মহান আল্লাহতায়ালা নিজ নূর হতে 'নূরে মোহাম্মদী' কে পৃথক করে সৃ্ষ্টির বৈচিত্রময় অপার লীলা শুরু করেছেন। 'নূরে মোহাম্মদী' হতে সমস্ত সৃষ্টি জগত ও মানুষের আত্মা সমূহ সৃষ্ট করত আপন জীব-প্রবৃত্তিকে নিবৃত করে আল্লাহর গূণে গুনাণ্বিত হয়ে তার সাথে ফানা-বাকা হাসিল করার জন্য মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আদিকাল থেকে মানুষ জীব প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে আল্লাহকে ভূলে সত্যর পথ হারিয়ে পাপের দিকে ধাবিত হয়ে চরম অশান্তির মাঝে নিপতিত হয়েছে। ধ্বংসের পথে ধাবমান গুনাহগার মানুষদের হেদয়েত করে সত্যর পথে তুলে দেয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা 'নুরে মোহাম্মদী'র ধারক হিসেবে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরন করেছেন। তারা সকলেই সমকালীন সময়ের মানুষের নিকট আল্লাহর একত্ববাদের বানী প্রচার করে পাপকালিমায় নিমজ্ঝিত মানুষদের উদ্ধার করে সত্যর পথে তুলে এনেছেন। সর্বশেষে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীব হযরত রাসূল (স) কে শান্তির দূত হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরন করেছেন।
হযরত রাসূল (স) পৃথিবীর এক চরম ক্রান্তি লগ্নে ধরনীর বুকে আগমন করেছিলেন। অনাচার,অবিচার ও কুসংস্কার পৃথিবীর জনজীবন তখন একেবারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববাসীর ঐ চরম দুর্দিনে হযরত রাসূল (স) মানুষের দুর্দশা দেখে বিচলিত হয়ে মুক্তির পথ অন্বেষনে ব্যকূল হয়ে উঠেন। অবশেষে তিনি হেরা গূহায় পনের বছর মোরাকাবা তথা ধ্যন সাধনার পর আল্লাহর সন্ধান লাভ করে শান্তির ধর্ম ইসলামের পয়গাম পান।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে হযরত রাসূল (স) মানুষকে শুধুমাত্র কালেমার দাওয়াত দিতেন। অর্থাৎ আল্লাহ এক এবং তিনি তার রাসূল - এ কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করার জন্য মানুষের প্রতি আহবান জানাতেন। তার এই আহবানের মূল বিষয় বস্তু ছিল- মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি এবং আবার আল্লাহর
কাছেই মানুষকে ফিরে যেতে হবে। সুতরাং এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মায়াজালে পড়ে আল্লাহকে ভূলে পাপ পন্কিলতায় না জড়িয়ে সৎ পথ অবলম্বন করে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকা সকলেরই কর্তব্য।
হযরত রাসূল (স) এর আধ্যাত্মিক মহাশক্তির বদৌলতে তখন তার কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করে ইসলাম কবূল করার সাথে সাথেই মানুষের অন্তরের সকল পাপ-কালিমা বিদুরীত হয়ে আল্লাহর সুপ্ত নূর শিক্ষা প্রজ্ঝলিত হয়ে উঠতো। মানুষ রাসূল (স) এর জন্য দেওয়ানা হয়ে যেত। যেমন হযরত ওমর (র) বে দ্বীন কোরায়েশদের সাথে পরামর্শ করে একশত উটের বিনিময়ে হযরত রাসূল (স) এর শিরচ্ছেদ করার সংকল্প করে তার মাথা মোবারক কাটার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু ওমর (র) হযরত রাসূল (স) এর নিকট গমন করে তার নুরানীময় চেহরা মোবারক দর্শনের সাথে সাথে তার অন্তরে কম্পন শুরু হয়ে যায়। তখন ওমর (র) হযরত রাসূল (স) এর মাথা মোবারক কাটার পরিবর্তে তার কদম মোবারকে লুটিয়ে পড়ে ইসলাম কবুল করে নিলেন। তাছাড়া হযরত বেলাল (র), হযরত এর কথা শ্রবণ করে ইসলাম কবূল করার সাথে সাথে তিনি রাসূল (স) এর এশকে দেওয়ানা হয়ে পড়েন। শত অত্যাচার ও নির্যাতন তখন তাকে রাসূল (স) এর প্রেম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
ইসলামের উন্মেষকালে হযরত রাসূল (স) শিক্ষা বিস্তারকল্পে সক্রিয় পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি সাফা পাহাড়ের পাদদেশে 'দারুল আরকামে' সর্বপ্রথম ইসলামী পাঠাগারের পত্তন করেন। এ শিক্ষাগারে রাসূল (স) নিজেই শিক্ষকতা করতেন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষায়তণের প্রথম ছাত্র ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র), হযরত ওমর (রা) ও অন্যান্য গন্যমান্য সাহাবী বৃন্দ। পরবর্তী পর্যায়ে হযরত রাসূল (স) যখন মদীনায় হিযরত করেন তখন মসজীদে নববী সংলগ্ন বারান্দায় শিক্ষায়তন গড়ে তোলেন। এখানে যারা শিক্ষা গ্রহন করতেন তাদেরকে আহলে সুফফা বলা হতো। হযরত আবূ হোরায়রা (র), হযরত মায়াজ বিন জাবাল (র), হযরত আবুজর গিফারী (র) প্রমুখ বিদ্যোৎসাহী সাহাবীরা ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ছাত্র।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে রাসূল (স) তো কোন যাহেরী বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করেন নাই তাহলে কিভাবে তিনি শিক্ষকতা করতেন? হযরত রাসূল (স) মানুষকে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে নিজেদের চরিত্র সংশোধন করে অর্থাৎ- কাম,ক্রোধ, লোভ,মোহ,মদ ও মাৎসর্য এই ষড়রিপূ থেকে বিমুক্ত হয়ে আল্লাহর উপর আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিতেন। কারণ ষড়রিপূর কারনেই মানুষ পাপ করে আল্লাহ হতে দূরে সড়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, সৃষ্টির আদিতে মানুষের আত্মাসমূহ যখন আলমে আরওয়াহ তে ছিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে জিগ্গাসা করেছিলেন "আমি কি তোমাদের প্রভূ নই? " প্রত্যুত্তরে আত্মাসমূহ বলেছিল" নিশ্চই আপনি আমাদের প্রভূ"। ঐ অবস্থায় আত্মাসমূহ সম্পুর্ণভাবে আত্মসমর্পন করেছিল। কিন্তু যখন আত্মাসমুহকে ষড়রিপুর সংমিশ্রণে দুনিয়াতে পাঠানো হলো তখনই তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আপন ইচ্ছা চরিতার্থ করার কাজে লিপ্ত হলো। পুর্ববর্তী নবীগনের ন্যয় হযরত রাসূল (স) ও মানুষকে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। ফলে মানুষ পাপ কাজ ভূলে আল্লাহর প্রেমে আসক্ত হয়ে পুর্ন আত্মসমর্পন করতে পারতেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সক্ষম হতেন।
মুসলমান শব্দের ব্যখ্যা প্রসংগে জগৎ শ্রেষ্ঠ সূফী সাধকগন ফরমান-মুসলমান ঐ ব্যক্তি যিনি এক আল্লাহর উপর পুর্নভাবে আত্মসমর্পন করে থাকেন। নবুয়তী যুগে যখন যে নবী দুনিয়ায় আগমন করেছেন, তখন তার প্রতি পুর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে তার নির্দেশ যেমন করে মেনে চলতে হয়েছে, তদ্রুপ বেলায়েতের যুগেও যখন যিনি যুগশ্রেষ্ঠ মহামানব, ইমাম হিসেবে হেদায়েতের দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তার প্রতি পূর্ন বিশ্বাস স্হাপন করে তার নির্দেশিত পথে পরিচালিত হওয়াকেই মূলত আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পন বলা হয়েছে। কেননা নবী রাসূল ও অলী-আল্লাহগন আল্লাহর বন্ধু এবং তার মনোনীত ব্যক্তি। দুনিয়ায় তারা আল্লাহর প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। হযরত রাসূল (স) এর শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষকের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সর্বাধিক। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম শিক্ষক হলেন রাসুল(স)। তিনি বলেন " আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি" (ইবনে মাজাহ)। তিনি শিক্ষকরূপে তার দায়িত্ব পালনের পুর্বক্ষনে মক্কাবাসীদের একত্রিত করে প্রশ্ন করেন "আপনাদের মাঝে আম আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ অতিবাহি্ত করেছি। আপনারা আমাকে কেমন পেয়েছেন?" মক্কাবাসীগন উত্তর দিল " চারিত্রিক মাধুর্যে আপনার স্থান সর্বোচ্চ। আপনি অদ্বিতীয়, আপনি অংগীকার রক্ষাকারী, আপনি আল-আমীন। আমরা সারাজীবন আপনার নিকট থেকে সত্যবাদীতাই পেয়েছি, এর ব্যতিক্রম কিছু কোনদিন পাইনি" পবিত্র কোরআনে হযরত রাসূল (স) এর মহান চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেন " নিশ্চই আপনি মহান চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী" (সূরা কলম)।
ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই চরিত্র সংশোধন। হযরত রাসূল (স) আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের যাবতীয় দোষ ত্রুটি সংশোধন করে দিতেন। ফলে বর্বর আরব বাসীরাও রাসূল (স) এর সোহবতে থেকে একটি সুসভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। তখন মুসলমানদের চরিত্রে দয়া মায়া প্রভৃতি গুণাবলীতে সমৃদ্ধ ছিল। তাদের ঈমানী শক্তি এত প্রবল ছিল যে, তারা প্রত্যকেই একাধারে সেবক, সৈনিক, গবেষক প্রভৃতি গুনের অধিকারী ছিলেন। হযরত রাসূল (স)সাহাবাদের নিজ হাতে স্থান কাল পাত্র ভেদে কিরকম আচরন করতে হবে সে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি এজন্যই সোহবতের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। " হে মুমেন গন আল্লাহ কে ভয় কর এবং সাদেকীনদের সংগ লাভ কর ( তওবাহ-১১৯)। তাই জানা যায় আবুবকর (র) এর মতো অনেক সাহাবা যাহেরীভাবে উচ্চ শিক্ষিত হলেও নিজেদের উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আজীবন হযরত রাসূল (স) এর খেদমতে ছিলেন। তাছাড়া ইতিহাস থেকে জানা যায় মুসলমান গন যতক্ষন রাসূল (স) এর সোহবতে থাকতেন ততক্ষন তাদের মনে পার্থিব কোন চিন্তা আসতনা, তাদের ষড়রিপু তখন রাসূল (স) এর তাওয়াজ্জোহ এর প্রভাবে নিস্ক্রিয় থাকত। এভাবে যে যত বেশি রাসূল (স) এর সোহবতে থাকতে পেরেছেন, তার চরি্ত্র ততবেশি উন্ণত হয়েছে।
হযরত রাসূল (স) ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুসলমানদের সাথে আলোচনা করতেন। অধিকন্তু প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে খোৎবায় ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা ও তার সম্পর্কে বিশদ বর্ননা করতেন। জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের উপর গুরুত্বারোপ করার পেছনেও হযরত রাসূল (স)এর সোহবতে যাওয়ার ইংগিত রয়েছে। কারণ তৎকালে রাসূল (স) নিজে নামাজে ইমামতি করতেন।ফলে তারা নামাজের অসীম বরকত হাসিল করতেন। সোহবতের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেই মাওলানা রুমী (র) বলেছেন" এক মুহুর্তে আল্লাহর কোন বন্ধুর সংসর্গে থাকা, একশত বছরের রিয়াবিহিন নফল বন্দেগী হতে উত্তম"
হযরত রাসূল (স) আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চরি্ত্র সংশোধন করতেন। কারন আধ্যাত্মিক সাধনা ব্যতীত কখনো নফসে আম্মারাকে সংশোধন করা যায়না। এ প্রসংগে তিনি একদা সাহাবাদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন " তোমাদের ভেতর যেমন শয়তান আছে, আমার ভেতরেও তদ্রুপ শয়তান আছে। কিন্তু আমার ভেতরের শয়তানকে আমি মুসলমান করেছি অথচ তোমরা এখনো তা করতে পারনি"
হযরত রাসূল (স) যে সাহাবাদের আধ্যাত্মিক এলম শিক্ষা দিতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাহাবাদের জীবনীতে। যেমন হযরত আবুবকর (র) এর সর্বাধিক প্রিয় যে তিনটি কাজ ছিল, তার মধ্য হযরত রাসূল (স) এর চেহারা মোরাকাবা করা অন্যতম ছিল যা আধ্যতিকতায় পরিপুর্ন। হযরত ওমর (র) আধ্যাত্মিক এলম সম্পন্ন ছিলেন বলেই তিনি মসজিদে খোৎবা পাঠরত অবস্থায় যুদ্ধরত মুসলমাদের শত্রুর আক্রমন থেকে নিরাপদ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেকের মতে হযরত আলী (র) আটশত মন ওজনের লৌহের কপাট নিয়ে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবু হোরায়রা (র) বলেছিলেন" আমি হযরত রাসূল (স) এর কাছ থেকে দুই রকম বিদ্যা শিক্ষা করেছি। একটি তোমাদের কাছে প্রকাশ করলাম, অপরটি প্রকাশ করলে আমার গলা কাটা যাবে"
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-হযরত আদম (আ) থেকে হযরত রাসূল (স) পর্যন্ত যত নবী রাসূল দুনিয়াতে আগমন করেছেন, তাদের মধ্য অধিকাংশই নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু তারা সকলেই আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সন্ধান লাভ করেছেন। অনুরুপভাবে হযরত রাসূল (স) ও পনের বছর হেরা পর্বতের গুহায় আধ্যাত্মিক সাধনা করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। পরবর্তীকালে মানুষের সামাজিক সমস্যাবলী সমাধানের জন্য ক্রমান্বয়ে শরীয়তের বিভিন্ন বিধান চালু করেছেন। রাসূল (স) বলেছেন 'শরীয়ত আমার বাক্য, তরীকত আমার কাজ, হকীকত আমার অবস্থা এবং মারেফত আমার নিগুড় রহস্য। অর্থাৎ তার শিক্ষাময় জীবনে শরীয়ত তরীকত হাকিকত ও মারেফতে এতো সুন্দর ও সামন্জ্জস্য পুর্ন ছিল যে, বর্বর আরবরা তার সান্নিধ্য গিয়ে অতি অল্প সময়ে নিজেদের চরিত্র সংশোধন করে একটি সুসভ্য জাতি হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:৩০