দেনমোহর মুসলিম বিবাহের অন্যতম একটি অবশ্য পালনীয় উপাদান। এটি নারীর একটি অধিকার। বিয়ের সময় দুপক্ষের সম্মতিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হলেও এর কী পরিমাণ পরিশোধিত ও কী পরিমাণ বাকি থাকবে, এর কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। ১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) বিধির ২৪(১) বিধি অনুযায়ী, বিবাহ নিবন্ধনের ফরমে ১৫ নম্বর কলামে উল্লেখ্য বিয়ের সময় পরিশোধিত দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণে কোনো বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই এখানে দেনমোহরের একটি বড় অংশ পরিশোধিত দেখানো হয়। দেনমোহর বাবদ কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই কাবিননামায় দেখানো হয় পরিশোধিত টাকার অঙ্ক।
একইভাবে কাবিননামার ১৪ নম্বর কলামে উল্লিখিত তাৎক্ষণিক/মুয়াজুল ও বিলম্বিত/মুয়াজুল অংশের ব্যাপারেও রয়েছে বিভ্রান্তি। এসব বিভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত বিরোধের স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যৌতুকের অর্থের সঙ্গে অপরিশোধিত দেনমোহরের অর্থ সমন্বয়ের ঘটনাও ঘটে। যদিও দেনমোহর নারীর আইনসংগত অধিকার, আর যৌতুক নেওয়া-দেওয়া, দাবি করা বা এসবের সহযোগিতা ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।
দেনমোহর হলো কিছু অর্থ বা সম্পত্তি, যা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের চুক্তির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাওয়ার অধিকার লাভ করে। পরিশোধের সময় অনুসারে ‘তাৎক্ষণিক’ ও ‘বিলম্বিত’ এই দুই ভাগে বিভক্ত, তাৎক্ষণিক দেনমোহর বিয়ের চুক্তির পর স্ত্রী দাবি করা মাত্র পরিশোধযোগ্য। অপরদিকে বিলম্বিত দেনমোহর কোনো নির্দিষ্ট সময় পরে পরিশোধযোগ্য এবং যখন কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না তখন মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিশোধযোগ্য হয়। কাবিননামায় যথাক্রমে মুয়াজ্জাল ও মু-য়াজ্জাল শব্দ দুটি ব্যবহূত হয় ১৪ নম্বর কলামে।
বিয়ে নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত কাবিননামায় উল্লেখ থাকে, দেনমোহরের কী পরিমাণ তাৎক্ষণিক ও কী পরিমাণ বিলম্বিত হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেনমোহর আদায়ের প্রশ্নটি কেবল বিচ্ছেদের সময়েই উত্থাপিত হয়। যদিও এটি সব ক্ষেত্রে কেবল বিচ্ছেদকালীন বলবৎযোগ্য অধিকার নয়। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ৫ ধারায় বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্বের প্রশ্নে উত্থাপিত বিষয়গুলো পারিবারিক আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ারাধীন। এ আদালতে অপরিশোধিত দেনমোহরের জন্য স্ত্রী এবং তাঁর (স্ত্রী) মৃত্যুর পর সন্তানের উত্তরাধিকারীরাও আদায়ের জন্য মামলা করতে পারবেন।
তামাদি আইন ১৯০৮-এর তফসিল ১, অনুচ্ছেদ ১০৩ অনুসারে তাৎক্ষণিক দেনমোহরের ক্ষেত্রে দাবি করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত তামাদির সময়সীমা। এই সময়ের মধ্যেই মামলা রুজু করতে হবে। অন্যদিকে, যদি দেনমোহর দাবি করা না হয়, তবে তালাক অথবা মৃত্যুর মাধ্যমে বিচ্ছেদের তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মামলা রুজু করতে হয়।
বিলম্বিত দেনমোহরের ক্ষেত্রে তামাদি আইনের প্রথম তফসিলে ১০৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এর সময়সীমাও হবে তিন বছর। গণনা শুরু হবে মৃত্যু অথবা তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদ হলে সেই তারিখ থেকে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ১০ ধারা মতে, যেখানে কাবিননামায় তাৎক্ষণিক ও বিলম্বিত দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ নেই, সে ক্ষেত্রে দেনমোহরের সম্পূর্ণ অংশই তাৎক্ষণিকভাবে আদায়যোগ্য বলে ধরে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও তামাদি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধান তাৎক্ষণিক দেনমোহরের মতোই প্রযোজ্য হবে।
উৎস জানতে ক্লিক করুন