somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এস.এম সুলতান ও তাঁর জীবনী

১০ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চরদখল (বোর্ডের উপর তেলরঙে আঁকা) ১৯৭৬, শিল্পী: এস.এম সুলতান
সূত্র: বাংলা পিডিয়া

ছিলেন চিত্রকর। তাঁর পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে এস.এম সুলতান নামেই তিনি অধিক পরিচিত। ১৯২৩ সালের ১০ই আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ার এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে বাংলার এই কৃতি সন্তানের জন্ম। পারিবারিক ডাক নাম লাল মিয়া। শৈশবে সবাই তাঁকে লাল মিয়া বলেই ডাকত। দারিদ্রের শত বাধা থাকা সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে তাঁর পিতা তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। পাঁচ বছর পর থেমে যায় পড়াশোনা। এরপর বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ ধরেন। এখানেই এস.এম সুলতানের শুরু। চলতে থাকে বিভিন্ন দালানে দালানে ছবি আঁকা। দশ বছর বয়সের স্কুল জীবনে, স্কুল পরিদর্শনে আসা ডা. শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জীর ছবি এঁকে সবার তাক লাগিয়ে দেন। দরিদ্র ঘরের সুলতানের ইচ্ছে ছিল কলকাতা গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। এ সময় তাঁর প্রতিভায় চমৎকৃত হয়ে এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ১৯৩৮ সালে এস.এম সুলতান কলকাতায় চলে আসেন। এ সময় কলকাতায় এসে তিনি ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতেই ওঠেন। ইচ্ছে ছিল অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি শিল্প শিক্ষা। এ সময় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য প্রখ্যাত শিল্পী ও সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সুলতানের শিক্ষার জন্য তিনি তাঁর গ্রন্থাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং সব ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকেন। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ১৯৪১ সালে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়ার পর তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পীর জীবন শুরু করেন।

আর্ট স্কুলের বাঁধাধরা জীবন তাঁর ভাল লাগেনি। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও ভবঘুরে প্রকৃতির। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রীতিনীতি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী একজন আবেগি মানুষ তাই তিনি অস্বীকার করেছিলেন যান্ত্রিকতা পিষ্ট নগর ও নাগরিক জীবনকে। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি বেড়িয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে পথে। ছোট বড় শহরগুলিতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি আঁকতেন। ছবি প্রদর্শনী ও ছবি বিক্রি করে চলত তাঁর জীবন। শিল্পী হিসেবে তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু জাগতিক বিষয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনাগ্রহ। শিকড় ছড়াবার আগেই তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। আর তাই তখনকার আঁকা তাঁর ছবির নমুনা, এমনকি ফটোগ্রাফও এখন আর নেই। তবে সে সময় তিনি নৈসর্গিক দৃশ্য ও প্রতিকৃতির ছবি আঁকতেন। কাশ্মীরে কিছুদিন থেকে তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন। সিমলায় ১৯৪৬ সালে তাঁর আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়।

দেশ বিভাগের পর কিছু দিনের জন্য সুলতান দেশে ফেরেন। কিন্তু এর পরই ১৯৫১ সালে তিনি করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে দু’বছর শিক্ষকতা করেন। সে সময় চুঘতাই ও শাকের আলীর মত শিল্পীদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। এর আগে ১৯৫০ সালে তিনি আমেরিকায় চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন। এবং নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন ও পড়ে লন্ডনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী করেন।

শিশুদের নিয়ে সুলতানের বহু স্বপ্ন ছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি নড়াইলে ফিরে আসেন এবং শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। নড়াইলে তিনি নন্দন কানন নামের একটি প্রাইমারী ও একটি হাই স্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের জন্য কিছু করার আগ্রহ থেকে তাঁর শেষ বয়সে তিনি ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়। সে সময় শিল্পীরা উৎসাহ ও আগ্রহে বিভিন্ন কৌশল-রীতি, নিয়ম, ও ছবির মাধ্যম সহ নতুন নতুন বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত হয়ে উঠেন। সে সময়ও তিনি সকলের চোখের আড়ালে নড়াইলেই রয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন কিন্তু তাঁর জীবনের মূল সুরটি ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে বাঁধা। গ্রামীণ জীবন থেকেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালি জীবনের উৎস কেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব ও সংগ্রাম, নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাস, অনুপ্রেরণা। গ্রামীণ জীবনেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি। তিনি কৃষক পুরুষকে দিয়েছেন পেশীবহুল ও বলশালী দেহ আর কৃষক রমণীকে দিয়েছেন সুঠাম ও সুডৌল গড়ন, দিয়েছেন লাবণ্য ও শক্তি। হয়তো তাঁর দেখা দুর্বল দেহী, মৃয়মাণ ও শোষণের শিকার কৃষকদের দেখে কল্পনায় তিনি নির্মাণ করেছেন শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান কৃষক সমাজ। তাঁর ছবিতে পরিপূর্ণতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি ছিল শ্রেণী বৈষম্য, গ্রামীণ জীবনের কঠিন বাস্তবতার চিত্র। তাঁর আঁকা হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) ও চরদখল (১৯৮৮) এরকমই দুটি ছবি।

১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতান শিল্প রসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে যান। মধ্য সত্তরে তাঁর কিছু ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় আঁকা তাঁর কিছু ছবি দিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। মূলত এ প্রদর্শনীটিই তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ ছবিগুলিই তাকে নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতিনিধি ও তাদের নন্দন চিন্তার রূপকার হিসেবে পরিচিত করে। তাঁর ছবিতে কৃষকই হচ্ছে জীবনের প্রতিনিধি এবং গ্রাম হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র। গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। এজন্যই কৃষক ও তাদের জীবন একটি কিংবদন্তী শক্তি হিসেবে সকলের চোখে তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে।

অবয়ব বা আকৃতিধর্মিতাই তাঁর কাজের প্রধান দিক। তিনি আধুনিক ও নিরবয়ব শিল্পের চর্চা করেননি। তাঁর আধুনিকতা ছিল জীবনের অবিনাশী বোধ ও শিকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। সুলতান নির্দিষ্ট নিয়মের প্রতি গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির উত্থানকে। উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ও উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরেছেন। এটিই তাঁর দৃষ্টিতে আধুনিকতা। তিনি ইউরো কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের ন্যায় খুঁজেছেন মানবের কর্ম বিশ্বকে। সুলতানের মতো আর কেউ আধুনিকতার এমন ব্যাখ্যা দেননি। তাঁর অনন্য স্টাইলটি অনুকরণীয়। তাঁর কোন অনুসারী বা স্কুল নেই, তাঁর মতো মাটির কাছাকাছি জীবন তাঁর সময়ে আর কোন শিল্পী যাপন করেননি। সুলতান তেলরঙ ও জলরঙের ছবি এঁকেছেন। ব্যবহার করেছেন সাধারণ কাগজ, সাধারণ রঙ ও চটের ক্যানভাস। এজন্য তাঁর অনেক ছবি নষ্ট হয়ে যায়। সেদিকেও তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না।

আশির দশক থেকে সুলতান নড়াইলে থেকে যেতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর কাছে আশ্রয় নেয়া মানুষ, শিশু ও জীবজন্তুদের জন্য তাঁর বাড়িটি ছেড়ে দেন। তাঁর একটি চিড়িয়াখানা ছিল। শিশুদের জন্য তিনি একটি বিরাট নৌকা বানিয়েছিলেন।

১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের একটি প্রদর্শনী হয়। আশির শেষ দিকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোন’এ তাঁর শেষ প্রদর্শনীটি হয়। সে বছর আগস্ট মাসে ব্যাপক আয়োজন করে তাঁর গ্রামের বাড়িতে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। এরপর পরই ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি চলে যান।

সূত্র: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বাংলা পিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:২৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×