somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাবলীপুরমের যাদু শহরে (চেন্নাই ভ্রমণ) ।

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাদ্রাজ বা চেন্নাইয়ে আমার দ্বিতীয় বারের ভ্রমণ। ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাওয়া হয়নি, কাজেই গিয়েছিলাম। চেন্নাই বা মাদ্রাজ ভ্রমণ আমার মনে দাগ কাটার অনেক কারন আছে। একটি কারন হচ্ছে প্রথমবার চেন্নাই যাত্রা ছিলো আমার প্রথম বিদেশ সফর। সেই ১৯৯৬ সালের ঘটনা। আর এবারের সফর হলো ২০১৬ সালে। অর্থাৎ ঠিক ২০ বছর পর। ২০ বছর দেখে তরুণ পাঠকরা আবার ভাবতে বসে পরতে পারে যে আমার বয়স কতো। হাহাহা। নিজেই বুঝতে পারছি, অনেক বয়স হয়েছে। তবে ঘুরাঘুরি করতে টাকা পয়সা লাগে। তাই বাংলাদেশীদের কপালে কম বয়সের ঘুরাঘুরির সৌভাগ্য হয়না। এটা হুমায়ুন আহমেদের কথা, আমার না। ঘুরতে তিনটি জিনিস লাগে, সময়, স্বাস্থ্য আর টাকা। কম বয়সে প্রথম দুটি থাকলেও টাকা থাকেনা। তাই বাংগালী যখন ঘুরাঘুরির জন্য তৈরী হয় তখন অনেক বয়স হয়ে যায়। ঘুরতে গিয়ে কাহিল হয়ে পরে। তবে আমার সৌভাগ্য, এখনও অতটা বয়স হয়নি। হাটাহাটি বা পাহাড়ে চড়া, মোটামুটি করতে পারি। সে যাক। আসল কথায় আসি।

চেন্নাইয়ের পুরোনো নাম মাদ্রাজ। বাংলাদেশে মাদ্রাজ নামেই বেশি পরিচিত। ভারতে যে চারটি শহর বেশি পরিচিত বা মেগাসিটি হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ মুম্বাই, কোলকাতা, দিল্লি আর চেন্নাই। যদিও ভারতে আরও অনেক বড় বড় শহর আছে, তারপরও এই শহরগুলোই প্রদাশিক রাজধানী হিসেবে বেশি বিখ্যাত। মাদ্রাজে বেড়াতে যেতে চাই শুনতেই সবাই জিজ্ঞেস করেছে, এতো শহর থাকতে মাদ্রাজ কেন? উত্তর ছিলো কাজে যাচ্ছি। আমার ছোট আপা মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন হসপিটালে ট্রেনিং করছে, উনাকে নিয়ে আসবো। সাথে ছোট দুলাভাইও থাকবে। সময় পেলে কিছু ঘুরাঘুরিও করবো। আমাদের টার্গেট মহাবলীপুরম নামের পুরোনো নগর দর্শন। বাংলাদেশীদের কাছে কিছুটা অপরিচিত জায়গা। তবে উইকিপিডিয়ার কল্যানে জানলাম চেন্নাইয়ে পুরো ভারতে মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসে। তাদের প্রধান আকর্ষণ মহাবলীপুরম। ভারতে যে পৌরানিক স্থাপনাগুলো দেখলে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম এই মহাবলীপুরম। চেন্নাই থেকে ৭০ কিলোমিটার দুরের মহাবলীপুরমে একরাত থাকার ব্যবস্থাও করা হলো। আজ থেকে ৮০০ বছর পুরোনো শহরে রাত্রিযাপনের কথা কল্পনা করে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম বার বার।

মহাবলীপুরমের যাওয়ার আগে একটু পিছনের দিকে যেতে চাই। মহাবলীপুরমের কথা বলে আপনাদের পুরো ট্যুরের খুটিনাটি সবকিছুই শোনাতে চাই যাতে আপনারা প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেতে পারেন। আমার ছোট আপা ডাঃ আবিদা সুলতানা চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন হসপিটালে ইনফার্টিলিটির উপর ট্রেনিং করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে চেন্নাই যাত্রা করেন। দু’মাসের ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষে ফেরত আসার সময় ঠিক হয়েছে ফ্রেব্রুয়ারীর ১০ তারিখ। আমি ঠিক করেছিলাম চেন্নাই যাবো ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখে, ফিরবো ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তারিখে। কিন্তু অনেক সময় পরিকল্পনা আর বাস্তবতায় সাথে মিল হয়না। আমারও তাই যাত্রার সময় ঠিক রাখা হলোনা। ভারতীয় দুতাবাসের অসুস্থ্য ভিসা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় বাধ সাধলো। গুচ্ছের টাকা খরচ করে দালাল দিয়ে ভিসার টোকেন সংগ্রহ করে যখন ভিসার ডেট পেলাম তখন ৪ তারিখে যাওয়া সম্ভব নয়। ভিসার ডেলিভারী ডেট পরলো ৪ তারিখ বিকালে। তাই মালডিভিয়ান এয়ারলাইনে ৬ তারিখ টিকেট কাটতে বাধ্য হলাম। আমার সাথে ছোট দুলাভাই ডাঃ আল মামুন মাহবুব আলম, অর্থাৎ মামুন ভাই যাওয়ার কথা ছিলো। উনি সরকারী ডাক্তার, ভারতে ভিসা লাগেনা। উনাকে ৪ তারিখের টিকেট করে দিলাম। আসার সময় তিনজন একসাথে আসবো। ১০ ফেব্রুয়ারী।

বলাকা লাউঞ্জ

সব পরিকল্পনা ফাইনাল হওয়ার পর দেখতে দেখতে ৬ ফ্রেব্রুয়ারী চলে আসলো। মালদ্বীপ এয়ারলাইনে বিকাল ৪.৪৫ মিনিটে ফ্লাইট। এয়ার পোর্টে চলে আসলাম দুুপুর ২টায়। আগে আসাই ভালো। শেষ সময়ের দৌড়াদৌড়ির টেনশন ভালো লাগেনা। বোর্ডিং কার্ড নিতে গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে অনেক শ্রমিক যাচ্ছে। চেন্নাই হয়ে প্লেন যাবে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে। বলে রাখা ভালো চেন্নাইতে যাওয়ার আগেই টুরিষ্ট ভিসা ধারীকে চেন্নাইয়ের হোটেলে বুকিং দিয়ে রাখতে হয় এবং বুকিংয়ের কপি সাথে রাখতে হয়। নতুবা চেন্নাই এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন আপনাকে নাও ঢুকতে দিতে পারে। মাদ্রাজ মেডিকেল মিশনের গেষ্ট হাউসের ঠিকানা বলাতে আর আমার পাসপোর্টে ইন্ডিয়ান ভিসার ছড়াছড়ি দেখে এয়ারলাইনের মেয়েটা বোর্ডিং কার্ড কোন ঝামেলা ছাড়াই দিয়ে দিলো। কিন্তু এক বয়স্ক ভদ্রলোককে প্রচুর কথা শুনিয়ে দিলো দেখলাম। বোর্ডিং করে ইমিগ্রেশন সেরে রূপসী বাংলা হোটেলের বলাকা লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। ভিসা বা মাস্টার কার্ডের প্লাটিনাম কার্ড থাকলে এখানে ফ্রি রেষ্ট নেয়া আর লাঞ্চ করা যায়। বিদেশে যাওয়ার সময় লাউঞ্জগুলোতে সময় কাটানোও একটা বিনোদন। বলাকা লাউঞ্জ পুরোটাই খালি পেলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা লাউঞ্জে কাটিয়ে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করে বোর্ডিং করে প্লেনে উঠলাম।

চেন্নাই এয়ারপোর্টটা নতুন। ভারতের অন্য বড় শহরের আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টগুলোর মতোই সাজানো গোছানো। প্লেন থেকে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে এয়াপোর্টের বাহিরে আসতেই আবিদা আপা আর মামুন ভাইকে অপেক্ষা করতে দেখলাম। উনারা ট্যাক্সি নিয়ে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে। বিদেশে এই প্রথম নিজের পরিবারের কেউ এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করলো। ভালই লাগছিলো। আপা বললো যে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলো সে পুরো টাকা নিয়ে ভেগেছে। আবার নতুন ট্যাক্সি নিতে হবে। ৬৫০ রুপিতে নতুন ট্যাক্সি নেয়া হলো। গন্তব্য ১৮ কিলোমিটার দুরে। মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন গেষ্ট হাউস, স্পার্টান নগর, মোগাপ্পেয়ার। ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখতে মাদ্রাজিদের মতো, বেশ কালো। আলাপ করে জানলাম বাড়ি বিহার। দুনিয়ার শয়তান টাইপ। ট্যাক্সিতে এসি নাই বলে উঠিয়েছিলো। কিন্তু কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম এসি আছে। জিজ্ঞাসা করলাম এসি নাই কেন বললো? উত্তরে বললো দোসো রুপিয়া যায়দা দেনা পরেদা। আমরা বললাম তুমি আগে বলবাতো যে এসি আছে টাকা বেশি দিতে হবে। এই গরমে কেউ এসি ছাড়া চলতে পারে? তারপরও বদমাসটা এসি ছাড়লোনা। কিছু বললাম না। বিদেশে যতটা বিনয়ী থাকা যায় ততই ভালো। ৪০-৪৫ মিনিটে গন্তব্যে পৌছে গেলাম। আপা যে গেষ্ট হাউসে থাকতেন সেখানেই আমার জন্য একটা রুম রিজার্ভ করে রেখে ছিলেন। সন্ধা ৭টায় এয়ারপোর্ট থেকে রওয়া দিয়েছিলাম। রুমে আসতে ৮ বেজে গেলো। রুমে উঠে ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র বের করে গোছল করে নিলাম। আপার রুমে চা বানানোর জিনিস পত্র ছিলো। চা বানিয়ে খেলাম। রাতে মাদ্রাজ মেডিকেল মিশনের ডাক্তার রবি আগরওয়ালের বাসায় ডিনারের দাওয়াত। রাত ১০টার মধ্যে তিনজন রেডি হয়ে রওনা দিলাম ডাঃ রবির বাসায়। ৫০০গজ দুরেই বাসা। হেটে গেলে ৫ মিনিট। হেটেই গেলাম। পুরোনো একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ৮-১০টা ৫তালা বিল্ডিংয়ের একটায় উনার বাসা। ডাঃ রবি চেন্নাইয়ের নামকরা হার্ট সার্জন। এতো বড় ডাক্তারদের বাংলাদেশে অনেক রাজকীয় অবস্থায় দেখা যায়। টাকা পয়সার দিক থেকে অনেক সচ্ছল হলেও ডাঃ রবির বাসা দেখলাম খুব সাধারন। ২ রুম আর ড্রয়িং ডাইনিংয়ের ছ্ট্টো বাসায় দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ডাঃ রবি বাসায় ছিলোন না। উনার স্ত্রী আর পাসের বাসার বাংগালী প্রতিবেশি অ¤্রতিা আর অতুনু তাদের মেয়ে জুনকে নিয়ে আমাদের সাদর সম্ভাসন জানালো। সেদিন আবার এশিয়া কাপ ক্রিকেটের বাংলাদেশ ভারত ফাইনাল হচ্ছিলো। টিভিতে খেলা দেখাচ্ছিলো। আমি আর অতুনু খেলা দেখছিলাম। অতুনু মনে মনে খুব উত্তেজিত ছিলো। খেলার এক পর্যায়ে ভারতের অবস্থা খারাপ দেখে অতুনু ডাঃ রবির বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে যায়। পরে অবশ্য ভারত জিতে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেলে হাসি মুখে আবার ফেরত আসে। আবিদা আপার ট্রেনিংয়ের পুরো ২ মাস ডাঃ রবির পরিবার অনেক সহযোগীতা করেছিলো। উনাদের সবাইকে খুব আন্তরিক মনে হয়েছিলো। সবাই মিলে আড্ডা হলো, গ্রুপ ছবি তোলা হলো। হায়দ্রাবাদি বিরানী, মাছ ভাত আর নুডুলস্ দিয়ে রাতে জম্পেস খাওয়া দিয়ে আমার মাদ্রাজি ভ্রমণ শুরু হলো। রাতে অ¤্রতিা আর রবি ভাবি আমাদের গেষ্ট হাউসে পৌছে দিতে চাচ্ছিলো কিন্তু আমার হাসি পাচ্ছিলো ৪০০-৫০০ গজ দুরে গাড়ি করে যাওয়ার কথা শুনে।

ডাঃ রাভীর বাসায় ফটোসেশন

সকালে গেষ্ট হাউসের গার্ডকে দিয়ে নাস্তা আনিয়ে খেয়ে নিলাম। বলে নেয়া ভালো মেডিকেল মিশনের গেষ্ট হাউসটি ছিলো হাসপাতালের পিছনের একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায়। আমাদের উত্তরা মানের আবাসিক এলাকা। ৫ কাঠা প্লটের উপর দোতালা তিনতালা বাড়ি। মজার ব্যাপার কোন বাড়িতেই গ্যারাজ দেখলাম না। কিন্তু গাড়ি আছে সব বাড়িতেই। গাড়ি গুলো রাখা রাস্তায়। প্রশস্ত রাস্তা তাই অসুবিধা হচ্ছেনা। এতো গাড়ি কিন্তু গাড়ির কান চুরি নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নাই। মনে মনে কষ্টই লাগলো ঢাকায় গাড়ি চালানোর চেয়ে গাড়ি দেখে রাখার জন্য ড্রাইভার রাখি আমরা। ভারতে সামগ্রীক অপরাধ বাংলাদেশের চেয়ে বেশিই হবে হয়তো, কিন্তু গাড়ির কানের আয়না বা টুকটাক যন্ত্রাংশ চুরি কম হয়।

মহাবলীপুরম রওয়ানা দেয়ার আগে সকালে মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন হাসপাতালে গেলাম আমরা। ডাঃ রবির সেক্রেটারী প্রিয়া আর জয়েসের সাথে দেখা করলাম । আমি আগে থেকেই অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলাম মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন হাসপাতালের ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কিভাবে করে, সেটা দেখবো বলে। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ দেখলাম ব্যবস্থা করে রেখেছে । প্রিয়া সাথে করে হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখালো আমাকে আর জয়েস আপার সাথে বসে মহাবলীপুরমে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করলো ফোন দিয়ে। চেন্নাই থেকে ৭০ কিলোমিটার দুরের পথ মহাবলীপুরম। মহাবলীপুরম সাইট থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে আমাদের জন্য রিসোর্ট বুকিং দেয়া হলো। রিসোর্টের নামটা খুবই কঠিন। উচ্চারন করতে দাঁত নড়ে যাবার অবস্থা। স্ক্রিপচার রিক্রিয়েশনাল ক্লাব। ট্যাক্সি ভাড়া পড়লো ১৫০০ রুপি। দেড় থেকে ২ ঘন্টার পথ।

মাদ্রাজ মেডিকেল মিশন হসপিটালের পাশেই একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট আছে, হোটেল আল শারজাহ্ । ওখান থেকে দুপরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম মহাবলীপুরমের দিকে। ট্যাক্সি কোম্পানীকে আগে থেকেই বলা ছিলো হিন্দি ভাষী ড্রাইভার দেয়ার জন্য্। ওরা দেখলাম কথা রেখেছে। ড্রাইভার চমৎকার ই্ংরেজী ও হিন্দি বলে। বাড়ি কর্ণাটক রাজ্যে। এতো সুন্দর ইংরেজী আর হিন্দি কথা কিভাবে শিখেছি জিজ্ঞেস করাতে বললো, মুম্বাইতে ১০ বছর ট্যাক্সি চালিয়েছে। মনে মনে বল্লাম ভালোই হলো ৭০ কিলোমিটার কিঞ্চিৎ কথা বার্তা বলা যাবে। ট্যাক্সি ড্রাইভার যাওয়ার পথে অনেক কিছুই দেখাতে দেখাতে আমাদের নিয়ে চললো মহাবলীপুরমের দিকে। চেন্নাইয়ে নতুন মেট্রোরেল বসিয়েছে। পুরোটা এখনও চালু করতে পারিনি। বড় রাস্তাগুলোর মাথার উপর মেট্রোরেলের লাইন সমেত ফ্লাইওভার টাইপ ব্রিজ চলে গেছে এদিক ওদিক। আরও দেখলাম লোকাল বাসের টার্মিনাল। ড্রাইভার জিজ্ঞেসা করলো আমরা পন্ডিচেরী চিনি কিনা? আমি বল্লাম চিনিনা তবে জায়গাটা সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া আছে। এক সময় ফরাসী কলোনী ছিলো। ওখানকার ঘরবাড়ি আর সাংস্কৃতিক ভাবধারা পুরোপুরি ফরাসী ধাঁচের। ভারতের মাঝে ছোট্ট একটু ফরাসী জায়গা। সত্যিই ইন্টারেস্টিং। চেন্নাই শহর আয়তনে বেশ বড়। বিস্তৃত। শহরের বাহিরে বেশকিছু শহরতলী গড়ে উঠেছে। ড্রাইভারের কাছে খুব আগ্রহ নিয়ে জায়গা গুলোর নাম জিজ্ঞেস করতে করতে মহাবলীপুরমের দিকে এগোতে লাগলাম আমরা। ড্রাইভারের কাছে আরও শুনলাম গতবছরে হয়ে যাওয়া চেন্নাইয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যার গল্প। পুরো শহরটি পিরিচের মতো পানিতে ভরে গিয়েছিলো। যাওয়ার পথে অনেক রাস্তাই দেখলাম নতুন । ড্রাইভার বললো এই সব রাস্তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। পুরো নতুন করে আবার করবে সরকার। রাস্তার পাসের কিছু বাসার গায়ে পানির দাগ এখনও আছে। প্রায় দোতালা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলো কিছু যায়গার ঘরবাড়ি। আরও কিছু দুর গিয়ে পরলো ছোট একটা দু’টা পাহাড়। খুব আধুনিক আর সাইফাই টাইপ ঘরবাড়ি দেখলাম বেশকিছু। ড্রাইভার বললো বেশিরভাগই আইটি বা কম্পিউটার সম্পর্কিত কোম্পানী অফিস। আমাদের ঢাকার শহরতলী গুলো যেমন গার্মেন্টস্ দিয়ে ভরা ঠিক তেমনই ভারতে শহরতলী ভরা আইটি কোম্পানী দিয়ে।
আমরা মনে মনে সংকিত ছিলাম সময়ের হিসাব নিয়ে। রাস্তায় দেরী হয়ে গেলে মহাবলীপুরমের পুরো ট্যুরটিই মাটি হয়ে যাবে। বিকেলের আগেই রিসোর্টে না পৌছাতে না পারলে কিছুই দেখা হবে না। তার পরের দিন সকালেই ফিরতে হবে চেন্নাই। আর আমার মাথায় আছে সুর্যাস্তের সময় আমি মহাবলীপুরমের সি শোর টেম্পল বা সমুদ্র তীরের মন্দিরের ছবি তুলবো। হাজার বছর আগের পাথরে নির্মিত রহস্যময় গুহা আর স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখবো। যদিও আমি মহাবলীপুরম আগেও দেখেছি, কিন্তু আগেরবার খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছিলাম। রাতে থাকা হয়নি। তাই মনে মনে এবার বেশ প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম জায়গাটা ভালো ভাবে দেখার জন্য।


মহাবলীপুরমে আপা দুলাভাই

আমরা আমাদের রিসোর্টে পৌছালাম ৩.৩০ মিনিটে। স্ক্রিপচার রিক্রিয়েশনাল ক্লাব। মিশনারীদের তৈরী রিসোর্ট। থাকা খাওয়ার টাকা একসাথে দিতে হলো। দোতালা বিল্ডিংয়ের একরুমে চারটা বেড। ফ্যামিলি রুম। রিসোর্টে চেকইন করেই মহাবলীপুরমের দিকে রওনা দিলাম। রিসোর্ট থেকে ৩ কিলোমিটার রাস্তা। গাড়িতে ৫ মিনিটের রাস্তা। ট্যাক্সি থামলো মহাবলীপুরম কমপ্লেক্সের ঢোকা মুখে। কোথায় কি আছে না জেনেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। বলে নেয়া ভালো মহাবলীপুরম কাঞ্চিপুরম জেলাতে অবস্থিত। কাঞ্চিপুরমের মন্দিরের শহর। ঐতিহাসিক ভাবে আকর্ষনীয় জায়গা। আমরা যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম সেখান থেকে মাথা ঘুরিয়ে গেলো। বিশাল বিশাল পাথর কেটে কুঁদে তৈরী করা হয়েছে মন্দির আর শত শত ভাস্কর্য। পুরো এলাকাটা বড় বড় পাথরের স্তুপ আর পাথরের ফাঁকে মন্দির, আর দুরে পাহাড়ের মতো পাথুরে অবয়বের উপর পাথরের তৈরী লাইট হাউস দেখা যাচ্ছিলো। প্রচন্ড গরম। সেই গরমের ভিতর প্রচুর সাদা বিদেশীকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ঘুরতে দেখলাম। বিভিন্ন দল টুরিষ্ট গাইডের কথা শুনতে শুনতে পুরাকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরতে দেখলাম। আমাদের পিছনে টুরিষ্ট গাইডরা দুই একজন ঘুরতে লাগলো। আমরা বয়স্ক একজন টুরিষ্ট গাইড নিয়ে নিলাম ৩০০ রুপিতে পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখাবে বলে। টুরিষ্ট গাইড ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে একটা গুহা তে ঢুকে তার কাজ শুরু করলো। হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় টুরিষ্ট গাইডরা হচ্ছে সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রাণী। ক্যাসেট রেকর্ডারের মতো ইতিহাস বলা শুরু করেছে, ইংরেজি শুনে মনে হচ্ছিলো রজনীকান্ত্ কথা বলছে। মাদ্রাজী টোনে ইংরেজি বোঝা কষ্ট, তার ভিতরে কঠিন ইতিহাস। অল্প বিস্তর যা বুঝলাম। পল্লব ডাইনেস্টির সময় ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে মহাবলীপুরম ছিলো সমৃদ্ধ বন্দর। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আরব দেশ সমুহ, মিশর আর গ্রীস রোমান দেশ সবার সাথেই ছিলো তাদের বানিজ্য।


গাইডের কথা শুনে লাভ নেই, আমার ক্যামেরা কথা বলবে বেশি। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। মাথায় প্রশ্ন ঘুরছিলো। কিভাবে সম্ভব? পুরো এলাকটা একটি পাথরের উপর বসে আছে। আমি বলছি পাথরের স্তুপ। পাথর মানে এক একটি পাহাড়ের আকৃতি। লক্ষ টন ওজনের পাথর। পাথর কুঁদে কুঁদে মন্দির আর গুহা তৈরী করা হয়েছে। গুহার মধ্যে দেব দেবী, মানুষ আর পশুপাখির মূর্তি। আলগা মূর্তি এনে বসানো হয়নি। পাথর কেটে কেটে একটি স্ট্রাকচার থেকেই বের করা হয়েছে সব কিছু। একটি ছেনির আঘাতও এদিক ওদিক হয়নি। নিখুঁত কাজ। কি পরিমান কষ্ট করলে এমন জিনিস বানানো যায়, এই প্রশ্ন প্রতিটি পর্যটকের মাথাই আসবে। আমরা যেখান থেকে শুরু করলাম । সেখানে প্রায় ৫০০ ফুট লম্বা আর আর ৬০ ফুট উচু পাথরের দেয়াল। দেয়াল কেঁটে দুটি গুহাকৃতি মন্দির আর দেয়াল জুড়ে ভাস্কর্জ শিল্প। এছাড়াও পাথরের ফাঁকে ফাঁজে শত বর্ষপুরোনো গাছ । গাছ গুলো বড় অদ্ভূত। পাথরে ফাঁকে ফাঁকে ধুলো ময়লা জমে মাটি হয়েছে, আর সেখানে হয়েছে গাছ। তাই গাছের শিকড় বাকল ছড়ানোর জায়গা অপ্রতুল। তাই গাছ গুলো বামনাকৃতির আর বাঁকানো পেঁচানো। দুরে একটা মাঠের মত জায়গা তারপরে পাথরে উচু ঢালের মতো। পাথরে ঢালের উপর মহাবলীপুরমের সবচেয়ে অদ্ভূত বস্তুু। কয়েক শত টন ওজনের একটি গোল পাথর। দেখে মনে হবে এখুনি পাথরটা গড়িয়ে আসবে আপনার দিকে। খুব ঢালু একটা জায়গায় কোনমতে দাড়িয়ে আছে। পুরানো কাহিনিতে বলে কৃঞ্চর মাখনের দলা। গাইড বলে চললো যে ভূমিকম্প বা সাইক্লোনে এই পাথরকে একচুলও নরাতে পারেনি। রাজা মহা রাজারা শত শত হাতি ঘোড়া দিয়ে টেনে সরানোর চেষ্টা করেছে অনেক সময়। পাথর মশাই গ্যাট হয়ে বসে আছে নড়ার ইচ্ছা নাই। প্রচুর মিথ ছড়িয়েছে পাথরটি নিয়ে।
একে একে ১২টি স্থাপনা দেখিয়ে গাইড বাবাজি ৩০০ রুপি বুঝে নিয়ে বিদায় নিলো। আমরাও পাথরের ঢিবির উপর রোমান আকৃতির বিল্ডিংয়ের কাছে বিশ্রামে বসলাম। দুর থেকে দেখা যাচ্ছিলো ব্রিটিশ আমলের তৈরী একটি লাইট হাউস বা বাতিঘর। বেশ কিছুটা দুরে। আপা দুলা ভাইকে অপেক্ষা করতে বলে ক্যামেরা নিয়ে পাথর পাহার ডিংগিয়ে টিকেট কেটে লাইট হাউসে উঠে পুরো এলাকার ছবি তুলে আনলাম। মহাবলী পুরমের দ্রষ্টব্য বিষয়ের মধ্যে আরও আছে পঞ্চ পান্ডবের রথ আর সি শোর টেম্পল। লাইট হাউসে দেখে ফিরে আমরা রওনা দিলাম সমুদ্র পারের দিকে। সি শোর টেম্পল বা সমুদ্র পাড়ের মন্দির ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষনাকৃত। বিকাল সাড়ে ৫ টায় মন্দির দেখে সমুদ্র সৈকতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পাশের এক দোকান থেকে চা নাস্তা কওে রওনা দিলাম রিসোর্টের দিকে। মহাবলীপুরমের মাদ্রাজি নাম মালাল্লাপুরম। বিস্তারিত জানতে গুগলের সাহায্য নিতে পারেন। আর আমার ছবিগুলোর সাহায্য করবে এলাকা সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দিতে।



বিশাল পাথরের বুকে ছেনি দিয়ে তৈরী ভাস্কর্য


এই সেই রহস্যময় পাথর


এমন মন্দির আছে অনেক গুলো


বৃটিশ আমলে তৈরী বাতিঘর থেকে তোলা মহাবলীপুরম



সি শোর টেম্পল বা সৈকত মন্দির


এই সেই বাতিঘর


মহাবলীপুরমের সমুদ্র সৈকতে
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:১৩
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×