ঘটনা ১: "আপনাকে চিনবো কীভাবে?"
সেদিন ছিল রবিবার। ভার্সিটির প্রথম ক্লাস। সময় না জানায় ক্যাম্পাসের বাস ধরতে পারলাম না। ল্যাবে গিয়ে দেখি প্রায় সবাই চলে এসেছে। স্যার এলে পরিচয় পর্ব দিয়ে ক্লাস শুরু হল। এরপর সিআর(ক্লাস ক্যাপ্টেন) নির্বাচনের পালা। আমরা যেহেতু সবাইকে ঠিকমত চিনিনা, তাই ঠিক হল: আপাতত অস্থায়ী সিআর থাকবে, সপ্তাহ খানেক পর ভোটাভোটির মাধ্যমে স্থায়ী সিআর নির্বাচিত হবে। স্যার দু গ্রুপ থেকে দুজকে স্বেচ্ছায় নাম দিতে বললেন। কিছুটা সংকোচ আর খানিকটা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে স্যারকে বললাম, "স্যার, আমি সিআর হতে রাজি আছি"।
ল্যাব শেষ হল। পরের ক্লাস অন্য বিল্ডিংএ থাকায় সবাই সেদিকে যাচ্ছে। আমরা ক'জন আছি শেষের দিকে, নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে বলতে এগুচ্ছি। ডিপার্টমেন্টের কাছে আসতে পাশ থেকে একজন আমার রোল ধরে ডাকলো। আমি জানালাম এই রোলটা আমার, কী প্রয়োজন ?(ছেলেটা গড়নে ছোটখাট/আমাদের মতই। তাই ভেবেছিলাম আমাদের ব্যাচের কেউ হয়তো। আর সবে একটা ক্লাস করে বের হলাম, অন্য কেউ আমাকে চেনার/আমার রোল জানার কথা নয়)। হুট করে ওদের একজন একটু ভাব নিয়ে বলে ওঠে, "বড় ভাইকে সালাম দিতে হবে না?"। হুট করে এভাবে সালাম চাইতে দেখে/সালাম না দেয়ায় জবাবদিহিতে পড়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কথার খেই হারিয়ে বলে বসলাম, "আপনি যে বড় ভাই, সেটা চিনবো কীভাবে?"
[বলে রাখি, কথাটা বলার পর আমি বুঝতে পারেছিলাম, এভাবে বলাটা ঠিক হয় নি। ইন্টারে প্রাইভেট পড়ার সময় র্যাগিং নিয়ে এক বন্ধু গল্প বলেছিল: এক সিনিয়র নতুন ছাত্রকে র্যাগ দিতে গেলে জুনিয়রটা বলে, "আপনি যে সিনিয়র চিনবো কীভাবে? কপালে স্টিকার লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন"(যাতে চেনা যায়)। গল্প আর বাস্তবতা যে এক নয় প্রথম অংশটা বলতেই টের পেয়েছিলাম। তাই পরের অংশটা আর বলিনি(বললে তখনই হয়তো মাইর খেতাম]
আমার জবাব শুনে বড় ভাই(!) বিব্রত। ফোনে কাকে যেন আসতে বলছে। অবস্থা বেগতিক দেখে একজনের পিছে ডিপার্টমেন্ট অফিসে গেলাম। গিয়ে আইডি কার্ডের ফর্ম রেডি হয়েছে কিনা সেটা জানতে চাইলাম। অফিস সহায়ক জানালো, সব ফর্ম তৈরী হয় নি, রেডি হলে স্যারের হাতে ক্লাসে পৌছে দেবে। ক্লাস থাকায় নীচে নামলাম। রাস্তায় বের হতেই দেখি, ওরা কয়েক জন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই আমাকে ঘিরে ধরলো। তখন কথা কি হয়েছিল পুরোটা মনে নেই। কয়েকবার বলেছিলাম, ক্লাসের টাইম হয়ে গিয়েছে, আমি ক্লাসে যাব। তারপরও খানিকটা সময় আটকে রেখেছিল। এক সময় ক্লাস রুটিন দেখতে চাইলো। সেটা দেখে রুমের লোকেশনটা বললো। ছাড়া পেয়ে আমি খুশি, এই তাহলে র্যাগিং!
সেদিন বৃহস্পতিবার। ক্লাস শেষ করে বারান্দায় আসতেই, এক বড় ভাই আমাদের কয়েক জনকে হলে নিয়ে গেল। এক বন্ধু বলেছিল র্যাগ খেলে বড় ভাইদের সাথে পরিচিত হওয়া যায়, র্যাগ শেষে এটা ওটা খাওয়ায়। কিন্তু আমার একদমই যেতে ইচ্ছে করছিল না। একরকম বাধ্য হয়েই ওদের সাথে যাচ্ছি। হলে আসলে আমাদের দুজনকে একরুমে নিয়ে আসলো(এখনো মনে পড়ে সেদিন জিন্স আর কেডস পরেছিলাম)। দু-একটা কথার পর অপরজনকে(পরে সে ছাত্রলীগে জড়িয়ে পড়ে) আরেক রুমে নিয়ে যেতে চাইলো। আমি ওর হাত ধরে বললাম, "সে এখানেই থাকবে"। কাজ হল না, আমাদের দুজনকে আলাদা করে দরজায় পড়লো খিল।
চার সিটের রুম, মাঝখানে একটা কাঠের চেয়ার রাখা। ভেবেছিলাম চেয়ারে বসতে দিবে। কিন্তু না রুমের মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে বললো।
দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমি একা, ওরা মিনিমাম ৬-৭জন। শুরু হল গিনিপিগ টেস্ট। নানা প্রান্ত থেকে একের পর এক প্রশ্ন: নাম কী? বাড়ি কই? কোথায় পড়েছি?.... সচরাচর যা হয়, নাম জিজ্ঞেস করলে ডাকনামই বলি, এবারও বললাম। বলেই বিপদে পড়লাম। পুরো নাম কেন বলি নি! নামের আগে মোহাম্মাদ/মোসাম্মাদ কেন লাগাই নি! শুরু হল ম্যানার শেখানোর পালা।
আরেক জন প্রশ্ন করলো, ইঞ্জিনিয়ার বানান কর?
করলাম, ওরা বলল ভুল।
- ডিপার্টমেন্ট হেডের নাম বল?
বললাম। কিন্তু এখানেও ভুল। স্যারের নামের আগে পদ/টাইটেল বাদ পড়েছে। ডিপার্টমেন্টের নামের স্পেলিংও ঠিক হল না। একজন জিজ্ঞাসা করলো, "আমি সিআর হতে চাচ্ছি কেন?" বললাম জনগণ চাচ্ছে। আবার ভুল ধরলো, ওদের ভাষায় "পোলাপাইন" বলতে হতো, আমি জনগণ বলেছি দেখে হাসাহাসি শুরু করলো। বুঝলাম আমি ঘাবড়ে গিয়েছি, প্রশ্নের উত্তর জানলেও ঠিকমত বলতে পারবো না আর বললেও ওদের মনমত হবে না।
এর মধ্যে কিছুক্ষণ রুমের মাঝে এক পা তুলে দু হাত প্রসারিত করে কাকতাড়ুয়ার মত দাঁড়িয়ে থাকতে হল। সন্ধি, প্রত্যয় থেকে কয়েকটা প্রশ্ন করলো। মনে যা আসে বললাম।
একজন আর্মির মত করে ওদের সালাম দিতে বললো। আমি দিলাম না, বললাম, "এভাবে সালাম দেবার নিয়ম ধর্মে নেই"।(আমি ধর্ম কম মানি, সত্যি হল: ওভাবে সালাম দিতে তখন ইচ্ছে করছিল না)।
আমি মাথা নিচু করে না থেকে, হাসি হাসি মুখে আছি(ওদের ভাষায়), এখানেও সমস্যা। আমি ওদের ভয় পাচ্ছি না কেন, আমি বেয়াড়া, বড়দের সন্মান করতে জানি না, ম্যানার জানিনা, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্য না, ঘারত্যাড়ামি করলে পাশ করতে পারবো না,-- -- এমন অনেক কথা। এর মধ্যে বেশ খানিকটা সময় চলে গিয়েছে, ওদের কথা শুনে বেশ খারাপ লাগছিল, চশমা খুলে চোখ মুছলাম। ওদের একজন বললো, আমি নাকি অভিনয় করছি।
মনে একটা বিরক্তি ভাব আসলো। এতক্ষণ প্রশ্নের বাইরে তেমন কথা বলি নি। এবার বললাম, আমাকে এক্ষুণি রুমে যেতে হবে। আমার বাবা এই শহরে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, বৃহস্প্রতিবার করে বাসায় যায়, আমিও যাব(আমার যাবার কথাটা অবস্য মিথ্যে ছিল)। এরপর এক ছেলে তার বেডে ডেকে নিয়ে পাশে বসালো। বেশ নরম সুরে বললো, ক্যাম্পাসে পড়তে হলে বড় ভাইদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে, নোটপাতি পেতে হলে পরিচিত হতে হবে....। এ কথা সে কথায় আবেগে পড়ে আমি বলে বসলাম, অ্যাডমিশনে আমি আরো কয়েকটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম। পরিবার থেকে না বললে এখানে ভর্তিই হতাম না। কথা শুনে সে তো রেগে আগুন। প্রতিক্রিয়ায় সে কি বলেছিল মনে নেই, তবে তার মর্মার্থ এমন, "আমি আসলেই ত্যাঁড়া"(তাদের কাছে)।
এরপর আরেক জনের হাতে পড়লাম। ক্যাম্পাসের কোন সংগঠন সম্পর্কে জানি কি না বা কোন সংগঠনে যুক্ত আছি কিনা জানতে চাইলো। আমি বললাম, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কোন সংগঠনে আমি যুক্ত নেই, যুক্ত হবার ইচ্ছেও নেই, এসব দলটল করতে আমার ভালো লাগে না। পরের ঘটনা মনে নেই। বের হবার আগে সবার কাছে গিয়ে আলাদা করে সালাম দিয়ে(কয়েক জনের জন্য প্রথম ও শেষ সালাম) পরিচিত হলাম।
আমাদের জেলার এক বড়ভাই এসে কাঁধে দুটো চাপড়(মৃদু থাবড়া) মেরে রুমের বাইরে নিয়ে গেল। অবস্য এটা আমাকে তেমন বিব্রত করে নি। বের হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর আমরা তিনজন(পরে জেনেছিলাম অপরজনও আমাদের জেলার। ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচ, ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট(অন্য ক্যাম্পাসের), বেশি ত্যারামি করলে আমাকে মারার জন্য তাকে অানা হয়েছিল) অন্য হলে এক ভাইয়ের রুমে যাই। সে ছাত্রলীগ নেতা, আমাদের জেলার। মনে মনে ভাবছি, আরেক দফা টর্চার হবে নাকি!
না, তেমন কিছুই হল না। বরং ভাই বেশ ফ্রেন্ডলি কথা বললো, আমাদের জেলা নিয়ে লেখা একটা বই ফ্রী দিলো। এরপর ক্যাম্পাসের মাঠে গিয়ে ব্রেঞ্চে বসে খানিকটা সময় গল্প হলো, ভাই বরই খাওয়ালো। সেদিনের মত রুমেও ফিরলাম।
এরপর যে খুব বেশী চেঞ্জ হয়েছিলাম তা না, তবে সমস্যায় পড়ি নি। বাসে পুরো দু সেমিস্টার যাতায়াত করেছি, কোন দিন কেউ সিট থেকে উঠতে বলে নি। অনেকে প্রথম বর্ষে ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে ভয় পায়, আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। আমার বন্ধুদের বেশীরভাগই ছিল স্থানীয়, আমরা শুরু থেকেই ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকতাম। মাঝেমাঝে পুরো টেবিল আমাদের দখলে থাকতো, খেতাম, পড়তাম, আড্ডা দিতাম(ব্লগ নিয়েও দু-একদিন কথা হয়েছে)। তবে হ্যাঁ, এই ঘটনার পর আমি সিআর পদে আর দাঁড়াই নি। পুরো ক্যাম্পাসে ঘুরতাম কিছু মনে হতো না কিন্তু সেই হলটার পাশ দিয়ে যাবার সময় কেমন এক অস্বস্তিতে ভুগতাম। কালের বিবর্তনে জুনিয়র থেকে সিনিয়র হলাম, ছোট বড় অনেকের সাথে পরিচিতও হয়েছি। তবে রুমে ডেকে কারো সাথে দাদাগিরি করি না। শেষ বর্ষে র্যাগ ডে নামে একটা অনুষ্ঠান হয়। এই নামটাও আমার পছন্দ নয়। কি জানি আমি হয়তো একটু অানসোশ্যাল, একগুয়ে, আর কারো কারো কাছে ত্যাড়া!
...
ঘটনা-২ঃ "সরো তো ভাই"
সবে হলে উঠেছি। একদিন বিকেলে শহরে আগে যেখানে থাকতাম সেখানে ঘুরতে গেলাম। পরিচিতদের সাথে দেখা করার পর ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য মেইন রোডে আসলাম। এখান দিয়ে ভার্সিটির বাস যায়, ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাসের অপেক্ষা করছি। হঠ্যাৎ দেখি বাস চলে আসলো, সিটও ফাঁকা। আমি স্টপেজ থেকে একটু দুরে থাকায় বাস চলে যাচ্ছিল। কি মনে করে হাত নেড়ে বাস থামাতে বললাম। এই রুটে যাতায়াত করায় হেল্পার মামা কিছুটা পরিচিত ছিল, সে দরজায় বাড়ি দেয়ায় বাস থামালো। যাওয়ার ভাড়াটা বাঁচলো বলে মনে মনে ভালোই লাগলো। দৌড়ে গেলাম বাসের দিকে। পেছনের গেটে দেখি গেট আগলে এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সিট ফাঁকা থাকার পরও না বসে এভাবে গেট আগলে থাকায় বিরক্ত লাগছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, "সরো তো ভাই"।
বাসে ঢুকে পেছনের দিকে থ্রি সিটের একটা সিটে বসে পড়লাম। ঝালমুড়ি তখনও শেষ হয় নি, মুখে পুরে চাবাতে থাকলাম। গেটে দাঁড়ানো ছেলেটা কয়েকধাপ উঠে মৃদুস্বরে ঝাড়ি দিচ্ছে। তার কথার বিষয়বস্তু যে আমি সেটা বুঝতেই ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রায় দেড় বছর বাসে করে ক্যাম্পাসে গিয়েছি কখনো তো এমন হয় নি! ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি কিছু ঘাবড়ে গিয়েছি।
বাঁকিটা ১ম মন্তব্যে
(মোবাইল থেকে ২^১৩=৮১৯২ ক্যারেক্টরের বেশী টাইপ করা যাচ্ছে না)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০৪