somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমাদের ভন্ডামী

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভন্ডামী ও প্রতারণার বসবাস তাথেকে কোনভাবেই মুক্ত নয় একুশে ফেব্রুয়ারী। একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপনের যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে তা কেবল এই ভন্ডামীকেই মনে করিয়ে দেয়।এই দিন সবচেয়ে বড় আয়োজন চলে শহীদ মিনার। শহীদ মিনার ঢেকে যায় ফুলের বন্যায়। এই ফুলের বন্যা দেখে যে কারে মনে হতে পারে শহীদদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসার সীমা নাই। কিন্তু আসলে কি তাই?

এই দিন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থে কে সর্ব নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সবাই হামলে পড়ে শহীদ মিনারে।
ফেব্রুযারি মাস এলে ভাষা নিয়ে কত কবিতা কত গান, কত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, পত্রিকার পাতায় কত কলামের পর কলাম লেখা হয়। কত ফুল জমা হয় শহীদ মিনারে! ফেবরুয়ারির এত রূপ দেখে কৃষ্ঞচূড়া দূর থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।শহীদ মিনারে যে চিত্র পাওয়া যায় পুরো সমাজে দেখা যায় তার ভিন্ন রূপ। পুরো সমাজে রয়েছে বাংলা ভাষার তীব্র অবহেলার চিত্র। শুধু অবহেলা নয় অবহেলার তীব্র প্রতিযোগীতা।

আমরা এই দিন শাড়ী পরি। পান্জাবি গায়ে দিই। আন্ডা বাচ্চা নিয়ে হাজির হই শহীদ মিনারে। ভাষার প্রতি ভালোবাসার খই ফোটে আমাদের মুখে। বাস্তবতা হলো এই দিন টা আমাদের জন্য নিতান্তই একটা ফুর্তির দিন। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে বিজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে আমরা যেভাবে মেতে উঠি তা থেকে শহীদ দিবসের ফুর্তি কোন অর্থে আলাদা? ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে অন্তত শহীদ আত্মার সাথে প্রতারণা করা হয় না। আর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যা হয় চলে তা হল শহীদ আত্মার সাথে রীতিমত ভন্ডামী। অকৃতজ্ঞতা।

আমরা কি এই দিন আসলেই মাতৃভাষা কে তথা মাকে ভালবাসার শপথ নিই? দৃশ্যত তাই। কিন্তু আমার দুঃখিনী মা পড়ে থাকে ভাঙা ঘরে। তার দিকে ফিরেও তাকাই না। সেকেলে এই মা কে নিয়া ভাবলে আমাদের মান ইজ্জতের বারটা বাজে। ফেব্রুয়ারি আসে ফেব্রুয়ারি যায়। শহীদ মিনারে ফুলের স্তুপ দিনকে দিন বড় হয়। সেই সাথে পাল্লা দিয়া ফেইসবুকে হিন্দিতে স্টাটাস লেখার পরিমানও বাড়ে। বাড়ে হিন্দিতে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো। ইংরেজি ইশকুলের লাইনও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। বাড়ে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি চর্চার হিড়িক। কমে না ইংরজি সাইনবোর্ড, কমেনা ইংরেজি বিজ্ঞাপন। আধুনিকতার নামে আমরা কেবল ইংরেজিতে অবগাহন করি। সেই সাথে গোদের উপর বিষফোড়া হল হিন্দি। শহীদ মিনারে এসে কোন গৃহিনি শপথ নেন না আর হিন্দি সিরিয়ালে মেতে নিজের পরিবারের আর নিজের ভাষার বারটা বাজাবো না।বরং তখনো তার মাথায় ঘুরপাক খায় সেই ভিন দেশের বিকৃত কাহিনী। একটা দিন একটু ফুর্তির সুযোগ পাওয়া গেল এটাই বা কম কিসে। কোন ব্যবসায়ী শিল্পপতি এই দিন ভাবেন না এইবার নিজের অফিসের ইংরেজি সাইনবোর্ডের পাশে বাংলা সাইনবোর্ড ঝুলবে। কি দরকার! শহীদ মিনারে এসেছি। নিজের ও প্রতিষ্ঠানের একটা ফাও বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

এই দিন কোন মিডিয়া কর্মী কি ভুলেও একবার ভাবেন নিজের মায়ের ভাষা কে বহুবার ধর্ষণ করেছি। আর না। এখন থেকে বিকৃত বাংলা নয়। তিন শব্দের বাক্যে দুই শব্দ ইংরেজি আর নয়। সহজ সাবলীল বাংলার চর্চা করব। সালাম বরকত শফিক জববার নিজের জীবন দিয়ে দিল আর আমরা বুঝি বাংলার প্রতি এতটুকু দরদ দেখাতে পারব না। না এই কথা ভুলেও কেউ ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন না এখন থেকে নিজেকে আর জে নয় কথাবন্ধু ভাববো। আমার অবস্থান থেকে আমার মায়ের ভাষার এতটুকু অসম্মান আমি করব না।

একটা মানুষও কি শহীদ মিনারে দাড়িয়ে ভাবে না এলিট সোসাইটি না বলে খানদানি গোষ্ঠি বলব, কাজিন বলব না চাচাত মামাত খালাত ভাই বলব, আংকেল নয় চাচা, মামা,কাকা, ফুফা খালু বলব, আর আন্টি নয় খালা, মাসী, পিসি, চাচি, মামী বলব। ফ্রেন্ড কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ফিরিয়ে নিয়ে আসব প্রাণের বন্ধু কে। মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেন ভাই/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই--- সেই মায়ের মধু আমরা আর চাই না। ম্যম ড্যাড এর তলে কবেই পিষ্ট হয়ে গেছে সেই মধু। ফেব্রুয়ারি কি পারে আমার মাকে ফিরিয়ে দিতে? আজীবন যে ছিল মাছে ভাতে বাঙালি তার আজকে ভাত বললে জাত যায়। ভাত হয়ে গেছে রাইচ। ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখের কোন ক্ষমতাই নেই সেই রাইসকে ভাতে পরিনত করে।

আমরা সালাম আদাব ভুলে গেছি। গুড মর্নিঙ, গুড নাইট না বললে নিতান্ত সেকেলে হতে হয়।
এখন বেতার টিভি'র কোন উপস্থাপক সালাম আদাব দেন না। খোদা হাফেজে অরুচি তাদের। শুধু কি তাই এই খোদ একুশে ফেব্রুয়ারিতেও তাদের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এই দিনেও টিভি বেতারে চলে সমানভাবে মাতৃভাষা ধর্ষণের প্রতিযোগিতা। একদিকে দিনের পর দিন মাতৃভাষাকে নিদারুন অবহেলা অপমান আর দিকে তারাই আবার ২১শে ফেব্রুয়ারির হোমরা চোমরা। সারা বছর যেই সব বিদেশি কোম্পানি ভাষা রূপ মায়ের গলায় চুরি চালায় এরা সে দিন সাধু সাজে। খবরের কাগজগুলোর পৃষ্ঠা ভরে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাষার জন্য মায়া কান্নাজুড়ে দেয়। শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানমালায় টাকা ঢালে। তাদের মায়া কান্না দেখে আমরা মোহিত হই। ওরা গরু মেরে জুতা দান করে। আর আমরা তাতে বগল বাজাই।

একুশের চেতনার কথাও খুব বড় করে শোনা যায়। এই সব ভন্ডামীপূর্ণ আয়োজনে এই চেতনার গীত খুব গাওয়া হয়। কিন্তু এই চেতনার ধারে কাছেও আমরা যেতে রাজি না। একুশের চেতনা থাকলে আমরা তো আড্ডা গল্প আর গানে হারিয়ে যেতাম না। সাম্রাজ্যবাদ এমনি করে ঝেঁকে বসত না আমাদের উপর। আমাদের জাতীয় জীবন হত না মেরুদন্ডহীন কীটের জীবন। আমাদের অধপতন আর বন্ধ্যাত্ব এত দূর গিয়েছে যে এটাকেই এখন স্বাভাবিক মনে হয়। কোনটা স্বজাতীয় কোনটা বিজাতীয় এতটুকু বোধ আমাদের নাই। নিজের স্বার্থ ঠিকই বুঝি। জাতীয় স্বার্থ নিতান্তই পাগলের প্রলাপ। এই পুঁজিবাদী সমাজে মায়ের ভাষা, দেশ মাটি এই সব আবেগ নিতান্ত অর্থহীন। পূঁজিবাদী সমাজ চিনে কেবলি মুনাফা। আর এই ফেব্রুযারিও তাদের কে বঞ্চিত করে না। ফেব্রুয়ারি তাদের জন্য একটা ব্যবসার বড় উপলক্ষ বটে।

২০০২ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউটের পক্ষ থেকে শহীদ মিনার দায়িত্ব পালন করছি। দুপুর প্রায় ১২টা। তখনো তুমুল ভীড়। সেই ভীড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ এক পাগল উদয় হয়ে বল্ল একটা ফুল দে। কেউ দিতে রাজি হলো না। শেষে নিজেই একটা নষ্ট ফুল তুলে নিয়ে বল্ল 'তাহলে পঁচা টাই দে খাইতে খাইতে যাইগা।' এবং সত্যি সত্যি ফুলটা খেতে খেতে জনস্রোতের উল্টো দিকে চলে গেল। আমি কেন জানি বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেয়ে থাকলাম লোকটার পথের দিকে। আমার কেন জানি মনে হল লক্ষ কোটি ফুলের ভীড়ে একটা পঁচা ফুলই বুঝি কাজে লাগলো!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সচীবদের সম্পর্কে এখন কিছুটা ধারণা পাচ্ছেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ২০ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৭



সামুর ব্লগারদের মাঝে ১ জন সচীব আছেন,(বর্তমানে কর্তব্যরত ) তিনি বর্তমানে লিখছেন; আধামৃত সামুতে তিনি বেশ পাঠক পচ্ছেন; উৎসাহের ব্যাপার! এরচেয়ে আরো উৎসাহের ব্যাপার যে, তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীবাদ, ইসলাম এবং আইয়ামে জাহেলিয়া: ঐতিহাসিক ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

লিখেছেন মি. বিকেল, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৪



আইয়ামে জাহিলিয়াত (আরবি: ‏جَاهِلِيَّة‎) একটি ইসলামিক ধারণা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী আরবের যুগকে বোঝায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়কাল ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×