somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বন্ধুর গল্প।

১৭ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ৩:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। কচি সোনা রোদ মাখা পাহাড়ী গাছেরা হেমন্তের মিষ্টি বাতাসে দুলে দুলে যেন শীতকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দূরের পাহাড়গুলো কুয়াশাচ্ছন্ন। আবছায়া পাহাড় যেন বারে বারে ডেকে ফিরছে। আমলকি গাছের সবুজ পাতা আর হলুদ ফুলের মিতালী দেখে মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে দোয়েল পাখি। পাখিটা মাঝে মাঝে শিষ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন নীলকে উদ্দেশ্য করেই শিষ দিচ্ছে। প্রকৃতির সব নির্জনতা ভেদ করে একদল মুক্ত বিহঙ্গ কিচিরমিচির করে গাছের এ শাখা থেকে ও শাখা করে ফিরছে। এত সবুজ প্রকৃতি এত নির্মল নীল আকাশ এত সুন্দর মায়াময় চারদিক কিন্তু তারপরও নীলের বুকের ভিতরটা যেন কেমন কেমন করছে। সকালে ঘুম থেকে জেগে মাকে বিছানায় না পেয়েই মন খারাপ হয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়েও মন ভাল হল না।
নীল মাকে একদিন প্রশ্ন করেছিল, আকাশ কেন এত নীল ? মা বলেছিলেন আসলে আকাশ শুধু ফাঁকা। অর্থাৎ এর কোন শুরু শেষ নেই। এই অসীম মহাকাশের কোন রংও নেই। কিন্তু এই ফাঁকাই আমাদের চোখে নীল রং হিসেবে ধরা দেয়।
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে বস্তি বাড়ির চেঁচামেচিতে। মা সকালে নাস্তা সেরে আর্ট স্কুলে চলে যান। সারাদিন ঘরে একা থাকে নীল। দুপুরে মা এসে রান্না করেন। দুপুরের খাবার পর মা আবার বেরিয়ে যান। সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। সারাদিন একাই থাকতে হয়। মাকে ঘিরেই নীলের জগৎ। একাকিত্বের সঙ্গী শুধু ইজেল আর রংতুলি। মা ফিরে এলে সন্ধ্যায় সারাদিনের আঁকা ছবির চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। কোন কোন দিন মা কবিতা শোনান। আবার রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেও কোন কোন দিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এসে যায়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে মা’র সাথে নীল বেড়াতে বের হয়। কিন্তু এতো সুন্দর পরিবেশে মা তাকে প্রথম নিয়ে এলো। মা তাকে সব জায়গায় সাথে সাথে নিয়ে যায়। সব সময় সাথে সাথেই থাকেন ? কিন্তু আজ মা যে কোথায় গেল ? এত সুন্দর পরিবেশ। তবুও ভাল লাগছে না। মাকে ছাড়া আসলে কিছু ভাবতেও ভাল লাগছে না নীলের।
গতকাল বিকাল ৫টায় নীল ও তার মা এখানে পৌঁছেছে। তারপর হোটেলে উঠতে উঠতে বেশ সময় পার হয়েছে। সারাদিন ট্রেনে তাই খুব কান্ত হয়ে পড়েছিল নীল। সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বসে অন্ধকারের পাহাড় দেখছিল নীল। মা রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাচ্ছিলেন। এর মধ্যে মা হঠাৎই বলে উঠলেন নীল তুমি বড় হয়েছ ? নিজেকে সামলে চলতে হবে, মনে কর আমি তো তোমার সাথে সব সময় থাকব না।”
মা যেন মমতা ভুলে গেলেন। আজ প্রথম মা নীলের সাথে তুমি করে কথা বলল, কেন বলল ? নিজেকে সামলে চলতে হবে। কেন মা এসব কথা বলল ? এ সব ভাবতে ভাবতে নীলের মনে হলো সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। আকাশ বাতাস সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পাখিরা গান ভুলে গেছে। গাছেরা অক্সিজেন দিতে কার্পণ্য করছে। বৃষ্টিতে কোন জল নেই। রাতে এসব ভাবতে ভাবতে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। দু’বার পানি খেয়েছে নীল। সারারাত ও জেগে ছিল।
মনে মনে ভাবছিল মাগো, আমি তোমায় ছাড়া কিছুই বুঝি না। তুমিই আমায় সামলে রেখ’ কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের বুকে আঁছড়ে পড়ে যদি কাঁদতে পারতাম। তাহলে বোধ হয় চোখটা এত জ্বালা করত না। এত কষ্ট হত না। কিন্তু কোথা থেকে এক বুক অভিমান এসে ভর করলো, আবেগ রুদ্ধ হয়ে গেল, বাকশক্তি হারিয়ে গেল। শুধু অপলক নেত্রে মায়ের দিকে চেয়ে রইল নীল। মাও মনে হয় রাতে ঘুমায়নি। সারা রাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল নীল। এই ফাঁকেই মা চলে গেলেন।
মা কোথায় গেলেন ? আমাকে না বলে মা তো কোথাও যায় না ? নাকি আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল, তাই কি গত রাতে এসব কথা বলেছিল ? ভাবতে ভাবতে নীলের বাদামী চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। বিছানায় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না।

পাহাড়ী পথ। এত চড়াই উৎরাই, এরকম রাস্তায় তো চলার অভ্যাস নেই তাই খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু জিরিয়ে নিলেই মনে হয় ভাল হত। আর হাঁটতে পারছি না। কিন্তু হাতে সময় খুব কম। পল্লীর বিষয়টি সমাধান না হলে তো বিপদের আর শেষ নেই। যে ভাবেই হোক এ কাজে হারলে চলবে না। হোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গোছাতে হবে। ফোন করতে হবে। এখনও অনেক কাজ বাকি। ভাবতে ভাবতে কষ্ট ভুলে গেল কবিতা। দূরে পল্লীর ঘর চোখে পড়তেই সব কান্তি দূর হয়ে গেল। স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে সমাজপতির বাড়ি চিনে নিলেন তিনি। বুক দুরু দুরু করছে। সমাজপতি লোকটা যদি রাজি না হয়। যদি বিশ্বাস না করে। যদি ফিরিয়ে দেয়। কবিতা কি করবে তাহলে ? কমপে একদিন তাকে থাকতেই হবে।
সমাজপতির নাম শিবানী বড়–য়া। তার কাছে একদিনের আশ্রয় চাইল কবিতা। লোকটা প্রথমে রাজি হয়নি। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাজি হল। মাত্রতো একদিন। লোকটার কথায় অবশ্য যুক্তি ছিল। পাহাড়ী এলাকায় অপকর্ম যেভাবে বেড়ে গেছে তাতে করে সহজে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কে ভাল আর কে মন্দ তা হিসাব করা এখন খুব কঠিন। কাজটা এত সহজে হবে তা কবিতা ভাবতে পারেনি।
যাবার সময় যত কষ্ট হয়েছিল ফিরে আসবার সময় ততটা কষ্ট অনুভব হয়নি। মনে হচ্ছে তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে পারলাম। অবশ্য বুকের ভিতরে নীলের জন্য এত বেশি চিন্তা হচ্ছে মেয়েটা হোটেলে একা একা কি করছে ? ঘুম থেকে উঠেছে কিনা ? রাতে দু’জনই কিছু খায়নি। অনেক বেলা হল মেয়েটাকে খাওয়াতে হবে। ওর নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। মানুষের মন কি বিচিত্র। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে আর এমন করে নীলের জন্য ভাবতে হবে না। ঠিক তা নয় ভাবা যাবে না। হঠাৎ কবিতার মাতৃত্ব প্রখর হয়ে উঠল। না আমি পারব না। আমি নীলকে ছাড়া বাঁচব না। পালিয়ে যাব নীলকে নিয়ে ! নীল শুধুই আমার। নীলের প্রতি আর কারও কোন অধিকার নেই। কষ্ট আবেগ সমুদ্রে ডুব দিল। কষ্টের ভারে সমুদ্রের পানি উপচে চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল। একটা গাছ আঁকড়ে ধরে কবিতা কিছুণ কাঁদলো। কষ্টের সাী হয়ে গাছ-পালা বনের পাখি আকাশ, বাতাস আন্দোলিত হচ্ছিল। তারা যেন সান্ত্বনা দিয়ে বলল “কেঁদনা, এখন কান্নার সময় নয়, তুমি তো সব বুঝতে পারছ। নীলের কথা চিন্তা কর ও কিভাবে এসব সহ্য করবে। তোমার চেয়েও ওর কষ্ট আরও বেশী।” চোখ মুছে আবার হাঁটতে শুরু করল কবিতা। হোটেলে ফিরে দেখল নীল ঘুমাচ্ছে। বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কবিতার মনে হল ‘নীল আমার আমানত’, আমানতের খিয়ানত যে বড় পাপের কাজ। আজ নীল নীলের আসল ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। এই তো আমার পরম পাওয়া। বুকের রক্তে তিল তিল করে আমি নীলকে মানুষ করতে পেরেছি। আর কয়দিন বা বাঁচব। ও যেভাবে হোক চলে যাবে। এরপর কবিতা নিজেকে সামলে নীলকে ডাকলো-নীল, নীল ওঠ্ মা, বেলা হয়েছে অনেক।
কাঁদদে কাঁদতে নীল ঘুমিয়ে পড়েছিল। মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
-মা তুমি আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে ?
নীলের এ কথায় কবিতার ভিতরে সব নড়ে চড়ে উঠল। যেন দরজা, জানালা, ছাদ, দেয়াল ধসে মুহূর্তের অট্টালিকা ধুলায় মিশে গেল। সমুদ্র চলকে আবার চোখের পাতা ভিজে গেল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
: একটু কাজ ছিল, নে ওঠ। হাত মুখ ধুয়ে নীচে চল। কাল রাতেও কিছু খাসনি। নাস্তা করে আসি।
: আমার নীচে যেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি খাবারের অর্ডার দাও। বলো রুমে দিয়ে যেতে।
খাবারের অর্ডার দিয়ে বিছানায় নীলের পাশে বসল কবিতা। নীল উঠে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে ব্রাশ করতে করতে প্রশ্ন করল-
: মা, আমরা এখানে কতদিন থাকব ?
: কেন ?
: না তুমি তো আমাদের সাথে সব জিনিস গুছিয়ে এনেছ। আমরা কি অনেক দিন থাকব ? ঐ বাড়িতে আর ফিরে যাব না ?
ওর কথা কবিতার কানে গেল। কিন্তু কবিতা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। নীল গায়ে হাত দিয়ে মা মা বলে ডাকলে আবার সম্বিত ফিরে পেল কবিতা।
: আচ্ছা নীল ! যদি এমন হয় আমি হারিয়ে যাই।
: মা ! ওমা ! তুমি কেন একথা বলছ ? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না মা। তুমি এমন করে কথা বলো না।
নীলের গলা ধরে এসেছে। কবিতা ওর মাথায় হাত দিয়ে ওকে বুকে টেনে নিল। এমন সময় দরজায় বেল বাজল। খাবার এসে গেছে। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল।
নীল : মা তুমি আমাকে খাইয়ে দাও।
: আচ্ছা উঠে বস।
নাস্তা খাবার পর মা-মেয়ে দু’জনে বারান্দায় গিয়ে বসল।
: নীল আমি কিছু কথা বলব।
: বল মা।
: তোকে আমি স্কুলে পাঠাতে পারিনি। এতে কি তোর মনে কোন কষ্ট আছে।
: আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি ? জেনে রেখ মা তুমি আমাকে যত বই পড়িয়েছ এত বই আমার বয়সি মেয়েরা কেউ পড়েনি।
: আমি জানি মা, তারপরও বললাম। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা থাকে যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে না, যুক্তি থাকে না। কেমন যেন অচেনা অজানা ঘটনা ঘটে। অনেক যুদ্ধ হয় যে যুদ্ধে মা সন্তানকে হারায়। সন্তান বাবা-মাকে হারায়। আবার কেউ কেউ সব হারায়। এই যে নাটক, নভেল, কবিতা, গান-এগুলো সবই কিন্তু আমাদের জীবনের ছাড়া ছাড়া ঘটনা। এই যে, আমরা মা-মেয়ে আছি। এমনতো হবে এক সময় আমাদের আলাদা থাকতে হবে। যেমন আমিও তো এক মায়ের মেয়ে। কিন্তু তাই বলে কি আমি আমার মায়ের সাথে আছি। আমি তোকে আগেও বলেছি আবারও বলছি কোন ঘটনার জন্য বারবার কষ্ট পাওয়া বোকার কাজ। তবে এটা ঠিক মানুষের প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে কষ্ট হয়। আবার এটাও ঠিক মানুষ সব কষ্টই সইতে পারে।
: আচ্ছা মা এমনও তো হতে পারে, আমি তোমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলাম। তখন কি তুমি কষ্ট পাবে না।
প্রথম কথাটা শুনেই কবিতার ভেতরে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল। সে আসলে বুঝতেই পারিনি মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে। ও এ কথা বলতে পারে।
: কষ্ট ! তোর কি মনে হয় আমি পাব না ? কিন্তু তারপরও সব কিছুই আমাদের মেনে নিতে হবে।
আচ্ছা যাক আমি বাইরে বেরুবো।
: আমিও তোমার সাথে যাব মা।
: না পাহাড়ী রাস্তা তুই হাঁটতে পারবি না। আর আমিও তোর কষ্ট সহ্য করতে পারব না।
কিছুণ থেমে কবিতা আবার বললো ফোন আসলে রিসিভ করিস।
হাত ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল কবিতা। ইচ্ছা ছিল শেষ বারের মত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা মঙ্গল রাজটিকা দিয়ে আসব। কিন্তু সাগর উপচে আবার যদি চোখের পাতা ভিজে ওঠে এই ভয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এল কবিতা। হোটেলের কাউন্টারে এসে কবিতা দেখল তেমন কোন লোকজন নেই। তাই সুবিধাই হল।
: এক্সকিউজ মি, আমি কি একটা কল করতে পারি।
: ইয়েস, ম্যাম।
নাম্বার চেপে ডায়েল করতেই হাত পা সব হিম হয়ে এল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম
: হ্যাঁ কখন এসেছ ?
: সকাল ৭টায়। তুমি কোথায় ? কখন দেখা হবে ?
: আস্তে বাবা। এত প্রশ্নের উত্তর কি এক কথায় দেওয়া যায়। আর ‘তুমি’ না বল তোমরা কোথায় ?
: সরি। আসলে তুমি তো মেয়েটার কথা মনে রাখবার মত কোন সুযোগ আমাকে দাওনি।
: তাই বুঝি আমার উপর খুব রাগ।
: তুমি এমন করে বলতে পারলে। আমি তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারি।
: আচ্ছা তুমি কি বুড়ো হয়ে গেছ ? চুল কি অনেক সাদা হয়ে গেছে।
: ধীরে বাবা ধীরে। একটু পরে তো দেখা হবে। রাগ করো না বলছি। চুল প্রায় সব পাকা। তুমি দেখতে কেমন হয়েছ ?
: আমি আগের মত আছি। তবে আগে আমি ‘আমি’ ছিলাম আর এখন মেয়ের মা।
: তোমার সাথে কতদিন পর দেখা হবে ?
: এভাবে বলো না। শুধু ভাব তোমার মেয়ের সাথে দেখা হবে। ও তোমাকে কিভাবে গ্রহণ করবে।
: তুমি কি ওকে কিছু বলেছ।
: না নিজের পরিচয় নিজের মুখেই দিও। আচ্ছা কাগজ-কলম নাও আমার ঠিকানা লিখে নাও। এখন থেকে আধা ঘণ্টা পর রওনা হবে।
: ওকে।
: ওকে ভাল থাক। বাই।
ফোনটা রেখে ধন্যবাদ জানিয়ে কাউন্টারে দু’টি খাম দিয়ে কবিতা বলল-
: একজন লোক এসে আমার কথা বললে তাকে এই খাম দু’টো দিবেন। আর আমার রুমে ফোন দিয়ে দিবেন।
: ওকে ম্যাম।
: আমার ব্যাগটা।
: এই যে ম্যাম।
: থ্যাংক ইউ।
: মাই প্লেজার।
ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল কবিতা। চোখের পাতা বারবার ভিজে যাচ্ছে। হাত-পা অবস হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সামনের দিকে আর এক পাও এগুতে পারবে না। কিছু দূর গিয়ে একটা গাছ ধরে নীচে বসে পড়লো। মনে হল আকাশ, নদী, পাখি সবাই বলছে তুমি যেও না। নিজেকে এত কষ্ট দিও না। মনের সাথে লড়াই করতে করতে অশ্র“সিক্ত নয়নে আবার হাঁটা শুরু করলো, শাড়ি বার বার পায়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। মনটা পড়ে আছে হোটেলে। মনে হচ্ছে ‘একবার যদি তার বুকে আঁছড়ে পড়তে পারতাম তাহলে মনে হয় সব কষ্ট পানি হয়ে যেত’।


আধঘন্টা সময় শেষ। ট্যাক্সি নিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে গেল বাদল। কাউন্টারে কবিতার নাম বলতেই দুটো খাম এগিয়ে দিল। একটির উপর বাদলের নাম ও অন্যটার উপর লেখা নীলম মায়া- এটা মেয়ের নাম। বিষয়টি বাদল ঠিক কিছু বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করল-
ঃ ম্যাডাম কোথায়?
ঃ সকালে ফোনে কথা বলে খাম দুটো দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেছেন। অবশ্য আপনার কথা বলে গেছেন।
উনি কোথায় গেছেন তা আপনারা জানেন না।
সরি, এটা ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
সাথে কেউ গেছে নাকি একা।
জী উনি একা গেছেন, ওনার মেয়ে রুমে আছেন।
আমার মাথা ঘুরে গেল, সারাজীবন এই মেয়েটা আমাকে কষ্ট দিল। কোথায় গেল? আমাকে আসতে বলে নিজে হারিয়ে গেল। আকাশ পাতাল কিছু ভাবতে পারছিলাম না। পাশের সোফায় কিছুণ হতবুদ্ধির মত বসেছিলাম। এরপর চিঠির কথা মনে হল। খামটা খুললাম--

আজ কত দিন মাস বছর পর তোমায় লিখছি সে হিসেব নাই বা করলে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ আমার নিত্য চিঠির একটা, মনে মনে আমি প্রতিদিন তোমায় লিখি। তাই সম্বোধন ছাড়াই লিখছি। তুমি আমার অসীম মহাকাশ। তুমি আমার আরাধনা। আমি তোমাকে সাধনা করি। স্ত্রী বিয়োগের পর তুমি যদি আমায় গ্রহণ করতে চাও সেই ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তোমার আমার সম্পর্কতো ঐ চার দেওয়ালের আবদ্ধ ঘর না। তুমি আমার মুক্ত বিহঙ্গ। গোর্তা খাওয়া ঘুড়ি। কিন্তু তবু সেই মুক্ত জালে ভালোবাসার টান আছে, আছে প্রেমের মধুরতা।
মেয়েটাকে নিয়ে বাড়িতে থাকতে পারব না। এতে বাবা মা আপত্তি করবেন এবং তোমার ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। যদি অন্যায় করে থাকি তবে মা করে দিও। যোগাযোগ রাখিনি যদি মেয়েটাকে চেয়ে বস সেই ভয়ে। এই ১৭ টা বছর আমার ঐ মেয়ে ছাড়া আর কিছু ছিল না। ওকে আমি নীল বলেই ডাকি। কিভাবে এতদিন কাটালাম তা তোমায় বলব না। এটুকুই শুধু আমার হয়ে থাক।
প্রথমে একটা আর্ট স্কুলে চাকরি নিয়ে একটা ফ্যাট বাড়ির দুটো রুম নিয়ে প্রায় ৭ বছর ছিলাম। মেয়েটাকে স্কুলেও ভর্তি করাই। মেয়েটা কেজীতে উঠলে স্কুলে ওর পূর্ণ ঠিকানা চেয়ে বসে। আমি তোমার নাম লিখি। কিন্তু একদিন এক প্রতিবেশী এসে জোর করে নীলের বাবা সম্পর্কে জানতে চায়। আমি ভয়ে কিছু বলতে পারি না। পরে শহর ছেড়ে বস্তির গলির মুখে বাসা ভাড়া করলাম। দিনে দিনে নীল বড় হতে লাগল। ওর স্কুল পরিবর্তন করলাম। নবম শ্রেণীতে উঠলে একদিন স্কুল থেকে ডাক পড়ল। নাম রেজিস্ট্রেশন করার জন্য। সেদিন সারা রাত আমার ঘুম হল না। ভাবলাম মেয়েটা সারাজীবন মায়ের নাম হিসাবে আমার নাম ওর সার্টিফিকেটে বহন করে বেড়াবে। এত বড় প্রবঞ্চনা আমি করতে পারি না। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে মেয়েকে স্কুল ছাড়ালাম। আজ প্রায় ৩ বছর ও ঘরে বসে আছে। তবে নীলের ছবি আঁকার হাত খুব ভাল, ও এত সুন্দর ছবি আঁকে যে আমি নিজেও অবাক হয়ে যাই। দিন যত পার করছি ততই প্রশ্ন জাগছে মনে। আর কত কাল আমি ওকে আগলে রাখতে পারব। কিছুদিন পর ওর বিয়ে দিতে হবে। তখন বাবার কথা জানতে চাইবে লোকে। আমি কি বলব? হাজার প্রশ্নের একটাই সমাধান মিলল। আমি যদি মেয়েটাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিই। নীল আমার আমানত। তাকে তার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়াই আমার সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হল,
তোমাকে অনেকবার ফোন করতে চেয়েছি। কিন্তু কেন জানি পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল নীল ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। অনেক কষ্ট করে ফোন করলাম। কথায় কথায় তুমি বললে আমিই তোমার মেয়ের কথা তোমাকে মনে রাখতে দিইনি। আসলে সত্যিই আমি কেমন স্বার্থপরের মত নীলকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার নিজের উপর নিজের বিশ্বাস নেই। যদি তোমাকে দেখে আমার আবেগ ধরে না রাখতে পারি। নীল এখন নীলের আসল পরিচয় জানবে। এর মাঝে আমি থাকলে মানায় না, নীলের আসল মায়ের পরিচয় জানার পর আমার কথা জানতে চাইলে বলো আমি নীলকে চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরে ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরিয়ে দিয়েছি। এতে করে আমার উপর ওর একটু একটু ঘৃণা জন্মাবে। সন্তান কখনও মা বাবার এ ধরনের সম্পর্ককে সহজভাবে মেনে নেয় না। সন্তান মা বাবার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সন্তানের মঙ্গলের জন্য তার সুখের জন্য একটু একটু মিথ্যা বলতে হয়। আমার আসল পরিচয় জানতে পারলে ও খুব কষ্ট পাবে। ও তখন তোমাকে মানতে পারবে না আবার আমাকেও দোষারোপ করবে। হয়ত ওর মায়ের খুনি হিসাবেই আমাকে চিহ্নিত করবে। তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ ওকে আমার আসল পরিচয় দিও না। কেউ না জানুক তুমি তো জান আমি কখনোই তোমার সংসারের অমঙ্গল কামনা করিনি।
কিভাবে তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম তা আজ আমি স্পষ্ট করে বলতে পারব না। শুধু জানি তুমি আমায় একটু একটু করে হরণ করে নিচ্ছিলে। তোমার শাসন, ভালোবাসা, মান অভিমান আমায় এত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, আমার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। তুমি আমার রাজা, শুধুই আমার রাজা। কিন্তু তুমি এখন নীলের বাবা। নীলের বাবার সাথে আমার দেখা হবে না। এখন থেকে নীলের বাবা শুধুই নীলের জন্য।
ভাল থাক। শুধু নীলের জন্য ভাল থাক। আমাকে খুঁজো না। হারিয়ে যাওয়া পথের মাঝে আর যদি পথ খুঁজে না পাই তোমায় ডাকব, সেদিন কি তুমি আসবে? সেদিনের প্রতীায়- ইতি আমি
চিঠি পড়ে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার এখন কি করা উচিত তা বুঝতে পারছিলাম না। কিছু সময় বসে থাকার পর নীলের কথা মনে হল। কাউন্টারে এসে ফোনে নীলকে চাইলাম। বললাম তোমার মায়ের একটা চিঠি আছে। সেটা তোমাকে দিতে চাই। ও আমার পরিচয় জানতে চাইলে বলেছিলাম দেখা হলে পরিচয় বলব, কিছু সময় অপো করার পর ও নীচে নেমে এল।
মা চলে যাবার পর নীলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট হচ্ছিল যে বিছানায় উপুড় হয়ে কিছু সময় কেঁদেছিল। মনে হচ্ছিল কি যেন একটা ঘটনা ঘটছে। মা কি যেন লুকাচ্ছে। বেশ কিছু সময় পার হবার পর গোসল করে বারান্দায় বসেছিল। তারপর ফোন এল, চুল আঁচড়ে নীচে নেমে কাউন্টারে গিয়ে লোকটার সাথে দেখা হল। উনি প্রথমে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর একটা খাম দিলেন হাতে। খামের উপরে মায়ের হাতের লেখা। শুধু নীলের নাম লেখা। চিঠিটা দেখে খুব অবাক হয়ে ভাবল - মা কেন আমাকে লিখবে। মা তো আমাকে কোন দিন চিঠি লেখেনি। আজ কি এমন প্রয়োজন পড়ল চিঠি লিখল। খাম খুলে চিঠিটা বের করতে হাত কাঁপছিল নীলের।

মা,
এই প্রথম আমি তোমায় লিখছি। আমি জানি আমার উপর তোর অনেক অভিমান জন্মেছে। আর হবে নাই বা কেন? না হলেই বরং কষ্ট পেতাম। আমার এত দিনের সাধনা ব্যর্থ হত। যে লোকটা তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন উনিই তোমার বাবা, উনার কোন দোষ নেই। আমিই তোমাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তোমার বাবা তোমাকে অনেক খুঁজেছিলেন। কিন্তু আমি তোমার বাবার সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। উনি যদি তোমাকে নিয়ে নেন তাই যোগাযোগ রাখিনি। বাবাকে বাবা বলে ডেক। তার অনেক কষ্ট। নিজের প্রতি যত্ন নিও। বাবাকে ভুল বুঝ না। ভাল থাক। সুখী হও। আমি চলে গেলাম। ইতি তোমার মা
চিঠিটা একবার দু’বার, তিনবার পড়লো নীল। তবু এর সঠিক অর্থ যেন তার কাছে পরিষ্কার নয়। হঠাৎ লোকটার কথা মনে হল। ‘লোকটা আমার বাবা, মা আমাকে বাবার কাছ থেকে কেন চুরি করে এনেছিলেন। আর এখনই বা কেন চলে গেলেন। মায়ের সাথে বাবার কি তাহলে কোন মনোমালিন্য হয়েছিল। কিন্তু মা তো কখনও বাবা সম্পর্কে কোন খারাপ কথাও বলেনি। এখানে বাবা আসবেন তাওতো আমাকে কিছু বলেননি। লোকটা কি আসলে আমার বাবা? মাও চলে গেল। তাহলে আমি কাকে বিশ্বাস করব? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ টলমল করে জল ছাপিয়ে পড়েছে তা নীলের খেয়াল নেই। নীলকে কাঁদতে দেখেই লোকটা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। নীল লোকটার উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিজকে সামলাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ আবেগ যেন আরও বেশী করে তার গলা চেপে ধরছিল। কান্নায় যখন নীল ভেঙ্গে পড়েছিলো। সে সময় লোকটা হাত ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। লোকটা ধীরে ধীরে নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। একটু শান্ত হলে লোকটা বললেন, কেঁদনা, আমি আছি।
কথাটা বুকের মাঝে বেজে উঠল- ভালোবাসার মানুষগুলো কি হাত বদলে কাছে আসে। যে লোকটাকে আমি কোন দিন দেখিনি সে আজ হঠাৎ পিতৃত্বের দাবি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার ভাল মন্দ সেই সব দেখবে। আর এতদিন যে মায়ের কোলে বড় হয়েছি তাকে কোন দিন দেখতে পাব না। লোকটা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমার পাশেই চলে এলেন। নীলও ভিতর থেকে সাড়া অনুভব করলা। বাবা বলে চিৎকার করে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। বাদল গভীর মমতায় মেয়েকে বুকে তুলে নিলেন। এরপর বললেন, তাহলে শোন মা সেই গল্প-
আজ থেকে ২০ বছর আগে তার সাথে পরিচয় হয়। কি একটা কাজে সে আমার অফিসে এসেছিল। প্রথম দিন তেমন গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শোনা হয়ে ওঠেনি, ধীরে ধীরে পরিচয় হল। একটু একটু ঘনিষ্ঠতা হল। কোথায় যেন বেঁধে গেলাম। তার সাথে কি কথা জানি না। কিন্তু বলতে ইচ্ছা হত।
রাত দিন সকাল বিকেল কিছুই মানতে ইচ্ছা করত না। ছোট বেলা থেকেই আমি বাউন্ডলে স্বভাবের। বাঁধন আমার পছন্দ না। পরিবার আমায় টানে না। কেমন করে যেন এইচএসসি পাস করার পর এক প্রকার ঝোকের মাথায় বিয়ে করে ফেললাম। ৭ বছর সংসার করেছি। স্ত্রীকেও অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার বাউন্ডুলে স্বভাবটাই আমাকে আদর্শ স্বামী হতে দেয়নি। আমার দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছা করত না তা নয়। কিন্তু আমি পারতাম না, আমার স্ত্রী অবশ্য আমাকে বুঝত। এর মধ্যেও তার প্রতি আমার মোহ আমি কাটাতে পারছিলাম না। কেন যে এমন হচ্ছিল তা আমি বোঝাতে পারব না। সে সামনে আসলে আমার পৃথিবী বদলে যেত। মনে হত এই মেয়েটা আমার একান্ত আমার। কথা বলতে বলতে কখন যে দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেললাম তা বলতে পারব না। তার প্রতি আমার ভালোবাসা আমাকে পাগল করে রেখেছিল। চারপাশ আমার কাছে সব অর্থহীন মনে হত। ও আমাকে পাগলের মত ভালোবাসত। আমাদের ভালোবাসায় একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ও আমাকে সব সময় আমার সংসারের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। কিন্তু দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। যোগাযোগ না থাকলে মনে হত আমার পৃথিবী ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সাত বছর সংসার করার পর ’৯১ এর ১৪ আগস্ট আমার ঘর আলো করে এক সন্তান এল। বউটা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলল বাচ্চার পজিশন ভাল না। অপারেশন করতে হবে। কিন্তু বউটা কোন মতে রাজি হল না। মেয়েটা হবার পর বউটা আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তার অনেক চেষ্টা করেও বউটাকে বাঁচাতে পারল না। বউটাকে নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত ছিলাম যে, মেয়েটার কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। নার্সের সেবায় ওর ৪ দিন কেটে যায়। ১৮ তারিখ বিকেল ৫টায় তোর মা মারা যায়। লাশ নিয়ে বাসায় আসার সময় তোকে ওই গ্রহণ করল। আমার তখন মাথার ঠিক নেই। যাবার সময় ও আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলল
ঃ তোমার মেয়েটাকে নিয়ে যাব।
ঃ তুমি সত্যি আমার মেয়েটাকে নেবে।
ঃ যদি তুমি দাও
ওর কথায় কোন উত্তর আমি দিতে পারিনি। চোখের পাতা কাঁপছিল। শুধু মেয়েটার কপালে একটা রাজটিকা এঁকে দিলাম। আজও বলতে পারব না মেয়েটা দেখতে কেমন। কিছুদিন পর ওর বাড়ি গিয়ে শুনলাম ও কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চাকরির নাম করে চলে গেছে এবং এরপর আর কারও সাথে যোগাযোগ রাখেনি। মেয়েটার ব্যাপারে ওরা কেউ কিছু বলতে পারল না। ১৭ বছর ধরে খুঁজেছি। কত জায়গায় গিয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। অবশ্য প্রতি বছর আমার জন্মদিনে একটা লাল গোলাপ পেতাম। আমি জানি ও পাঠাত। কিন্তু ওদের কোন খোঁজ পেতাম না। আমি শহর ছেড়ে কখনও কোথাও যাইনি। যদি ও ফিরে এসে আমায় না পায়। গত দু’দিন আগে একটা ফোন এল।
ঃ হ্যালো
ঃ চিনতে পারছ আমায়।
ঃ কে বলছেন?
ঃ আমি।
ঃ কেমন আছ? তুমি কোথায়?
ঃ ভাল আছি, মেয়েটার কথা মনে আছে?
ঃ মনে আছে। আমি তোমাদের কত খুঁজেছি। আমার মেয়েটা কেমন আছে? কত বড় হয়েছে?
ঃ আস্তে। তোমার মেয়ে ভাল আছে।
ঃ আচ্ছা তুমি কেমন বলেতো। আমার বুঝি মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা জাগে না। কোন যোগাযোগ কেন রাখলে না আমার সাথে।
ঃ আমি তোমার মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে যায়নি। ওতো আমার আমানত। তুমি যদি ওর সাথে দেখা করতে চাও তাহলে সিলেটে আস। কবে আসবে?
ঃ তুমি বল
এর পর দিন তারিখ সময় সব ও বলেছিল। বাকি সময় আমার যে কিভাবে কেটেছে তা আমি বোঝাতে পারব না।

হোটেল থেকে বেরিয়ে পল্লীতে আসতে আসতে কত জায়গায় যে কবিতার পথ হারিয়েছে তার ঠিক নেই। তার কান্নার সাী শুধু এ বনের বৃ লতা। আজ দিনটা পল্লীতে থাকবে কবিতা। বিকেলে গোপনে হোটেলে এসে সব কিছু জানতে হবে। বলা তো যায় না, মেয়েটা যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে তখন তো সামনে যেতেই হবে। কোন হোটেলে উঠলে ওরা খোঁজাখুঁজি করলে পেয়ে যাবে। তাই পল্লীতে আশ্রয় নেয়া। একটা রাত না পার হলে মেয়েটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না কবিতা। ওদের দু’জনের টিকিট খামে ভরে কাউন্টারে রেখে এসেছে। আগামীকাল সকাল ১০টায় ট্রেন, ততণ সবাই এক শহরে থাকবে।

মেয়েটা শান্ত হলে বাদল তাকে নিয়ে রুমে এসে বসল।
বাবা প্রশ্ন করলেন
ঃ মা কখন গিয়েছেন?
ঃ সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে।
ঃ তোমাকে কিছু বলে গেছেন মানে কোথায় গিয়েছেন সে সম্পর্কে।
ঃ না আমাকে কিছু বলেনি। এমনকি তোমার কথাও কিছু বলেননি।
ঃ আচ্ছা তুমি রুমে থাক। আমি আশপাশের হোটেল মোটেলগুলো খুঁজে আসি। অবশ্যই অন্য কোন হোটেলে উঠে থাকবে। সাড়ে ১০টার পর এখন পর্যন্ত আর কোন ট্রেন আসেনি।
রুম থেকে নেমে আসার সময় কাউন্টার থেকে দুটো টিকিটওয়ালা খাম ধরিয়ে দিল। দেখলাম ট্রেন আগামীকাল ১০ টায়। আমার মনে হল তাহলে ও এখানেই আছে। আশেপাশের কোথাও। অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে দুপুর দেড়টায় এসে দেখি নীল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ঃ মারে, তোমার মাকে, কোথাও খুঁজে পেলাম না।
ঃ তুমি সবখানে খুঁজেছ।
ঃ আমার সাধ্যমত খুঁজেছি।
বিকেলে কবিতা হোটেলে এসে দূর থেকে দেখলো রুমের যে ছোট বারান্দা আছে সেখানে বাবা -মেয়ে বসে আছে। হোটেল থেকে কিছু তথ্যও পাওয়া গেল। সব দেখেশুনে মনে মনে শান্তি পেলাম। পল্লীতে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।
সকাল ৮.৩০ টায় স্টেশনে এসে সিগনাল রুমে একটা জায়গা করে কবিতা ওখানেই অপো করছিল। ওরা স্টেশনে পৌঁছালো তখন ৯টা। নীলের বাবা হয়ত জানত যে কবিতা স্টেশনে থাকবে। তাই ও বারে বারে চারদিক তাকাচ্ছিল। নীলকে দাঁড় করিয়ে রেখে চারপাশে ঘুরেও আসল।
যথাসময়ে ট্রেনটা পৌঁছাল। বাবা-মেয়ে ট্রেনে চেপে বসল। দূরে একটা নাম না জানা পাখির করুণ রোদন ভেসে আসছিল। কু ঝিক্ ঝিক্ করতে করতে কবিতার বুক চিরে নীলকে নিয়ে দানব ট্রেনটা হারিয়ে গেল ঐ নীল সুদূরে।

১০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×