প্রথম পর্বঃ
গত কয়েক দিন ধরে স্টুডেন্টস এগেনস্ট ডিসক্রিমিনেশন (SAD) এবং শিবিরের মধ্যে প্রচণ্ড কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। এর কারণ হলো জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচার পতনের ক্ষেত্রে পরস্পর কে কার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে— তা নিয়ে।
তাদের এই অন্তহীন বিতর্ক দেখে আমি ও আমার বন্ধুরা আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আমরা ভাবলাম, এই আন্দোলনকে ঘিরে অনেক অজানা কথা রয়েছে, এক প্রকৃত সত্য রয়েছে—যা উন্মোচন করা উচিত। যেহেতু আমি অন্য মহাদেশে থাকি এবং আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর ক্ষুব্ধ ও আন্দোলনে সহমর্মী শত শত অফিসারের সঙ্গে হাজারো কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তাই মাঠপর্যায়ের সমন্বয়ের দায়িত্ব পড়েছিল আমার দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন একজন নারীর ওপর। তিনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। তাই এবার আমি সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর অলিখিত আখ্যান লিপিবদ্ধ করতে বসেছি…
তখন ২৬ জুলাই, রাত ১০টা ১০ মিনিট। আমার আস্থাভাজন সেই নারী সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক সাংবাদিকের কাছ থেকে একটি বার্তা পান। তিনি সেই নারীকে চারজন আন্দোলনকারী সমন্বয়কের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। সমন্বয়করা তখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কাছে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আটকে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই আস্থাভাজন নারী সাংবাদিক আমাকে ফোন করেন, আর এভাবেই আমি সরাসরি আন্দোলনকারী ছাত্রদের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। তখন আমি নারী সাংবাদিককে পরামর্শ দিই যে, আমাদের দুজনের পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে, তিনি কিছু করতে পারেন কী না।
এরপর নারী সাংবাদিক আমাদের সেই পরিচিত কর্মকর্তাকে ফোন করেন এবং তাকে বলেন যে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এমন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে আগ্রহী হয়েছিল। যেমন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়াকে শেল্টার দেওয়ার হয়েছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আমাদের হতাশ করে। সেই কর্মকর্তা জানান, এবার সেটা সম্ভব হবে না, কারণ দূতাবাসে তখন কোনো রাষ্ট্রদূত দায়িত্বে ছিলেন না এবং চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হাসিনা সরকারের ক্ষোভের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছিলেন না। তবে তিনি এটা বললেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তার কয়েকজন পরিচিতের সঙ্গে কথা বলবেন। কেউ সাহায্য করতে আগ্রহী হলে জানাবেন।
এদিকে, আমার আস্থাভাজন নারী সাংবাদিক তার অন্যান্য পরিচিতদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো ব্যবস্থা না হলে, তিনি নিজ বাসায় ছেলেগুলোর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। তবে ২০ মিনিট পরেই দূতাবাসের সেই কর্মকর্তা তাকে ফোন করে জানান যে, গুলশানে একটি বিদেশি সংস্থার অফিসে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সংস্থাটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা চার সমন্বয়ককে গ্রহণ করবেন।
আমি তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওই সাংবাদিকের দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করে ছেলেগুলোর নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়ে জানাই। নম্বরটি ছিল সালমান নামের এক শিক্ষার্থীর। গোটা আন্দোলন চলাকালে আমি তাকে সে নামেই চিনতাম। তবে, যাকে গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর জানতে পারি যে, সে আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি Md Abu Shadik। যাই হোক, আমি ঢাকার কয়েকটি সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের গুলশান-২-এ নিরাপদে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করি। অবশেষে, চারজন ছাত্রকে দুটি রিকশায় গুলশানে পাঠানো হয় এবং রাত ১১টার মধ্যেই তারা নিরাপদে পৌঁছে যায়। তবে শর্ত ছিল, ২৮ জুলাই সকাল ৯টার মধ্যে তাদের স্থান ত্যাগ করতে হবে, কারণ তখন সেই বিদেশি সংস্থার অফিস খুলে যাবে।
২৭ জুলাই সন্ধ্যায় স্বনামধন্য আলোকচিত্রী Shahidul Alam ভাই এই ছেলেদের ব্যাপারে জানতে পারেন এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন। এতে আমরা স্বস্তি পাই। কারণ, এরপর দুই দিন ধরে আমরা ধরে নিই, তারা তার কাছেই নিরাপদে আছে। এদিকে, সালমান আমাকে ফোন করে অনুরোধ করে যে, তারা যদি আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে আন্দোলনের ওপর একটি প্রদর্শনীর জন্য ইএমকে সেন্টার বুক করতে চায় এবং আমি বুক করার ক্ষেত্রে কোনো সাহায্য করতে পারবো কি না। আমি আমার আস্থাভাজন নারী সাংবাদিককে বিষয়টি দেখতে বলি। তিনি সালমানের পরিকল্পনা শোনেন এবং এএফপির তৎকালীন ব্যুরো প্রধান Shafiqul Alam ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানবাধিকার কর্মী Rezaur Rahman Lenin এর সঙ্গে পরামর্শ করেন। তারা জানান, ইএমকে সেন্টার বুক করা সম্ভব নয়, কারণ এর জন্য সরকারের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স লাগবে। অন্যদিকে, দৃক গ্যালারি ১০ আগস্টের আগে এমন কোনো ইভেন্টের জন্য উন্মুক্ত হবে না। সালমানকে এ কথা জানানো হলে, সেই মুহূর্তেই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
২৮ জুলাই দুপুর ১২টা ৯ মিনিটে সালমান আমার আস্থাভাজন নারী সাংবাদিককে আরেকটি বার্তা পাঠায়। সে আরেক সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে। তিনি বার্তাটি আমাকে ফরোয়ার্ড করেন, এবং আমি তখন একটি দূতাবাসে কর্মরত এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি রাজি হন কাদেরকে তার গুলশানের বাসায় আশ্রয় দিতে। বাসাটি ইউএস এ্যাম্ব্যাসির অতি নিকটে। কিন্তু সেটা তার অফিস শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ বিকেল ৪টার পরেই সম্ভব হবে। আমি নারী সাংবাদিককে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিই। কাদের তখন শনির আখড়ায় ছিল, যা গুলশানের অনেক দূরে, তাই তাকে অর্ধেক রাস্তা অবধি আসতে বলা হয়। সেখান থেকে তাকে আশ্রয়দাতা গুলশানে নিয়ে আসেন।
এর মাধ্যমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান Tarique Rahman ছাত্রদের কার্যক্রমে সরাসরি অবগত হওয়া শুরু করেন। চট্টগ্রামের বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক Mir Helal এর মাধ্যমে তিনি কাদেরের হোস্টের নিকট থেকে নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। সে রাতে আমরা জানতে পারি যে SAD-এর ছয়জন সমন্বয়কারী— Nahid Islam, Asif Mahmud, Md Sarjis Alam, Hasnat Abdullah, আবু বকর মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম—ডিবি অফিস থেকে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। আমরা বিস্মিত হই। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে সালমান সেই নারী সাংবাদিককে জানায় যে, আন্দোলন চলবে এবং Abdul Kader, Abdul Hannan Masud, Rifat Rashid ও মাহিন সরকার নেতৃত্ব দেবে।
আমি পরামর্শ দিই যে, এই চারজন নতুন নেতা তাদের অবস্থান থেকে একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করুক এবং নারী সাংবাদিককে মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিই। সালমান এই মধ্যে নারী সাংবাদিকের কাছে আমাদের নতুন চার নেতা যে বক্তব্য রেকর্ড করবেন, সেটির স্ক্রিপ্ট পাঠায় এবং ঠিক করতে বলে। তিনি সেটি আমার কাছে পাঠিয়ে ঠিক করতে বলেন, আর তিনি নিজে বার্তাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। সেই ভিডিও বার্তাগুলি প্রকাশ হচ্ছে না দেখে আমরা দুজনেই রাত ১১টা ৪ মিনিটে সালমানকে দুটি বার্তাই পাঠাই। জিজ্ঞেস করি কেন এখনো প্রকাশ হচ্ছে না। রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে সালমান জানায় যে ভিডিও বার্তা প্রকাশের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি এখনই তোলা হবে কিনা, তা নিয়ে তাদের থিঙ্কট্যাঙ্কের মধ্যে বিতর্ক চলছে। শেষ পর্যন্ত, তারা আপাতত নয় দফা দাবিতেই স্থির থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাত ১২টায়, একটি বিবৃতি SAD-এর লেটারহেডে প্রকাশিত হয়। কাদের ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে, যা তার আশ্রয়দাতার ডাউনলোড করা টেলিপ্রম্পটার থেকে পড়া হয়।
পরের দিন, ২৯শে জুলাই। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিট। নারী সাংবাদিক সালমানের ফোন পেলেন। সালমান জানতে চাইলো—হান্নান, রিফাত, মহিন আর মেহেদীর জন্য কি নিরাপদ জায়গা করা যায়? পরে জানা গেল মেহেদী ছাত্রদলের জাহাঙ্গীরনগর ইউনিটের আব্দুল গাফফার জিসান। ওরা তখন গুলশানের নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্সে বসে আছে। এক ঘণ্টার মধ্যে কারফিউ শুরু হবে এবং কফি শপটি বন্ধ হয়ে যাবে। ওদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া দরকার।
নারী সাংবাদিক তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন জনকে ফোন করতে শুরু করলেন তাদের আশ্রয়ের খোঁজে। বন্ধু, পরিচিত সবাইকে ফোন করলেন। কেউ কি সাহস করে এই ছেলেদের কয়েক ঘণ্টার জন্য আশ্রয় দেবে? রাত কাটানোর জায়গা করার আগ পর্যন্ত। একবার ভেবেছিলেন, ছেলেদের নিজের অফিসে পাঠাবেন। অফিসটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আওতার বাইরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করতে হয়নি।
আমাদের বন্ধু Fahim Ahmed আর Andaleeb Choudhury রাজি হলেন। বনানীতে তাদের বাড়িতে ছেলেদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। তখন নর্থ এন্ড বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেরা আশ্রয় নিল বনানীর একটি কোচিং সেন্টারে। আন্দালিবের সাথে নারী সাংবাদিক সমন্বয় করলেন। আন্দালিব নিজে ছুটে গেলেন ছেলেদের লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে তাদের তার বাসায় নিতে।
আন্দালিব একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার। এই নারী ১৮ই জুলাই থেকে কোটা আন্দোলনের সাথে জড়িত। অর্থাৎ যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, তখন থেকেই। আন্দালিবের আশ্রয়ে ছেলেরা গেলেই নিরাপদ বোধ করে। শিক্ষার্থীরা নারী সাংবাদিককে জানালেন, তারা রাতটা সেখানে কাটাতে পারবে।
আন্দালিবের স্বামী ফাহিম। তিনি একটি নামকরা কোম্পানির সিইও। আমার আস্থাভাজন নারী সাংবাদিক চাননি, এই আন্দোলনে তাদের আরও জড়িয়ে ফাহিমের ক্যারিয়ার বা কোম্পানির ক্ষতি হোক। তাই, দম্পতির আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পরের দিন সকালেই ছেলেদের সরিয়ে নেওয়া হবে।
তারপর শুরু হলো আবার ফোনের পর ফোন। নারী সাংবাদিক হন্যে হয়ে ছেলেদের জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন। কাদেরের আশ্রয়দাতাকে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি কী আরও কয়েকজনকে আশ্রয় দিতে পারবেন। তিনি জানালেন, তার ফ্ল্যাটে আরও চারজন থাকার জায়গা নেই। তবে, তিনি আশ্বাস দিলেন তিনি তাদের আশ্রয়ের জন্য জায়গা খুঁজে দেবেন। সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিটে খবর এল, পুরান ঢাকায় একটি নিরাপদ জায়গা পাওয়া গেছে।
কিন্তু, বনানী থেকে পুরান ঢাকায় ছেলেদের নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। সে সময় পরিস্থিতি তুঙ্গে। তাই, রেজাকে অনুরোধ করা হলো শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দিতে। তিনি রাজি হলেন।
এদিকে আমি মিরপুর ডিওএইচএসে আরেকটি ব্যাকআপ নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করলাম। আশ্রয়দাতা হলেন ওয়াহিদ আলম, যাকে বিএনপির লোকদের মাধ্যমে চিনি। তার নম্বর নারী সাংবাদিককে দিলাম, যদি তার কোনো ইমার্জেন্সি সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
লেখকঃ জুলকার নাইন সায়ের সামি
মুলপোস্টঃ প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১১:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




