somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের টেকনাফ ভ্রমণ, একের মধ্যে অনেক কিছু দেখা

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলাদেশের লুকানো স্বর্গ টেকনাফ। অদ্ভুত সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে এসেছি সেখান থেকে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠার সব বৈশিষ্ঠ এখানে বিদ্যমান

প্রথম পর্ব


আমি টেকনাফে প্রথম যাই ১৯৯৬ সালে। সে বছর এক স্কুল বন্ধু ইংল্যান্ড থেকে বেড়াতে এসেছিলো বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে সেইন্টমার্টিন যাওয়ার প্ল্যান নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম আমরা। কক্সবাজার থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম সেইন্ট মার্টিন যাওয়া যাবেনা। সেইন্ট মার্টিন না যেতে পারলেও কাছাকাছি টেকনাফ ঘুরে দুধের সাধ ঘোলে মিটাতে গিয়েছিলাম। কিন্ত দেখা গেলো দুধের চেয়ে ঘোল ভালো লেগে গেলো । টেকনাফের প্রেমে পড়ে গেলাম ! নাফ নদীর পাশ দিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা রাস্তার একপাশে নেটং পাহাড়ের ভঙ্গিল সারি আর পাহাড়ের পা ভিজিয়ে বঙ্গপসাগরের দিকে বয়ে চলা নাফ নদী। সাথে সাথে নাফ নদীর ওপাশে দৃশ্যমান সু-উচ্চ নীল নীল বার্মিজ পাহাড়, নির্জন সমুদ্র সৈকত আর চারিদিকের বন জঙ্গল দেখে আমি মুগ্ধ। তাচ্ছিল্যে বেড়াতে এসে টেকনাফের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমার মনকে এতই মুগ্ধ করে ফেলেছিলো যে গত ২০-২১ বছর বলেই গেছি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পর্যটন অঞ্চল হওয়া উচিৎ টেকনাফের। এখানে পাহাড়, নদী, জঙ্গল, সমুদ্র, ঝর্না সহ প্রায় সবকিছুই আছে পর্যটকদের আনন্দ দেয়ার জন্য। টেকনাফের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা সম্ভবত টেকনাফ জাহাজ ঘাট (দমদমিয়া ঘাট) থেকে টেকনাফ শহরে যাওয়ার রাস্তায় পাহাড়ের একটা খাড়াই আছে, সেই জায়গাটি। আমার ধারনা এখান থেকে নাফ নদীর দৃশ্য বাংলাদেশের সুন্দরতম দৃশ্যের মধ্যে অন্যতম। নাফ নদীর মধ্যে জালিয়ার দ্বীপ নামে একটি গোলাকৃতি দ্বীপ আছে সেটা এই জায়গা থেকে খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়, সাথে নদীর বাঁক ও পাহাড়ের সাড়ি। সত্যই অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য।



এবার আসি আমাদের এবারের টেকনাফ ট্যুরের কথায়। আমরা কয়েক বন্ধু বেশ কয়েক বছর একত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রমন সঙ্গীর সংখ্যা ৬-৭ জন হলেও এবারের টিমটি বেশ বড় হয়েছিলো। ১২ জনের বিশাল দল। সাথে বন্ধু রোকনের দুই বাচ্চা। মহিলা বলতে রোকনের স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের বন্ধু তানি। গত একমাস ধরে ফেসবুকে গ্রুপ বানিয়ে পোস্ট দেয়া নেয়া চলছিলো। এতো জায়গা থাকতে টেকনাফে বেড়াতে যাচ্ছি কেন? ট্যুরের আগে আমাদের কাছে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছে। আরও অনেকে হয়তো ইচ্ছা থাকার পরও যায়নি ভেন্যু টেকনাফ বলে। কারন সবার মধ্যেই একটা কনফিউশন ছিলো এতো দুরে যেয়ে খুব ইন্টারেস্টিং কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। তার মধ্যে আমাদের ট্যুর হচ্ছে যাকে বলে চিৎ-কাইত টাইপ ট্যুর। বউ বাচ্চা নিয়ে এমন ট্যুর করা যাবেনা বলে অনেকেই আসার ইচ্ছা থাকলেও ট্যুরে অংশগ্রহন করেনি। অবশ্য ট্যুর শেষে হিসাব করে দেখেছিলাম যে পুরো ট্যুরে চিৎ-কাইত হবার সুযোগ আমরা খুব কমই পেয়েছি। রাতের অল্পসময় বাদ দিলে পুরো সময়টাই রাস্তায় কাটিয়েছি। একদম নিখুত ট্যুর বলতে যা বোঝায়, আমাদের ট্যুরটি অলমোস্ট সেরকম একটা ট্যুর ছিলো।

আমরা ৮ জন বাসে করে টেকনাফে সরাসরি রওনা দিলাম ৩০ মার্চ রাত ৮.৩০শে। আর বাকি ৪ জন অর্থাৎ রোকনরা আগের রাতেই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার চলে গিয়েছিলো। আমাদের বাসের নাম সেইন্টমার্টিন পরিবহন । রাত সাড়ে আটটার যথাসময়ে বাস ছাড়লো টেকনাফের উদ্দেশ্যে। আমরা ৮ জন বাম দিকের ৪টা সিট নিয়ে আরাম করে বসে হইচই যতটা কম করা যায় সেই চেষ্টা করতে লাগলাম। বাসে উঠার আগেই একটা গ্রুপ সেলফি তোলা হয়ে গেলো আমানের আর আমার মোবাইল ফোনে। বাসের সিটে বসেও দুজন দুজন করে ছবি তুলে নেয়া হলো চুপেচাপে। ফেসবুকে এসব ছবি আপলোড দিয়েই শুরু হলো আমাদের ফটোগ্রাফিক টেকনাফ ট্যুর। অন্য সব ট্যুরের মতোই বাই ডিফল্ট ট্যুর ম্যানেজার শাকিল। আল্লাহ প্রাকৃতিক ভাবেই ওকে যেন ট্যুর ম্যানেজার করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। বছরের পর বছর, ট্যুরের পর ট্যুর ম্যানেজারি করতে শাকিলের কোন ক্লান্তি নেই, বরং ওর অফিসের সহকর্মীদের সাথে মালোয়েশিয়ায় এক ট্যুরে ওকে ম্যানেজারি করতে দেয়া হয়নি না বলেই ওর স্মৃতিতে সেই ট্যুরটি দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে আছে। যাক সে কথা। বাস ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেলো। আমাদের কথা ছিলো কুমিল্লায় বাস থামার পরে রাতের খাবার খাবো। বাসা থেকে সন্ধার সময় রওনা দেয়াতে ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি কারই । বাসে উঠার সময়ও বিস্কুট চিপস্ কিচ্ছু কেনা হয়নি। ফলে বাস যখন কাঁচপুর ব্রিজের আগে কোন এক মোড়ে দাড়িয়ে ছিলো, তখন ক্ষিদায় আমাদের অবস্থা কাহিল। এদিকে আমাদের সুপার ম্যানেজার শাকিল কাজে লেগে গেলো। সিট থেকে উঠে বাসের ড্রাইভারের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ ফিসফাস করে কি যেন বললো। ড্রাইভারের উত্তর শুনে হতাস হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে সিটে এসে বসার পর হঠাৎ জানালা দিয়ে কি একটা দেখে আবার সিট ছেড়ে বাসের ড্রাইভারকে বলে বাস থামিয়ে নিচে নেমে গেলো। ৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের হাতে প্লেইন কেকের বড় বড় পিস চলে আসলো। দুইখান কেক খাওয়া শেষ না করতে করতেই সবার হাতেই সিদ্ধ ডিম দিয়ে দিলো একটা করে। আমাদের নেত্রকোনায় প্রায় জল আসার উপক্রম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বাসের ফ্লুরোসেন্ট এলইডি বাতির কারনে সবাই ডিমের খোসা ছাড়ানোর পর হইচই করতে লাগলাম। নীলচে সিদ্ধডিম জীবনে খাইছি বলে মনে পড়েনা, ডিম অর্ধেক করার পর দেখা গেলো ডিমের কুসুমের মধ্যে গাছের গুড়ির মতো সার্কেল সার্কেল দাগ। আরে আমার ডিম পচা বলে হইচল করতে না করতেই মোবাইলের টর্চ দিয়ে ডিমের ভালো চেহারা দেখিয়ে দিলো শাকিল। আমরাও বিট লবন দিয়ে ডিম খেয়ে একঘুমে কুমিল্লা।

কুমিল্লায় ও লোহাগড়ায় যাত্রা বিরতী দিয়ে সকাল ৮.৩০ টায় আমরা টেকনাফ জাহাজ ঘাটে পৌছে গেলাম। যেহেতু আমরা সেইন্ট মার্টিন যাবোনা, তাই পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল নেটংয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বাস থেকে নামলাম। হোটেল নেটংয়ের লোকেশনটা খুব সুন্দর। আসলে টেকনাফের মুল সৌন্দর্যটাই নাফ নদী আর নদী এপাড় ওপারের পাহাড়। নেটং হোটেলের মাথিন রেস্টুরেন্টে ব্যাগ রেখে ক্যামেরা বের করে সামনের রাস্তায় যেয়ে ছবি তোলা হলো। হোটেলে ছাদে গিয়েও ছবি তুললাম বেশ কিছু। হোটেলের সামনে রাস্তা, রাস্তার পরেই নাফ নদী। জোয়ারের পানিতে টইটুম্বর। নদী ওপারে বার্মিজ পাহাড়। সকাল বেলা নদী থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে আসছিলো। নাফ নদীর দৃশ্য আর ঠান্ডা বাতাসে সারা রাতের ক্লান্তি ধুয়ে আমাদের মনে তখন শান্তি শান্তি ভাব চলে এসেছে।



আমি আগে ৩ বার সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে গেছি। যতবার গেছি, ততবার এই নেটং হোটেলের মাথিন রেস্টুরেন্টে নাস্তা করেছি। ফলে আগের দেখা জমজমাট নেটংকে ফাঁকা আর মলিন লাগছিলো। মনটাও একটু খারাপ হচ্ছিলো স্মৃতিগুলো মনে পরে যাওয়ায়। বন্ধু রোকন আর তানি দুই মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে সকাল সকাল চলে আসার কথা। নাস্তা খেতে খেতে আর আড্ডা মারতে মারতে রোকনদের জন্য অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। যেহেতু টেকনাফ ট্যুরের আয়োজক রোকন, আর থাকার ব্যাবস্থাও রোকন করেছে তাই রোকনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সময়েরও সংকট। মাত্র দুই দিনের ট্যুরে দেখতে হবে অনেক কিছু। টেকনাফে যে দেখার জায়গার অভাব নাই। নেটং হোটেলে অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর যখন রোকনরা এসে পৌছাতে পারলোনা, তখন আমরা আমাদের গন্তব্যের দিকে হেটে রওনা হয়ে গেলাম। টেকনাফ জাহাজ ঘাট আর বন্দরের পাসে দিয়ে যে রাস্তাটা টেকনাফ শহরের দিকে গেছে সেই রাস্তা দিয়ে দেড় দুই কিলোমিটার সামনে এগোলেই নাকি আমাদের থাকার জায়গা দুটো আলাদা রেস্ট হাউস রাস্তার এপার আর ওপার। রোকন আর তানি ফ্যামিলি নিয়ে থাকবে রোডস এন্ড হাইওয়ের রেস্ট হাউসে আর আমরা ফরেস্ট বা বন বিভাগের রেস্ট হাউসে।



রোকনদের মাইক্রোবাসের আশা ত্যাগ করে নাফ নদীর ঠান্ডা বাতাস মেখে আর সকালের নরম রোদের সাথে খুনসুটি করতে করতে হাটা শুরু করে দিলাম আমরা। ৮ জনের বিরাট দল।



রাজশাহী থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে রোকনের সাতে যোগ দিয়েছিলো তুহিন মামা আর রাসেল ভাই। আর আমরা বাকি সবাই জাহাঙ্গীরনগরের ২২ ব্যাচের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টর বন্ধু। তার মধ্যে ৪ জন আবার ডিএসএলআর ওয়ালা ফটোগ্রাফার। রাস্তার এক দিকে নাফ নদী, আরেক দিকে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। পাহাড়ের নাম নেটং পাহাড়। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ। রাস্তাটা পাহাড়ের গায়ে বাঁক খেয়ে উপরের দিকে চলে গেছে। ব্যাগপ্যাক কাঁধে আর হাতে ক্যামেরা নিয়ে অপূর্ব নাফ নদীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে সারারাত জেগে থাকার কষ্ট যেন ফরুত করে চলে গেলো। আমাদের উৎসাহ তখন দেখে কে? আমি, আমান, তৌফিক বস আর মিলু ক্যামেরা বের করে ছবি তোলা শুরু করলাম। ডলার হাসতে হাসতে বলছিলো দেখিস মায়ানমার থেকে দুরবিন দিয়ে তাকিয়ে ওরা যেন না ভাবে যে আমরা ওদের দিকে বন্দুক তাক করে আছি। যা শুরু করছিস তোরা। আমাদের তখন এসব আজগুবি কথায় মন নাই। টেকনাফের পুরোনো ভক্ত তো আমি ছিলামই, চারিদিকের প্রাকৃতিক রূপের বহর দেখে সবাই হইহই করতে লাগলো, টেকনাফ এত্তো জোস, আমরা অযথাই কক্সবাজারে সময় নষ্ট করি।




পথে লোকজনের কাছে রেস্টহাউসের অবস্থান আর দুরত্ব জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছিলাম। তবে আমার বহুদিনের অভিজ্ঞতায় জানি বাংলাদেশের সাধারন জনগনের রাস্তার দুরত্ব সম্পর্কিত জ্ঞ্যান জঘন্য। দুই কিলোমিটার বললে পাঁচ কিলো ধরে নিতে হবে। আমাদের গন্তব্য আসতে দেরী হচ্ছিলো কিন্তু হাটতে ভালোই লাগছিলো। রাস্তাটা এক সময় বেশ উপরে উঠে আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করে। রাস্তাটার সবচেয়ে উঁচু স্থানটাতেই টেকনাফ পৌরসভার শুরু। ওখানে স্বাগতম টেকনাফ পৌরসভা লেখা তোরন ছিলো বোধহয়। আর পর্যটকদের জন্য একটা ভিউ পয়েন্ট মতন করা আছে পাহাড়ের ঢালের সাথে রেলিং দিয়ে। ঐ জায়গায় দাড়িয়ে অদ্ভূত একটা আইকনিক দৃশ্য দেখা যায়। যেটা আমি এই লেখার শুরুর দিকেই উল্লেখ করেছিলাম। কক্সবাজারের রাস্তার দিক বরাবর নদীতে গোল একটা দ্বীপ দেখা যায় নাফ নদীর মধ্যে। দুরে মায়ানমারের উচু উচু পাহাড়, নাফ নদী, নাফ নদীতে নৌকা, সেইন্ট মার্টিনের জাহাজ, জোয়ার ভাটায় টইটুম্বর নদী, নদীর পাড় ধরে সবুজ গাছের আচ্ছাদন আর পাহাড়। আহা, বড্ড সুন্দরের ছড়াছড়ি। আমরা সবাই ক্যামেরা বাগিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। ক্যামেরার মুখ নাফ নদী তথা মায়ানমারের দিকে। যেন এক সাথে শব্দহিন গোলাগুলি শুরু করে দিলাম। চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি মন ভরে তোলার পর সবাই গ্রুপ ছবিও তুললাম অনেক। দুই চারটা প্রোফাইল পিকচারও তুললাম প্রত্যেকে।





সবশেষে আবার রেস্ট হাউসের দিকে রওনা দেবার পালা। এবার পাহাড়ের গা বেয়ে নিচের দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। আমাদের ৮ জনের মধ্যে ৭ জন পিঠে বহন করা যায় এমন ব্যাগ বা ব্যাগপ্যাক নিয়ে এসেছিলাম। শুধু ডলার নিয়ে এসেছিলো ট্রলি ব্যাগ। ট্রলি ব্যাগ টেনে টেনে রাস্তা ধরে উপরে উঠতে কিঞ্চিৎ কষ্ট হলেও খুব অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ঢালু রাস্তা দিয়ে নামার সময় ডলারের একটু অসুবিধাই হতে লাগলো। আমরা হাসাহাসি করলাম, আসছিস চিৎকাইত জংলা ট্যুরে, ভাব নিতে গেছিস ফরেন ট্যুরের। পাহাড় থেকে নিচে নামার দৃশ্যটা বড় সুন্দর ছিলো। যেন একদল অভিযাত্রী পিঠে ব্যাগ বেধে নেমে আসছে সমতলে। শুধু মাঝখান থেকে একটা ট্রলিওয়ালা ভুলক্রমে কিভাবে যেন ঢুকে গেছে।



হইচই করে হাটতে হাটতে একটা সময় আমাদের কাংখিত রোডস্ এন্ড হাইওয়ে রেস্ট হাউস এবং বন বিভাগের রেস্ট হাউসকে পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। রোডস্ এন্ড হাইওয়ের রেস্ট হাউস রাস্তার পূর্ব দিকে নাফ নদীর সাথে আর বন বিভাগের রেস্ট হাউসটি রাস্তার পশ্চিম দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের দিকে পরে। আমরা বন বিভাগের রেস্ট হাউসের বিপরীত দিকে রাস্তা থেকে নেমে নদীর পারে হাটা হাটি করতে লাগলাম। এখানে নদী থেকে একটা খাড়ি ভিতর দিকে প্রায় রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। তখন ভরা জোয়ার। অর্ধচন্ত্রাকৃতি অনেক নৌকা যেন পোজ দিয়ে ছিলো নাফ নদী পটভূমিকায় সুন্দর সব ছবি তোলার জন্য। জোয়ারে ভরা নদী। পরিস্কার পানির ঢেউগুলো পাথুরে পাড়ে এসে ছপাত ছপাত শব্দে আমাদের কানে যেন মধু বর্ষিত করছিলো। আমরা আবার ছবি তোলায় মত্ত হয়ে পড়লাম।





নদী আর নৌকার অপূর্ব দৃশ্য

ব্যাগ নামিয়ে কেউ কেউ নদীতে পা ভিজাতেও লাগলো। আমাদের মধ্যে ডলারকে দেখা গেলো পাগলের মতো পানিতে পা ভিজাচ্ছে। এর মধ্যে সে পারলে পানিতে প্রায় নেমে যায় প্রায়। আমরা ওকে বুঝালাম, বাপ আমরা কেবল এসে পৌছালাম। পরে নদীতে গোছল করার প্রচুর সময় পাবো। আমাদের থাকার যায়গার পাশেই তো নদী, সমস্যা নাই।



কিছুক্ষণের মধ্যে তানি রোকন গ্রুপ পৌছে গেলো রেস্ট হাউসে। শুনলাম ওদের মাইক্রোবাস ড্রাইভার খুব ঝামেলা করতে করতে এসেছে। কক্সবাজার থেকে ঠিক করে নিয়ে এসেছিলো, যে গাড়িটা আমাদের সাথে সারাদিন টেকনাফে থাকবে। কিন্তু ড্রাইভার এখন আর থাকতে চাচ্ছে না। যাই হোক বেটাকে তক্ষুনী বিদায় করে দেয়া হলো। এরপর অনেকদিন পরে দেখা হওয়ার হাই হ্যালো হলো, হইচই আনন্দ হলো অনেক। নদীর পটভুমিকায় গ্রুপ ছবি তোলা হলো হই হুল্লুরে।





আমি, বস লিটন আর আমান সবার ছবি তুললাম বেশ কিছু। এরপর আমরা ১০ জন বন বিভাগের রেস্ট হাউসে ব্যাগ পোটলা নিয়ে যে যার মতো রুম আর বিছানা বুঝে নিলাম। এখানে একটা মজার ঘটনা হলো। আমাদের এক এক জনের ব্যাগের সাইজ এক এক রকম। কারো বড় বা কারো একটু ছোট, কিন্তু আজিজের ব্যাগ দেখে আমারা হাসবো না কাদবো বুঝতে পারছিলাম না। ছোট্ট একটা পোটলা টাইপের ব্যাগপ্যাক পিঠে নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরাঘুরি করছে। আমরা সবাই একমত হলাম যে এই ব্যাগে দুই তিনটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ৩টা আন্ডারওয়ারের বেশি কিছুর যায়গা হওয়ার কথা না। ব্যাগে কি আছে দেখানোর জন্য চাপাচাপিতে আজিজ ম্যাজিশিয়ানের মতো ব্যাগ থেকে ২ টা প্যান্ট আর ২টা গেঞ্জিসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই বের করে দেখালো, আমরাও ওর প্যান্ডোরার বক্স মার্কা পুচকে ব্যাগটাকে আমাদের ট্যুরের রহস্যময় সঙ্গী হিসাবে সালাম ঠুকলাম একটা করে। এরপর রোকনরা চলে গেলো রোডস্ এন্ড হাইওয়ের রেস্ট হাউসে। আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে ওদের রেস্ট হাউসে যেতে বললো আমাদের। আমরাও যে যার মতো ফ্রেস হয়ে জামাকাপড় পাল্টে বড় ব্যাগপ্যাক রেখে ক্যামেরা নিয়ে চলে এলাম রোডস্ এন্ড হাইওয়ের রেস্ট হাউসে। রেস্ট হাউসের পিছনে বেশ লম্বা একটা জেটি নাফ নদীর মধ্যে চলে গেছে। আমরা জেটির শেষ মাথায় গিয়ে মায়ানমারের পাহাড় আর নাফ নদীর নৌকার ছবি তুলতে লাগলাম। এর মধ্যে নিজেদের সিঙ্গেল ছবিও তোলা হলো অনেক। মিলু আমার আর আমাদের একটা অসাধারন ছবি তুলেছিলো ওখানে।



ধীরে ধীরে সবাই চলে আসার পর দেখলাম রোকন একটা চাঁদের গাড়ি (চান্দের গাড়ি) নিচে এসেছে। নরম সিটের মাইক্রোবাসের বদলে স্টেইনলেস ষ্টিলের সিট ওয়ালা চান্দের গাড়ি! গাড়িটা মোটামুটি হেরিটেজ পর্যায়ে চলে গেছে। ল্যান্ড ক্রুজার। নতুন করে সব ঠিক ঠাক করা হয়েছে। হই হই করে সবাই গাড়িতে উঠে পরলাম। এরপরের যাত্রা জালিয়ার দ্বীপ। পাহাড়ের উপর থেকে অনেকবার দেখা সেই গোলাকৃতির দ্বীপটিতে। আমরা গাড়ি নিয়ে আবার নেটং হোটেলের কাছে চলে আসলাম। ওখানে বুড়ির হোটেল নামে একটা ছাপড়া রেস্টুরেন্ট আছে। টেকনাফে কাজ করতে আসা এনজিও কর্মীরা নাকি এটাতে খাওয়া দাওয়া করে। আমরা ওখানে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে সরাসরি ঘাটে চলে গেলাম। সেখানে ইঞ্জিনের নৌকা দিয়ে চরম রোদের মধ্যে দিয়ে জালিয়ার দ্বীপে রওনা দিলাম।



বিশাল নৌকা, কিন্তু ছই টইয়ের বালাই নাই। কোনাতে ত্রিপল মাথায় দিয়ে আর এই কোনা ঐ কোনায় হাটাহাটি করতে করতে জালিয়ার দ্বীপে পৌছে গেলাম। জালিয়ার দ্বীপে স্থায়ী লোক বসতি নাই। মাছের ঘেরের পুকুর ভরা। আমরা দ্বীপের এক মাথায় নেমে সবাই মিলে মাঝ বরাবর হেটে দ্বীপের অন্য মাথায় চলে আসলাম। ওখানে নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। পুকুর, পুকুর পারে জ্বেলেদের অস্থায়ী আবাস, আর ছোট নারিকেল গাছে ভরা দ্বীপটি। এখান থেকে মায়ানমারের পাহাড় গুলো আরও ষ্পষ্ট। জালিয়ার দ্বীপে দেখার খুব কিছু নাই, তবে বেশ একটা এডভেঞ্চার টাইপ একটা ব্যাপার ছিলো এই দ্বীপ ভ্রমণে। দ্বীপ থেকে পাহাড় আর জাহাজ ঘাটের খুব সুন্দর কিছু ভিউও পাওয়া গেলো। এরপর আমরা নৌকায় করে জাহাজ ঘাট হয়ে নেটংয়ের পাশের বুড়ির হোটেলে নাফ নদীর মাছ দিয়ে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। লাঞ্চের পরে রেস্ট হাউসে গিয়ে রেস্ট। আবার বের হতে হবে বিকালের আগে আগে।






সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৩
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×