অনুশোচনা
চৈত্রের ক্লান্তিময় দুপুর। হঠাত ফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। অপরিচিত নাম্বার।রিসিভ করার সাথে সাথে হাসি মুখে বলল কেমন আছেন, আলিফ ভাই। মেয়ে কণ্ঠের আওয়াজ শুনে কিছুটা অন্য রকম অনুভুতি লাগল।মনে অনেকটা পুলকিত উৎফুল্ল হলো বটে ভাব জাগল মনে।দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম অনেকটা। আরো নামও জানে। কিছুটা স্থির হয়ে উত্তর দিলাম।
জ্বি অনেকটা ভাল।
কে বলছেন পরিচয় দিন।
বলল আমি রুমা আপনার ফেসবুক বন্ধু। এর পর অনেক আলাপ হল।বি-বাড়িয়া কলেজে পড়ে। শেষ জিজ্ঞাসা করলাম আপনার বাড়ি কোথায় ?
বলল বি-বাড়িয়া।
রুমা কলেজে পড়ে টগবগে তরুণী,বয়স ২০-২১ হবে।খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে তা নয়,অনেক সুন্দর ভাবও আছে। যা যে কোন সম বয়সিকে আকৃষ্ট করার মতো। মার্জিত স্মার্ট। ঐ দিন থেকে প্রতিদিন বন্ধুর মতো কথা বলে। বলে নানান গল্প , বলে জীবনের যত ছোট বড় ঘটনা, যত পারিবারিক সমস্যা ।পরিবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনেক ঘটনা। ভাই ভাবীদের নানা নির্যাতন কথা।
......
বয়সে আলিফ ওর থেকে অনেক বড়,তারপরও কথা হয় সমান তালে। সম ভালবাসায়।
আলিফ বিবাহিত তা আলিফ তার কথার ভাব বুঝে তা বলে দেয়। আলিফও তার বিস্তারিত বিষয় উপস্থাপন করে সহজ সরল ভাবে তাতে কোন শঠতা প্রবঞ্চনা আশ্রয় নেয়নি, ছিল না তার খারাপ উদ্দেশ্য।কিন্তু তাতে তার অনেকটা মনফুত হলো না ভালবাসার আবেগে।অনেকটা বিশ্বাস করেনি মন থেকে । আর বয়স কম বলেই এই আচরণ, তা আলিফ প্রথম থেকে বুঝে।তাই সেই রুমাকে ঐ ভাবে গাইড করে। কিন্তু ভালবাসা থেমে নেই,দীর্ঘ দুই বছরের মত এভাবে চলে ফেবুর ইনবক্সে,কখনো ফোনে।
...
এর মধ্যে ঘটে যায় অনেক ঘটনা।ভাবীর দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার যত বর্ণনাক,শত নির্যাতনের করুণ ব্যাখ্যা।একদিনের কথা বলি, ভাবী চা খাবে বলে রুমাকে বলে, রুমাও যথা নিয়মে চা প্রস্তুত করতে যায়।চা আনতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবী এগিয়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে গরম চায়ের পুরো পানি তা হাতে ঢেলে দেয়,এতে তার হত জ্বলসে যায়।যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে।কি যন্ত্রণা তা বুঝানো যাবে না।আলিফের সাথে এ জন্য দুই দিন কোন কথা হয়নি।দুই দিন ফোন না দেয়াতে আলিফ চিন্তিত হয়ে পড়ে।আলিফ ফোন দিলে বিস্তারিত বলে।বিস্তারিত জানার পর আলিফ পরামর্শ দেয় আত্মীয় স্বজন কে জানতে।সেই বলার আগে চাচা জেনে বিস্মিত হতবাক হন এবং নিজে গিয়ে বিষয়টা মীমাংসা করে দিয়ে সতর্ক করে দিয়ে আসে তার ভাবীকে।বিষয় গুলো শুনে আলিফ রুমাকে জিজ্ঞাসা করে নানা ভাবে।কি কারণে এ রকম হচ্ছে?
রুমা অনেক ক্ষণ চুপ থেকে বলল, ভাইয়া বিদেশে থাকে ভাবীর সাথে এলাকার এক ছেলের সাথে পরকীয়া আছে তা আমি জেনে গেছি তাই। আলিফ রুমার কথা শুনে আরো বেশী আতংকিত হলো,মনে মনে ভাবছে সামনে তার আরো বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা আছে। তাই তাকে সতর্ক করে দিলো।যে ভাবনা সেই কাজ।
পরের দিন সকালে ভাবী রুমাকে ঘরের মধ্যে আটকিয়ে রাখে, সাথে তার মাকেও । আর কথা হয় না রুমার সাথে আলিফের।খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে আলিফ ফেসবুক ইনবক্সে ইনবক্স করে উওর পায় না আলিফ,ফোনও বন্ধ। খুব চিন্তিত আলিফ ভাবছে নিশ্চয় কিছু হয়েছে।
...
একদিন কথার পাকে বলেছিল রুমা তার খুব কাছের বন্ধু সাদিয়া তার সাথে অনেক কিছু শেয়ার করে। পাশাপাশি বাড়ি।ফেবুর বন্ধু তালিকায় ঢুকে তার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে আলিফ কিন্তু হতাশার বিষয় সাদিয়া মাঝে মধ্যে ফেসবুকে আসে রেগুলার নয়! তারপরও ফেসবুকে ইনবক্স করলো আলিফ এক দিন দুই দিন কোন উত্তর নেই।কিছু দিন পর হঠাৎ ইনবক্স ঢুকে দেখি রুমা ইনবক্স করেছে এবং বলল সেই খুব অসুস্থ্য,আপনাকে একবারের জন্য দেখতে চাই। বন্ধুর বিপদের কথা শুনে অনেকটা কেদে ফেলেছে আলিফ কি করবে কি হয়েছে?
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল আলিফের!
বিস্ময়ে সহিত দেখল কে ফোন করেছে!অচেনা নাম্বার দেখে আলিফ প্রথম ফোন ধরলো না,পরের ফোনে ধরল।
উত্তর দিল আমি সাদিয়া বি- বাড়িয়া থেকে।মনে হলো জীবনের অনেক কিছু পেয়েছে,যা আগে কখনো পায়নি।শত শূন্যতা পূরণ হয়ে গেল।
সাদিয়ার সাথে কথা বলে অনেক কিছু বুঝলো আলিফ।কি ঘটেছে কি অবস্থায় আছে রুমা।সাদিয়াকেও রুমা বলেছে তার শেষ ইচ্ছার কথা।
আলিফ চিন্তা করছে , কিভাবে তার ইচ্ছা পুরণ করা যায়।কোন পথে কি করে ? সীদ্ধান্ত নিলো কিছুটা সুস্থ হলে রুমার সাথে কথা বলে সীদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
যথা নিয়মে ডাক্তারের চিকিতসায় দিনে দিনে ভাল হতে লাগল।অনেকটা হাটতে পারে।
আলিফ নিজের ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা যান। ঢাকায় অবস্থান কালে রুমার সাথে কথা হয় এবং দুই জনে মিলে সীদ্ধান্ত নেয়। মামার বাসায় বি-বাড়িয়াতে দেখা করবে আলিফ।
...
রুমার মামা একজন সহকারী শিক্ষক। থাকেন বি-বাড়িয়া শহরে।রুমা মামার বাসায় বি-বাড়িয়াতে মা সহকারে আশ্রয় নিয়েছে।সীদ্ধান্ত হলো মা মামি মামার সাথে কথা বলবে এই বলে যে , তার চিকিৎসার বিষয়ে একজন কন্সাল্টেন্ট আসবে বাসায় অথবা একজন সাংবাদিক আসবে তার ফেসবুক বন্ধু দেখতে। এই সুযোগে দুই জন দুই জনকে দেখবে।
......
আলিফ তার দীর্ঘ সময়ে তার সাথে বলা রুমার সমস্ত কথোপকোথন স্বরণ করছে ফিরছে সেই ফেলে আসা তিন বছরের অতীতে। অতীতে বলা কথা নানান আবদার , কিছু চাওয়া।দারুণ গল্প বলা , কতো অন্যায় আবদার। তার পড়া আমার লেখা কবিতা আবৃতি,মিষ্টি মিষ্টি করে অল্প অল্প কথা বলা ,রাগ অভিমান করা,ভাললাগা,যত অনৈতিক কথা।ছোটদের মতো আচরণ বলার ভঙ্গিমা শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে মাথা.আলিফের। তারসামান্য চাহিদা তার একটা ল্যাপটপের শখ ছিল,ছিল একটা ভাল ফোনের চাহিদা। ফোনে একটু আদর আর আদর মাখা কথা। খুব বেশি চাহিদা ছিল একটু চুমুর।জানা খুব ইচ্ছা ছিল বিবাহিক জীবনের যত ঘটনা।কিভাবে কি হয় বাসর রাতে ইত্যাদি।
......
কেন ভাবছে এমন আলিফ ? কেন?
কি জেনো শুন্যতা হৃদয়ে!শুধু হা হা কার বড় বড় নিশ্বাস,সব মিলে দমবন্ধ অবস্থা। খুব অস্বস্থিতি আলিফ।
বেশ কছু দিন রুমার সাথে যোগা যোগ নেই আলিফের,আলিফ নিজের পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ঢাকায়।কাছের চাপে ভুলে গেছে নিজের খুব কাছের বন্ধু কথা।ভুলে গেছে অতীতের সকল স্মৃতি।যত ভাগ করা দুখ সুখ রুমার সাথের,ভুলে গেছে রুমার চাওয়া তার শেষ ইচ্ছার কথা।
রুমার জ্বর হয়েছে জানতো না আলিফ কারণ যোগাযোগ নেই বেশ কয় দিন।জানতো না তার গ্রামের বান্ধবিরাও এবং কি পাড়া প্রতিবেশিরা। কারণ নির্যাতনে অসুস্থ্য হয়ে সেই আশ্রয় নেয় মামা বাসায় বি-বাড়িয়া শহরে।
...
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,সুস্থ্য হয়ে সামান্য জ্বরে সেই যে চলে গেলো না ফেরার দেশে। সকল শুভাকাঙ্গিকে কাদিয়ে, ক্ষুণাক্ষরে বুঝেনি তার আত্বীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশি।
জীবনের শেষ ইচ্ছাটা পুরণ করতে পারিনি আলিফের কাজ থেকে। খুব সামান্য চাওয়া ছিল আলিফের কাছে,সামাজিকতার ভয়ে পারিনি তাও আলিফ করতে। আলিফের ব্যস্ততা ভুলিয়ে দিলো রুমার জীবনের শেষ ইচ্ছা ,তার চাওয়া। আজ আর নেই রুমা। তা জানেনা আলিফ।
ব্যস্ততার চাপে খুলেনি আলিফ তার ফেসবুকও। তাই বুঝে উঠতে পারেনি তার প্রিয় বন্ধু করুণ হতাশা নিয়ে চলে যাচ্ছে না ফেরার রাজ্যে কথা।শুনতে পায়নি তার প্রিয় বন্ধুর আত্বনাদ হাহাকার।বুঝেনি তার অন্তিম ইচ্ছার কথা!তার শেষ বাণী।অন্ধকারে রয়ে গেল অনেক প্রশ্নের উত্তর।
...
আলিফ যখন ফেসবুক খুলে ঠিক ঐ মুহুত্বে বেশে আসে সাদিয়ার দেয়া ইনবক্স বার্তা। নেই রুমা এই পৃথিবীতে! সকলের মায়া, ইহকালের শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে চলে গেলেন পরকালে।পরম শান্তিতে ঘুমাবে বলে। আলিফ তুমিও পূরণ করলেনা তার সামান্য চাওয়া।
কি বয়স ছিল রুমার ? কি ছিল তার অপরাধ? কেনই বা চলে গেল সমাজ রাষ্ট্রকে কিছু না বলে?
সকল কেন এর উত্তর সমাজ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের কাছে রেখে গেল।সময় এক দিন বলবে কি ছিল রুমার ভুল, না আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নির্মমতার স্বীকার?
......
আলিফও অতীতের রুমার সকল কথোপকথন, তার চাহিদা কথা ভেবে,তার ইচ্ছার কথা ভেবে অনুশোচনায় দগ্ধ।নিজে ক্ষমা করতে পারছেনা কোন ভাবে নিজেকে। তার জীবনের তিন বছরের ফেসবুকিং জীবনের করুণ এবং নির্মম সত্য কে নিয়ে চলতে হবে তাকে আজীবন! বহিতে হবে রুমার চাওয়া সামান্য আবদারের কঠিন বোঝা!
অবশেষে আলিফ তার ফেসবুকে তাকে লেখা একটা কবিতা পোষ্ট করে।
অনূঢ়ার জীবন
.................
কতোনা সুন্দর এই পৃথিবী কতো মায়া মোহ
শুধু নিঃশ্বাসে ভর করে পার করে বছরকে বছর
তুমি কি জানো কবি ?
কিভাবে কাটে অনূঢ়ার প্রতিক্ষণ
কিভাবে নিভে যায় অনূঢ়ার জীবন?
জীবন প্রদীপ অল্প অল্প করে!
চাওয়া পাওয়া ছিল সামান্য একটু ভাল থাকা
নির্মল পৃথিবী কি দিয়েছে তা!
শুধু ইচ্ছে ছিল খেয়ে পরে থাকতে
নিয়তি দিয়েছি কি তা করতে।
সময়ের সাথে সময়কে করেছে পার
শুধু প্রাণ নিয়ে বেচে থাকার যুদ্ধে, কারো ভালবাসার সামান্য ছোঁয়ার
পৃথিবী কি দিয়েছে তা করতে?
স্বল্প সময় একটু একটু করে বেচে থাকতে!
বলেছিল অনূঢ়া,কবি
আজ সময় তোমার,কারণ আমি বেচে আছি সামান্য দম নিয়ে
তাই তুমি বুঝলে না দম না থাকলে কি হয়
কেমন বেদনা জাগবে মনে
দিলে না মূল্য আমার চাওয়ার!
তাই তুমি কৌশলে করলে প্রত্যাখ্যান।
ভেবোনা যখন আমি থাকবোনা এই ধরণীতে
দেখো কবি দেখো
তুমি হারাবে প্রাণ!খুঁজবে আমায় হন্যে হয়ে
এই নশ্বর পৃথিবীতে
শুধু কাদবে দেখতে আমায়!
তাতে থাকবেনা মোটেও দম
বুঝবে তখন অনূঢ়ার কি ছিল কষ্ট মনে
কি ছিল ভুল তোমাকে চাওয়াতে
তুমি কেন করলে প্রত্যাখ্যান? কেন ফিরিয়ে দিলে না অনূঢ়ার জীবন?
তোমার যতো ঋণ, তাতো ছিল অনূঢ়ার অন্তিম চাওয়া!
কবি
সমাপ্ত।।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ দুপুর ২:৫৯