স্কুল-কলেজের দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা 'গরিবের বন্ধু, জনদরদী, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা'। হাট-মাঠ-ঘাট, দোকান-পাট - সর্বত্র ছেয়ে গেছে একই লেখায় রঙিন সালাম ও শুভেচ্ছা, পোস্টারে ও ব্যানারে; নেতাটির।
অগণিত মা বোনেরা ইজ্জতের বিনিময়ে; লাখো মায়ের বুক শূন্য হবার বিনিময়ে; তিরিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে কেনা; নগদ রক্ত দিয়ে কেনা আবেগ ও ভালবাসার; প্রাণপ্রিয় লাল সবুজের দেশটির বিজয় দিবস আজ। কয়েক লাখ টাকায় বিজয়োৎসবের আয়োজন। পুব আকাশের সূর্য উঠেছে। কিন্তু তার আলো এখনো কুয়াশা ভেদ করে মাঠে হাজির হয়নি। কিন্ত শিশু থেকে বুড়ো সব বয়েসী মানুষের সমাগমে মাঠ ভরপুর। মেয়েদের কেউ লাল সবুজের পড়ে এসেছে। ছেলেরা গেঞ্জি। শিশুরা পতাকা সম্বলিত গেঞ্জি পড়েছে। গালে পতাকা এঁকেছে। কেউ মাথায় ফিতে বেঁধেছে। কেউ ক্যাপ পড়েছে। এমনিভাবে মাঠ ভরেছ। পুরো মাঠজুড়ে লাল সবুজের ঢেউ যেন বইছে।
জনতার সামনে, সুসজ্জিত মঞ্চে, ভিআইপি আসনে বসা নেতাটি গলা চেঁচিয়ে দারাজ কন্ঠে টেবিল ফাঁটিয়ে দিচ্ছে। "ঠিক ঠিক" ক্ষাণিক বাদে বাদে আকাশ পাতাল কেঁপে উঠছে জনতার সমস্বর ধ্বণিতে।
কি তার দেশপ্রেম! কি তার বক্তৃতা! নেতার বক্তৃতায় দেশপ্রেম, তার দেশপ্রেমে জনতা বিমুগ্ধ, শিহরিত। জনতার গগণবিদারী ধ্বণি এবং চোখেই পরিস্ফুট, মন যেন তাঁদের ছেয়ে গেছে বিষাদে। কেউ কেউ তো অতি আবেগতাড়িত হয়ে অশ্রুও ঝরাচ্ছে।"
কিন্তু একি আশ্চর্য! কাঁদছে অথবা কাঁদো কাঁদো ভাব সবার অথচ একটা লোকের মুখে হাসি! পাগল নয়তো আবার? লোকটিকে দেখে কিছু মানুষজনের সন্দেহ হয়। বক্তৃতা শোনে লোকটা হাসছে। কারণ তার স্মৃতিতে এখন শুধু এই মাঠ না, এই বক্তব্য না। তার চোখের সামনে শুধু উপস্থিত জনতা ও নেতাটি নয়। তিনি মনে মনে নেতার আজকের ছবি ও একাত্তরের ছবি মেলাচ্ছেন। মঞ্চে বক্তব্য দেয়া নেতাটির একাত্তরের ছবি লোকটার স্মৃতিতে আজো ভেসে উঠছে। এই নেতা তখনো ছিলেন নেতা। একাত্তরে সবাই যখন মৃত্যুভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল বা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল তখনো নেতাটি তার এলাকায় নির্ভয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কারণ উর্দু বলা, খাকি পোষাক পরিহিত নরপশুদের সে কখনো এ ওর গবাদি পশু এনে দিত; কখনো সুন্দরী তরুণীদের সন্ধান দিত। এভাবে সে তাঁদেরকে নানানভাবে সহযোগিতা করত বলে তখনো সে ছিল নেতা। লোকটা মনে মনে নেতার এই ছবি আর সেই ছবি মেলাচ্ছেন আর হেসে ফেঁটে পড়ছেন।
মানুষজন তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু জনতার বিস্ময়ভরা তাকানো লোকটার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় না। তার মনে ভেসে উঠছে ধুলো ধূসরিত, রক্তে রঞ্জিত একাত্তরের সেই বেদনাবহ স্মৃতি। পিতার সামনে মেয়ের ধর্ষিত হবার স্মৃতি; মায়ের সামনে সন্তানের বুক গুলিতে ঝাঁজরা হবার স্মৃতি। তার আরো মনে পড়ছে নেংটি পড়া বন্দুক হাতে তার বীরত্বগাঁথা যুদ্ধের স্মৃতি। এই ভেবে লোকটা একটু একটু কেঁদেও উঠছে। এই কান্না দেখে লোকটার পাশে থাকা মানুষজনের সন্দেহ দূর হল। সে যে পাগল, এবার তারা নিশ্চিত হল।
সেই পাগলদের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই প্রিয় মাতৃভূমি, লাল সবুজের প্রিয় বাংলাদেশের বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা তাঁদেরকে প্রাণভরে শ্রদ্ধা জানাই ও দয়াময় আল্লাহর নিকট দোয়া করি।