বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে বলেশ্বর ও হরিণভাঙ্গা নদের মধ্যবর্তী এলাকায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা বিশ্বের একক বৃহত্তম লবণাক্ত জলাভূমির বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া বিশাল এ সবুজের সমারোহ দেশের মোট আয়তনের ৪% ভাগ এবং সমগ্র বনভূমির ৪৪% ভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পরস্পর সংযুক্ত প্রায় ৪০০টি নদি-নালা ও খালসহ প্রায় ২০০ টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। অসংখ্য নদী-নালা আর সবুজ বৃক্ষরাজির এ বনাঞ্চলকে প্রকৃতি সাজিয়েছে অপরূপ সুন্দরীর সাজে। তাই হয়তো এর নাম সুন্দরবন। একদিকে বিশাল সবুজের সমারোহ,অন্যদিকে নীলের দিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন বৈচিত্র মানুষকে যেন সব সময় হাতছানি দি”েছ। নানা দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বলেই সুন্দরবন আজ বিশ্বখ্যাত। সুন্দরবনকে জাতিসংঘের তালিকায় বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের সমুদ্র উপকূল জুড়েও রয়েছে এ বন। গোটা সুন্দরবনের ৬২ ভাগ এলাকা ভারতের অন্তর্ভূক্ত। বনের মোট আয়তন ৪,০১,৬০০ হেক্টর। এর মধ্যে বাগেরহাট জেলার দু’টি রেঞ্জে মোট বনভূমির আয়তন ২,৪৩,০৪৭ হেক্টর। জেলার মংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার বিস্তৃত এলাকা নিয়ে এ বন পরিবেষ্টিত। সুন্দরবন সৃষ্টির ইতিহাস অনেক পুরাতন। ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে সুন্দরবনাঞ্চল জমিদারদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে তা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে নিয়ন্ত্রনে নেয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সুন্দরবনের কয়েকটি অঞ্চলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করে। এখানে ৩টি এলাকা জীববৈচিত্রেরহিসাবে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কটকা, কচিখালি ও সুপতি। বাগেরহাটে জন্য এ এক গর্বের বিষয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবনকে আরও আকর্ষণীয় তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় নি এখনও। কয়েক লক্ষ মানুষ এ বনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
জীববৈচিত্র এ পৃথিবীর এক অমূল্য সম্পদ। উদ্ভিদ বৈচিত্রের পাশাপাশি প্রাণীবৈচিত্রেরও সমাবেশ ঘটেছে এখানে। তবে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটছে এবং জীববৈচিত্র বিনষ্ট হচ্ছে । জীববৈচিত্র সংরক্ষণে বিভিন্ন কর্মকান্ড গ্রহনের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক অঙ্গীকার পালনে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।
সুন্দরবনের প্রধান পরিবেশগত বৈশিষ্টএর উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের ব্যাপক বৈচিত্রময়তা। এত বিচিত্র ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোন বনে দেখা যায় না। সুন্দরবনের বৃক্ষের বৈচিত্রের অবধি নেই। পাহাড় থেকে বয়ে আসা পলি মাটি এবং সাগরের লবণ পানির সাথে মিলেমিশে জেগে ওঠা ভূখন্ডে এখানকার এ সব বৃক্ষরাজি জন্ম লাভ করেছে। এদের প্রত্যেক গাছেরই বীজ রয়েছে এবং এ বীজ থেকেই নতুন গাছের জন্ম আর বংশ বিস্তার। এ সব বৃক্ষাদি ঝোপঝাড়, লতাপাতা দ্বারা আ”ছাদিত বলেই সুন্দরবন জঙ্গলাকীর্ণ। আর জঙ্গলাকীর্ণ বলেই নানা রকম জীব-জন্ত্রু নির্বিঘে বসবাস করতে পারে সেখানে। বিশ্বের আর কোন বনে সুন্দরবনের মত এ রকম বৈচিত্রতাপূর্ণ বৃক্ষলতা আর চোখে পড়েনা বলেই বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। সুন্দবনের বৃক্ষরাজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোল, সুন্দরী, গরান, পশুর, গেওয়া, বাইন, কাঁকড়া,ধুন্দল প্রভৃতি।
সুন্দরবনে কোন খাবার ফল হয় না। তবে অনেক ফুল ফোঁটে। তা সবই বনফুল। অভিজাত শ্রেণীর না হলেও, মধু তৈরীর ক্ষেত্রে এ সব ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। মৌমাছিরা এ সব ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে গাছের ডালে চাঁক বাঁধে। গভীর জঙ্গলেই বেশী মৌচাক দেখা যায়। বছরের নির্দিষ্ট মৌসুমে মৌয়ালরা এ সব চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। সুন্দরবনের মধু খুবই মান সম্মত। মধু এখন রপ্তাণী পণ্যের তালিকায় ¯’ান পেয়েছে। প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ হাজার মণ মধু বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা হ”েছ। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু বিদেশে খুবই সমাদৃত।
সম্প্রতি বাগেরহাটের উত্তর লোকালয়ে চিত্রা নদীর কূল ঘেঁষে সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে সুন্দরবন। গড়ে উঠেছে নতুন এক সুন্দরবন। প্রাকৃতিক ভাবে কয়েকশ’ একর জমির উপর গড়ে উঠা ঘন বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ এ নতুন বনাঞ্চল আর বৈচিত্রময় প্রাণীকূল দেখতে প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য পর্যটক। একটি জাতীয় দৈনিকের ¯’ানীয় প্রতিনিধি পঙ্কজ কুমার মন্ডল সর্ব প্রথম এ বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। সাংবাদিক পঙ্কজ মন্ডলের সাথে এ বিষয় কথা হলে তিনি জানান, গত ৫-৬ বছর ধরে তিনি এ বনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। এ বনের সাথে তার নিবিড় এক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। জীব বৈচিত্র ও পরিবেশের স্বার্থে এ বনাঞ্চলকে টিকিয়ে রাখতে তিনি সরকারের সংশ্ল্ষ্টি বিভাগের প্রতি আহ্বান জানান।
গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হবার পর সরকারের বন বিভাগ এ বনাঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষনের উদ্যোগ নিয়েছে। পর্য়টকদের জন্য এ বনাঞ্চলকে আকর্ষণীয় করে তোলার সকল উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও ইতিমধ্যে বন বিভাগের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। বনের রক্ষনাবেক্ষনের স্বার্থে এ অঞ্চলে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকবল নিয়োগ ও চৌকি বসাবার বিষয় ইতিমধ্যে বিভাগীয় ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ চলছে বলে জানিযেছেন, বাগেরহাট সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্ত্তা (ডিএফও) মো: হারুণ অর রশিদ মজুমদার। তাঁর মতে,বর্তমান সময় পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য বনাঞ্চল রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য। তিনি বলেন, প্রকৃতির দান এ বন ভূমিকে রক্ষার জন্য সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নেবে। শীঘ্রই এখানের বৃক্ষরাজি ও সম্পদ রক্ষার জন্য টহল বসানো হবে এবং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে, এখানে দৃষ্টি নন্দন চিত্রল হরিণ,বানরসহ বিভিন্ন প্রাণী অবমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি বন বিভাগের ক্যাম্প ¯’াপনের বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রয়েছে। এ সব বিষয় ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হ”েছ। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরীর বিষয়টি নিয়েও সরকারের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি ।
সুন্দরবনের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ৮০-৮৫ কিলোমিটার উত্তরে জেলার চিতলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চিত্রা নদীর বিস্তীর্ণ চর ও নদীর দু’পারের ১৮-২০ টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে এ বনরাজি। উপজেলার খিলিগাতি,রায়গ্রাম,শুরিগাতি, করাতদিয়া, ডুমুরিয়া, আরুলিয়া,
খড়িয়াসহ প্রায় ২০ টি গ্রাম মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন বনাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এলাকার অধিকাংশ বাড়ীর আঙিণাসহ আশপাশের আবাদি-অনাবাদি জমিতেও এখন গোলপাতা, সুন্দরী,কেওড়া,
ওড়াসহ নানা প্রজাতির গাছ প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠেছে। এ ছাড়া, চিত্রা নদীর দুই কিনার জুড়ে বিস্তীর্ণ চর এলাকায় বংশ বিস্তার করে বেড়ে উঠেছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বৃক্ষরাজির সংখ্যা। এ ছাড়া, এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ঘন অরন্য। ইতিমধ্যে জীব ও প্রাণী বৈচিত্রের দেখা মিলেছে এ বনে। মেছো বাঘ, বাঘডাসা, খাটাস, বিষধর সাপ, তক্ষক, বন বিড়াল, শিয়াল, গুঁই সাপসহ বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীর বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে নতুন এ বনাঞ্চল। মৌমাছিরা মধু আহরণ করে মৌচাক তৈরী করছে গাছে গাছে। মাছরাঙ্গা, শালিক, টিয়া, ঘুঘু, পানকৌড়ি, বক,দোয়েল, ঘড়িয়াল,টুনটুনিসহ প্রায় অর্দ্ধ শত প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মূখর এ নতুন বনাঞ্চল। অন্যদিকে, অসংখ্য প্রজাতির সুন্দরবনের উদ্ভিদ জন্মা”েছ এখানে। এ সব কারণে এলাকার মানুষের মাঝে যেমন আশার আলো দেখা দিয়েছে, তেমনি পরিবেশের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী দিনের স্বপ্ন ঃ
প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এ বনাঞ্চলে যে গতিতে বৃক্ষরাজি, লতা-গুল্ম সম্প্রসারিত হ”েছ, তা সত্যিই আশা জাগানিয়া। সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে, পরিবেশের উন্নয়নের সাথে সাথে অচিরেই এ এলাকার মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে আরও স্বাবলম্বি হয়ে উঠবে। কয়েক হাজার বেকার মানুষ কর্মমূখি হবে। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে শত শত হরিণ চিত্রা নদীর চরে কচি ঘাসের সন্ধানে চরে বেড়াবে। গাছে গাছে বানরের কিচি মিচি আর নানা প্রজাতির পাখীর কলকাকলি নতুন এক স্বপ্ন রাজ্যের সন্ধান দেবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্যোগ নিয়ে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্পট গড়ে উঠবে। হাজারো দেশী-বিদেশী পর্যটক চিত্রা চরের আকর্ষনে ছুটে আসবে দূর-দূরান্ত থেকে। জেলার বিভিন্ন পর্যটন ষ্পটের সাথে নতুন সংযোজন চিত্রা পাড়ের এ দৃষ্টি নন্দন আকর্ষণীয় স্পট দেশের অর্থনৈতিক খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৯