতগুলো উল্লেখযোগ্য জার্নাল আমার হাতে এসেছে, তাতে লক্ষ্য করে দেখেছি, কোথাও ছন্দহীন কবিতা নেই, সবখানেই ছন্দে কবিতা লিখা হয়েছে, হচ্ছে। ব্যতিক্রম ২-১টি যে নেই, তা নয়। তাহলে কী করে বলি যে, বিশ্ব কবিতা থেকে ছন্দ উঠে যাচ্ছে!
একবার পদাতিকের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতার বই প্রকাশ পাওয়ার পর তা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন ‘সুভাষ, একি করল, একি করল’! বুদ্ধদেব বসু তো এ বিষয়ে একটি গদ্য লিখেও ছাপিয়েছিলেন। বিষয়টি হয়েছিল, সুভাষ দার ওই বইয়ের কবিতায় মনে হচ্ছিল কোথাও ছন্দের মাত্রা ঠিক আছে, কোথাও নেই। পরে দেখা গেল যে তিনি অক্ষরবৃত্তেই কবিতাগুলো লিখেছেন কিন্তু কোথাও কোথাও মাত্রা ভেঙে নতুন বিন্যাস করেছেন। তো একদিন সুভাষ দা আর আমি রাতের বেলায় এক সঙ্গে হাঁটছি, এমন সময় জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আপনি এই কাজটি কেমন করে করলেন? সেই রাতের অন্ধকারে সুভাষ দা আমার হাত জাপটে ধরে বললেন, বিশ্বাস করো, আমি এই বইয়ে এমন কি লিখেছি, আমি নিজেই জানি না। আমি তো তোমাদের মতো এত ছন্দ জানি না। এটি লিখার সময় ছন্দ সম্পর্কে আমি কোনো চিন্তাই করিনি, ছন্দ গুনে গুনেও লিখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কিভাবে এটি সম্ভব হলো? উনি বললেন, আমি প্রথমে লক্ষ্য করেছি মানুষ কিভাবে কথা বলে, আর আমার চেনা একটি ধোপা বাড়ি ছিল, সেখানে ধোপারা কাপড় কাচার সময় যেভাবে শব্দ করে, সেই শব্দের রেশটি আমার কানে ছিল। এই তো।
ছন্দ বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য বই ‘ছন্দের বারান্দা’। এটি সম্পর্কে তিনি জানান, ছন্দের বারান্দা বইটি আসলে প্রাথমিক ছন্দ শিক্ষার বই না। এটিতে কয়েকজনের কিছু কবিতা নিয়ে ছন্দ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। কারো যদি ছন্দ সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে এটি পড়তে পারবেন না। কলকাতায়ও এটিকে ছন্দ শিক্ষার বই ভেবে ভুল করেন অনেকেই। একবার দেখলাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রেফারেন্স বইয়ের তালিকায় এ বইটির নাম। হয়তো নির্বাচকমণ্ডলী এ বইটি সম্পর্কে না জেনেই রেফারেন্স বইয়ের তালিকাভুক্ত করে থাকবেন।
যারা ছন্দ জানেন, তাদের কিছুটা উপকারে আসতে পারে এটি। আসলে ছন্দ বিষয়টিই অভ্যাসের ব্যাপার। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে ছন্দে, ছন্দ ভেঙে, যে কোনোভাবেই কবিতা লেখা যায়। আর ছন্দ বিষয়টি তো অনেকটা কানের ব্যাপার। লক্ষ্য করতে হবে, কান কি বলে। আর শুধু ছন্দই তো কবিতা নয়, কবিতার থাকে আরো অনেক উপাদান। অনেকের কবিতায় দেখা যায় ছন্দ মাত্রা তাল লয় সব ঠিকই আছে, কিন্তু ওতে কবিতা নেই। শুধু ছন্দ মাত্রার জন্যই কি কবিতা পড়ে কেউ? মূল ব্যাপারটি হলো, কবিতাটি কবিতা হয়ে উঠলো কি না। কবিতা হয়ে উঠাটাই আসল বিষয়।
‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ শঙ্খ ঘোষের উল্লেখযোগ্য একটি কাব্যগ্রন্থ। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ লেখার পটভূমি বিষয়ে জানতে চাইলে কবি জানালেন, তখন ১৯৮৭ সালের দিকে শিমলাতে থাকতাম। ওখানে গিয়েছিলাম এক বছরের জন্য। আমাকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছিল একটি শর্তে, আমি সেখানে থাকব আর লেখালেখি করব। এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার। তো গেলাম শিমলাতে। সেখানে যে বাড়িটিতে থাকতাম, সেটি ছিল পুরনো গভর্নেন্স হাউস। বিশাল বড় বাড়ি। লোকজন কেউ থাকে না। একা আমি। অনেকেই বলতেন, এই বাড়িতে ভূত আছে। একবার একজন এসেছিলেন আমার সঙ্গে সেই বাড়িটিতে থাকার জন্য। একরাত থেকে পরদিনই ব্যাগট্যাগ গুছাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? কোথাও যাচ্ছেন? তিনি বললেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এই বাড়িতে ভূত আছে। আমি বললাম, আপনি ভূত দেখেছেন? উনি বললেন, না দেখিনি, তবে আছে মনে হয়। তো সেই বাড়িতে থাকাকালে একদিন মেঘ কুয়াশা ঘেরা সকালবেলায় খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর কবিতা। একটানে ৫টি কবিতা লিখে ফেললাম। ৬ নম্বর কবিতাটার দেড় লাইন লেখার পরই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। কে যেন কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দেখি আমার পরিচিত একজন। উনি বললেন, কি কিছু করছেন, বিরক্ত করলাম না তো? আমি বললাম, না না, কিছু করছি না, আসুন ভেতরে আসুন। উনি ভেতরে এলেন। উনার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলার পর উনি চলে গেলেন। এর পর আমি আবার টেবিলে গিয়ে বসলাম, কাগজ-কলম নিয়ে অসমাপ্ত কবিতাটি লিখতে চাইলাম। কিন্তু সেটি আর হলো না, সেই দেড় লাইনের কবিতাটিকে আমি আর সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। এর পর বিভিন্ন সময়ে ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। কিন্তু সেই না লিখতে পারা কবিতাটির জন্য সারা জীবন একটি দুঃখ থেকে গেলো!
সৌজন্যে : দৈনিক ডেসটিনি সাহিত্য সাময়িকী ২৪ অক্টোবর ২০০৮, সপ্তডিঙা।