বৈদ্যনাথপুরের সুনাম রহিয়াছে হরেক রকম গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম হিসেবে। এইখানে প্রচণ্ড গরমের দিনেও শীত অনুভূত হয় আর এখন চলিতেছেও শীতকাল। শীতকাল আসিলেই রীতি অনুযায়ী গ্রামে বিবাহের ধূম পরিয়া যায়। কুয়াশায় আচ্ছাদিত হইয়া রহিয়াছে চারিদিক। উঠানে বসিয়া লজ্জাবতী ঘোষ ভাবিতেছে এখনো ভোর হইতে আর কত বাকি রহিয়াছে। এরই মাঝে সরাই খানায় দাঁ আর খুন্তির উপর আরম্ভ হইয়া গিয়াছে ব্যাঞ্জনা। আজ সারাদিন পেঁয়াজ আর মরিচ এর অত্যাধিক পরিমান যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে ভাবিয়া দাঁ এর প্রান একবার দেহ হইতে বাহির হইয়া আবার দেহের ভেতর প্রবেশ করিতে লাগিল। এইসব দেখিয়া ডাল ঘুটনি বেচারি বড়ই আনন্দিত হইতে থাকিল কারন আজ সারাদিন তাহার অলস সময় কাটিবে।এরই মাঝে হাক ডাক করিতে লাগিলেন বাড়ির কর্তা নিতাই ঘোষ। আজ তাহার বড় কন্যা লজ্জাবতীকে দেখিতে আসিবে পাত্র পক্ষ। উত্তর পারার বিমল ঘোষের একমাত্র পুত্র রবি ঘোষ এর সহিত বিবাহের কথা চলিতেছে। পাত্র অল্প কিছু দিন হইল বিলেত হইতে ফিরিয়াছে কম্পিউটার বিজ্ঞানী হইয়া। তাহার ইচ্ছা জাগিয়াছে দেশের মানুষকে কম্পিউটার জ্ঞানের সাগরে শিক্ষিত করিয়া তুলিবে। নিতাই ঘোষের এহেন ভাবনার প্রতি ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করিতে লাগিল। এতে তাহার দেশ প্রেম যেন নতুন করিয়া জাগিয়া উঠিল। তিনি তাহার কন্যার জন্য এমন একটি সুযোগ্য পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করিতে দ্বিধা করিলেন না। তাই কন্যার মতের কোন ভাবাবেগ না শুনিয়াই বিবাহ স্থির করিয়া লইলেন এবং তাহার হবু জামাইয়ের কম্পিউটার শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা দান করিবেন বলিয়া কথা পাকাপাকি করিয়া ফেলিলেন। লোকে ইহাকে যৌতুক বলিয়া কটাক্ষ করিলেও তিনি উহাকে কিছুতেই যৌতুক বলিয়া মানিয়া লইলেন না। এই রকম সাহায্য প্রদানের জন্য লজ্জাবতী বার কয়েক পিতার সহিত বাক্য বিনিময় করিলেও যখন কোন রকম আর ফল লাভ হইলনা তখন আশা ত্যাগ করিয়া বিবাহের দিন গুনিতে লাগিল। তারই ধারাবাহিকতায় আজ তাহাকে দেখিতে আসিবে পাত্র পক্ষ। কন্যা পছন্দ হইলে পণ্ডিত ডাকিয়া বিবাহের লগ্ন নির্ণয় করিবার ইচ্ছা আছে নিতাই ঘোষের আজই তাই তিনি পণ্ডিতকে সংবাদ দিয়া রাখিতে ভুল করিলেননা।
দুইটি লাল রঙের পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে দীঘির জলে। পারে বেড়ে ওঠা নিমগাছের ছায়ায় বসিয়া কোমলরানী ঘোষ উদাস বসিয়া একদৃষ্টিতে দীঘি পানে চাহিয়া রহিয়াছে। মাঝে মাঝে সেইখানে ঢিল ছুড়িলে জলের মাঝে তরঙ্গ সৃষ্টি হইয়া ধীরে ধীরে পারে জমিতে লাগিল। তাহার জীবন যেন এই তরঙ্গের মতই ধীরে ধীরে মরনের পারে আসিয়া জমিয়া গিয়াছে। একসময় বিলীন হইয়া যাইতে হইবে ওই জলের মতই। তাহারা দুটি বোন ছিল। সে ছোট কিন্তু বড় বোনের বর্ণ শ্রীকৃষ্ণের সহিত মিলিয়া যায় তথাপি তার বর্ণ দুধে আলতা বলিয়া বড় বোনের পূর্বেই তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছিল। বড় বোনের বিবাহের পূর্বেই তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছিল বলিয়া একধরনের হতাশা আর পাপ বোধ আজো তাহাকে তাড়া করিয়া বেড়ায়। ওই সময়ে তাহার পিতা কোনরূপ যৌতুক ব্যাতিতই কন্যার বিবাহ দান করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া ধন্য হইয়া খুব অল্প বয়সেই তাহার বিবাহ সম্পাদন করিয়া ফেলেন গ্রামের সত্তর বছর বয়সের বুড়ো জমিদার দেবনাথ নারায়ণের সহিত। তাহার আজো মনে পরিয়া যায় বিবাহের মধুচন্দ্রিমার সেই ক্ষণের স্মৃতি। শীতের রাতে বুড়ো স্বামীর আদর সোহাগ পাওয়া বহু দূরের কথা হাঁপানি উঠিয়া যখন তাহার স্বামী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হইতেছিল তখন ঘোমটা ছাড়িয়া কোমরে রেশমি শাড়ির আঁচল পেচাইয়া লইয়া স্বামীর বুকে তেল মালিশ করিতে করিতে সারারাত পার করিয়া ভোরের অপেক্ষা করিতে ব্যাস্ত থাকে শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে। স্বামীর আদর সোহাগ হইতে বঞ্চিত থাকিয়াই তাহার জীবন কাটিতে লাগিল। এইক্ষনে রীতি অনুসারে তাহার স্বামী আজ যখন মৃত্যু পথ যাত্রী তখন তাহাকেও তার স্বামীর সহিত সহমরণে যাইতে হইবে বিধায় মনের ভেতর তীব্র ব্যাঞ্জনা অনুভূত হইতে লাগিয়াছে। চন্দ্র বাবু মরিয়া গিয়া অমর হইয়াছেন কিন্তু আধুনিক কালের এমন সোনালী সময়েও সহমরণে স্ত্রীকে বরন করিতে হইবে এমন ধরনের স্বামী প্রীতি। ভাবিতে ভাবিতে কখন যে নয়নে জল চলিয়া আসিয়াছে কোমলরানী আঁচলে অশ্রু মুছিয়া লইয়া ঘরে ফিরিল। স্বামীর স্নানের সময় হইয়া আসিয়াছে। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল তাহারা দুইটি বোন যেন দীঘির জলে ভাসিয়া থাকা পদ্মফুল দুইটির মতই ভাসিয়া রহিয়াছে একসময় জলেই পচিয়া মরিবার ত্বরে।
বিবাহের উপযুক্ত হইয়াছে বলিয়া যে প্রথম দর্শনেই প্রণয় হইয়া গিয়াছে তাহা নয় অর্থের কল্যানেই বিবাহের লগ্ন স্থির হইল। লজ্জাবতীর কেবলই মনে হইতে লাগিল একজন কন্যা দ্বায়গ্রস্ত পিতার মুক্তি মিলিল তাই সে বাতাসের বহমানতায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া নিজেকে স্বামী সেবার নিমিত্তে মনে মনে তৈরি করিয়া লইতে লাগিল। এই খুসিতে নিতাই ঘোষ সদর হইতে একটি নাট্যদল ডাকিয়া আনিলেন গ্রামের মানুষের মনোরঞ্জন করিবার নিমিত্তে। নাট্যদলের সমাচার লইয়া নিতাই ঘোষ নিমন্ত্রন দিয়া আসিলেন তাহার হবু জামাই বাবুকে নাটক দেখিয়া যাইতে। যথাসময়ে নাটক মঞ্চস্থ হইল। রবি বাবু নাটক দেখিতে আসিয়াছেন বিলেতি বাবু সাজিয়া। হাজার হোক শ্বশুর বাড়ি বলিয়া কথা নিজের অহমিকা জ্ঞান তাহাকে এই ব্যাপারে আরও একধাপ উৎসাহিত করিয়া তুলিয়াছে। নাটক শেষে নৃত্য পরিবেশিত হইল। নৃত্যের মূর্ছনায় মোহিত না হইবার কোন কারন নাই। কারন নৃত্য পরিবেশন করিয়াছে সুমিতা দেবী। নৃত্যের মাদকতার সহিত দেহের পোশাক উন্মুক্ত করিতে তাহার খ্যাতি রহিয়াছে। জলপরীর মত সুমিতা দেবীর অনন্ত যৌবনা দেহের ভাঁজে ভাঁজে রবির চরিত্রের দোষ ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। বাড়িতে ফিরিয়া স্ত্রীর ছবির দিকে অশ্রু ভেজা নয়নে তাকাইয়া থাকিয়া নিতাই ঘোষ জীবনের অযুত নিযুত হিসাব কষিতে কষিতে ভাবিলেন কন্যার বিদায়ের পর তাহাকে শূন্য জীবন কাটাইতে হইবে তাই তাহার জন্য একটি বিবাহ করিয়া লওয়া উত্তম হইবে। সুমিতা দেবীর মুখশ্রী যেন তাহাকে মৃত স্ত্রীর রূপের স্মৃতি স্মরন করাইয়া দিতে লাগিল।
অমিয় সাধারনত রাতে বাড়িতে না ফিরিয়া বাহিরে বন্ধু মহলে ব্যাস্ত থাকিতে সুখ অনুভব করিয়া জীবন কাটাইয়া চলিতেছে। কিন্তু আজ রাতে তাহার আর বাহিরে মন টিকিল না তাই বাড়িতে ফিরিয়া আসিল। তাহার নিকটে থালাতে করিয়া ভাত নিয়া আসিয়া পাশে বসিল কোমলরানী। কিন্তু কিছুতেই ভাত খাইতে মন স্থির করিতে না পারায় অগ্যতা অনেক মমতার সহিত আজ তাহার একমাত্র এই বয়জেষ্ট পুত্রটিকে নিজ হস্তে মুখে তুলিয়া ভাত খাওয়াইয়া দিতে লাগিল সে। ইহার পূর্বে কখনো অমিয় তাহার মুখ পানে চাহিয়া দেখিবার অবকাশ পায় নাই। আজ যেন মমতার এমন বাঁধনে নিজেকে নতুন করিয়া আবিষ্কার করিল সে। সারারাত আর ঘুমাতে পারিলনা সে। বারংবার ফিরিয়া আসিয়া দেখিয়া যাইতে থাকিল তাহার এই কুমারী মাতার ঘুমন্ত দেহপানে। যতই দেখিতে থাকিল ততই মন্ত্রমুগ্ধে মোহিত হইয়া পরিল তাহার দুই নয়ন। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল কোমলরানীর এই মেদহীন দেহ যেন তাহাদের গ্রামের মৃত্তিকার দেহ চীরে বহিয়া চলা সরু খালের ন্যায়। শাড়ির আঁচল নিজের অবস্থান ভুলিয়া উন্মুক্ত করিয়া রাখিল রক্ষিতার আমানত। অমিয়র পক্ষে বিচার করিবার যুক্তি মিলিলনা। ইহার নাম যদি মমতাই হইয়া থাকে তবে তাহার বুকের ভেতর জ্বলন সৃষ্টি হইত না। কোমলরানীর ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল বাতাসে দুয়ারে কাড়া নাড়িবার শব্দে। এতক্ষনে সে টের পাইল একটি দৃষ্টি যেন তাহার দেহকে উপভোগ করিয়া লইতেছে আপন মোহে। বাতি নিভিয়া দিয়া পুনরায় ঘুমের আয়োজন করিতে ব্যাস্ত হইয়া পরিল সে।
বাহিরে শীতের আবেশ তীব্র আকার ধারন করিয়াছে। পথের ঘাসগুলো শিশির সিক্ত হইয়া মনের ভেতরে অবগাহনের চাহিদা জাগাইতেছে অনুভব করিতে পারিয়া রবি আসিয়াছে সেই আবেশে উষ্ণ হইবার নিমিত্তে সুমিতা দেবীর ঘরে। বাহিরে জমিয়াছে মহাকালের আঁধার আর ঘরের ভেতর খেলিতে লাগিল আলো ছায়ার আদিম মাদকতা। অপরদিকে নিতাই ঘোষের মনোকণিকায় রঙিন স্বপ্ন এমনভাবে খেলিতে লাগিল যে সে সিদ্ধান্ত নিয়া ফেলিল সকালের প্রথম প্রহরেই সুমিতা দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়া মনের সকল জঞ্জাল দূর করিয়া লইবে। ভোরের কিছু পূর্বেই রবি চলিয়া গেল ভবের যত রঙ্গলীলা আছে সকল সাঙ্গ করিয়া। দীঘির জলে স্নান করিতে বাহির হইল সুমিতা দেবী। এমন শীতের সকালেও তাহাকে স্নান করিতে দেখিয়া নিতাই ঘোষের মনে পবিত্রতার চেতনা আসিয়া ঠেকিল। ভাবিলেন আহা এমন একজন নৃত্য দেবীর মাঝেও ভগবানের নিকট পূজা অর্চনা করিবার যেমন মহিমা বিদ্যমান এমন নারীকেই তাহার স্ত্রী হিসেবে পাইবার আর কোন বাঁধা থাকিবেনা। সকালের প্রথম প্রহরে এমন একজন দেবীর দর্শন পাইয়া তাহার মনের মাঝে বহুকাল পরে আনন্দের ঝড় উঠিল। তাই মনের বাসনাকে সংবরণ করিতে না পারিয়া ছুটিয়া দীঘির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল নিতাই ঘোষ। জলের সকল রং যেন তাহার দেহে শিশির কণার মত জমিয়া থাকিয়া উন্মুক্ত করিয়া তুলিয়া ধরিয়াছে বিশ্বের সকল সজীবতা। সুমিতা দেবী ইহাতে ছল করিতে ভুল করিল না এক পলকের ব্যবধানেও। পিছলিয়ে যাইবার ছলে নিতাইকে জড়িয়া ধরিল আর লাজুক হাসিয়া কহিল ঠাকুর না থাকিলে আজ এই সুমিতার নৃত্যগুনের ইতি হইয়া যাইত। নিতাই সেই ছলের মোহে নিজেকে স্বমর্পন করিয়া বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া ধরিল সুমিতা দেবীকে। বিবাহের প্রস্তাব তুলিতেই অশ্রু সিক্ত নয়নে সুমিতা দেবী কহিল ঠাকুর আমি আপনার দৃষ্টিতে প্রথম দিন হইতেই আমার প্রতি আপনার বিচার বুঝিতে পারিয়াছিলাম। আমাকে তবে এইবার ঠাকুর আপনার চরনে পুজো দেবার ঠাই দিন পুন্য হইবার সুযোগ করিয়া দিয়া ধন্য করুন।
অমিয়র মনের আকুতি বুঝিতে পারিয়া কোমলরানী বিচলিত হইয়া উঠিল। স্বামীর প্রতি বিশ্বাস ভাঙিবার স্ত্রী সে নয়। ধর্মের নিকট সাত পাকের সেই প্রতিজ্ঞা তাহাকে বারংবার তাড়া করিয়া ফিরিতে লাগিল। অবশেষে রাত্রি দ্বিপ্রহরে স্বামীর চরনে মাথা স্পর্শ করিয়া ঘর ছাড়িয়া নিরুদ্দেশ হইতে হইল তাহাকে। অপরদিকে বিমল ঘোষের পরিবার হইতে বিবাহের প্রস্তাব বাতিল করিয়া লওয়া হইল। লজ্জাবতীর দোষ তুলিয়া ধরা হইল একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতায় জন্ম লওয়া একজন জারজ সন্তান হিসেবে। লজ্জাবতীর নয়নে কোন ভাবাবেগ ফুটিয়া উঠিল না। একজন কন্যা দ্বায়গ্রস্ত পিতার বিলাপ ধ্বনিতে ভরিয়া উঠিল আকাস বাতাস। সরাই খানা হইতে ডাল ঘুটনি হস্তে বাহির হইয়া আসিল সুমিতা দেবী। অলস সময়ের অবকাশ ভুলিয়া ডাল ঘুটনির উপরে আজ ব্যাঞ্জনা চলিতেছিল। লজ্জাবতী পথ চলিতে লাগিল নিরুদ্দেশের পথে। সাঁঝের কিছু প্রহর পরে দুই বোনের লাশ ভাসিয়া উঠিল দীঘির জলে ফুটিয়া থাকা লাল রঙের পদ্মফুল দুইটির সহিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:০৫