অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এমন কতগুলি বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম, কিন্তু তার লাগাম রাষ্ট্রের হাতে থাকাই বাঞ্চনীয়। যেমন উৎপাদন, বন্টন ও বিনিয়োগ। এগুলির যথাযথ তত্ত্বাবধান না হলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, মুষ্টিমেয় লোকেই সকল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্গতির অন্ত রইবে না। মূলত : এই দৃষ্টিকোণ হতেই মানবতার অকৃতিম দরদী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎপাদের পাশাপাশি তা থেকে গরীবদের হক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, ইয়াতীমদের যতœ নিতে বলেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কৃষি জমি অনাবদী ফেলে রাখার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন।
আলোচ্য প্রসঙ্গে যে বিশেষ ক্ষেত্রেগুলিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তার কারণ ও ফলাফল পর্যালোচনা করা দরকার। সেগুলি হচ্ছে-
১। উপার্জন
২। কৃষি
৩। শিল্প ও শ্রমিক এবং
৪। ব্যবসা-বাণিজ্য
উপার্জন : ইসলামী রাষ্ট্র অবশ্যই ব্যক্তির উপার্জনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। উপার্জনের পথ ও পদ্ধতি হালাল বা বৈধ হতে হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সমস্ত সম্পদ ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কেননা সব অবৈধ পন্থাই হচ্ছে হারাম বা মুনকার এবং মুনকার নির্মূল করা ইসলামী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সরকার সুদ, ঘুষ, জুয়া,কালোবাজারী, মজুতদারী, চোরাকারবারী ইত্যাদি সকল হারাম উপায়ে উপার্জনের পথ রুদ্ধ করে দেবে। সরকার এজন্যে আইনের কঠোর ও ত্বরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অপরদিকে যদি অন্যের জমি, সম্পত্তি বা অর্থে কেউ জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে আত্মসাৎ করে থাকে তবে তা উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেবে। তা সম্ভব না হলে ঐ ধন-সম্পদ বায়তুলমালে জমা হবে। এমনকি কোন শাসনকর্তা বা সরকারী কর্মচারী পদের সুযোগ নিয়ে বিত্ত-সম্পত্তি করলে তাও সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। যদি এ কাজ না করা হয়, তবে সমাজে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার অব্যাহত থাকবে। পরিণামে তা রাষ্ট্র ও সমাজের অকল্যাণ ও মারাত্মক দুর্গতি ডেকে আনবে।
কৃষি : কৃষির স্বার্থে বর্গাচাষের শর্ত ও পদ্ধতির কারণে কৃষক যেন অত্যাচারিত না হয় সে বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবিশেষ সতর্ক থাকতে বলেছেন। উপরন্তু জমি যেন অনাবাদী ও পতিত পড়ে না থাকে সে ব্যবস্থা করা সকরকারেই দায়িত্ব। জমির উৎপাদন ক্ষমতা, পরিমাণ ও গুণাগুণের ভিত্তিতে খারাজ নির্ধারণ করা হবে। ট্যাক্স জনগণের জন্যে দুর্বিষহ ভারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে সরকারকেই। কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে কৃষককে সাহায্য করা দরকার। কৃষিপণ্যের বাজার, মূল্য ও সরবরাহের উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে তেমনি কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সঙ্গত দাম হতে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া মূল্য বেড়ে গিয়ে জনগণের ও অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারের অপর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে মীরাস বা উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা। বিশেষত :ইয়াতীম ও স্ত্রীলোক এই বিধানের সুফল পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। বর্তমানে সমাজে ন্যায্য প্রাপ্য হতে ওয়ারিশরা প্রায়ই বঞ্চিত হয়। সৎভাই-বোনেরা বিতাড়িত হয়। এর কারণ মীরাসী আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। পক্ষপাতহীন শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দুর্নীতি দমনে করা সম্ভব। অসিয়ত ও ওয়াকফকৃত জমি যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকেই।
শ্রমিক : রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশের প্রেক্ষিতে একথা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় যে, ইসলামী সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় নিশ্চিত করা। তাদের উপর যাতে জুলুম না হতে পারে তার যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শ্রমিকদের মজুরী যেন তাদের জীবন-যাপনের জন্যে উপযুক্ত হয় তা দেখাও সরকারে দায়িত্ব। শ্রমিকদের জন্য সরকার একটা নিন্মতম মজুরী নির্ধারণ করে দেবে। শিল্পমালিকেরা এই মজুরী দিতে বাধ্য থাকবে। বাস্তবতার আলোকেই সরকার শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা দানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন করবে। শ্রমিকদের নায্য অধিকার সংরক্ষণ, বাসস্থান, চিকিৎসা, বোনাস ইত্যাদির সুবিধাও এই আইনে থাকবে। এসব আইনের উদ্দেশ্যে হবে শ্রমিকদের সত্যিকার স্বার্থ রক্ষা করা।
ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসায়ের সব অবৈধ ও অন্যায় পথ এবং প্রতারণামূলক কাজ নিষিদ্ধ করাই শুধু ইসলামী সরকারের দায়িত্ব নয় বরং তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও দেখা কর্তব্য। ইহতিকার অর্থাৎ অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ওজনে কারচুপিও তাই। এ সমস্তই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। না হলে জনসাধারণ ক্রমাগত ঠকতে থাকবে। এর প্রতিবিধানের জন্যে হিসবাহ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়েছিল। এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় সমাজকে তথা মানব চরিত্রকে কত গভীলভাবে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাঝে মাঝে বাজার পরিদর্শনে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে দোকানদারদের কার্যক্রম লক্ষ্য করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাজার ব্যবস্থার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। পরবর্তীকালে আমীরুল মুমিনীন উমর (রা) একাজ করতেন। এর উদ্দেশ্যে হচ্ছে বাজার যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে। মজুতদারী, মুনাফাখারী, ওজনে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি বাজারে অনুপ্রবেশের সুযোগ না পায়। পন্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর বিধি-নিষেধও সম্ভবপর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে। কারণ, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর বাধা-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করার জন্যে সরকারকে সুষ্ঠু ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যে কোন উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচায়ক হচ্ছে তার সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্যে গৃহীত ব্যবস্থা। প্রচলিত সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শে এজন্যেই সমাজকল্যাণের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সে সবের কোনটিই ইসলামের সমকক্ষ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই জনকল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক জোর ও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে শুধু আল-কুরআনে ও হাদীস শরীফে যে নির্দেশ রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে গোটা সমাজব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হওয়া সম্ভবপর। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আপন আপন মর্জি-মাফিক যতটুকু করতে ইচ্ছুক ততটুকুই মাত্র জনসাধারণ পেতে পারে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে একদলীয় সরকারের নিজস্ব নীতি ও প্রয়োজন অনুসারে জনকল্যাণমূলক নীতি গৃহীত হয়ে থাকে। এর কোনটিই পূর্ণাংগ ও সুষ্ঠ হতে পারে না।
জনকল্যাণের জন্যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ব্যক্তিকেও নিজস্ব সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তির ধন-সম্পত্তিতে অন্যেরও হক বা অধিকার রয়েছে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
وَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ
তুমি আত্মীয় স্বজন ও গরীব এবং পথের কাঙালগণকে তাদের পাওনা দিয়ে দাও।
(সূরা বনি ইসরাইল : ২৬ আয়াত)
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
তোমাদের ধন সম্পদে যাকাত ছাড়াও দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে।
(তিরমিযী)
উপরের আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, কোন ব্যক্তির উপার্জিত অর্থে তার নিজের ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অন্যান্য অভাবগ্রস্তদের অধিকার রয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করে তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সাহায্য করা তার সামাজিক দায়িত্ব। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ এমন না থাকলে প্রতিবেশী বা পরিচিতদের মধ্যে অভাবগ্রস্ত বা প্রয়োজন পূরণে অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করা ঐ ব্যক্তির পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। এমন ব্যাপকভাবে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নির্দেশ পৃথিবীর আর কোন ধর্মে বা মতাদর্শে ইসলামের পূর্বেও দেওয়া হয়নি, পরেও না। বস্তুত: এই নির্দেশের মধ্যে পারষ্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব অনুভূতির প্রেরণা রয়েছে।
জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে ও সমাজের সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন- যাকাত ও বায়তুলমাল। যাকাত কারা দেবে, কিভাবে তা আদায় হবে এবং কারা যাকাতের হকদার সে সম্পর্কে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে বায়তুল মাল সৃষ্টির উদ্দেশ্য, এর অর্থের উৎস ও ব্যয়ের খাত প্রভৃতি সম্বন্ধেও বলা হয়েছে। ইসলামী সমাজে বায়তুলমাল ও যাকাত একযোগে যে বিপুল সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে এবং দু:স্থ, দারিদ্রপীড়িত, অক্ষম, বৃদ্ধ, পঙ্গু, বিধবা ও ইয়াতীম শিশুদের যে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে তা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। ইসলা%E
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১১ রাত ২:০৫