somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুতাজিলি দার্শনিক : প্রকৃত সহিহ মুসলিম

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এই শিরোনামটা পড়ে অনেকে নাক সিটকবেন , কিন্তু এটাই খুবই সত্য কথা | আমি এই লেখায় মুতাজিলি দার্শনিকদের কথাই আলোচনা করব |

প্রথমে বলি মুতাজিলি শব্দের অর্থ কি ? এর মানে হলো পরিত্যাগ করা | ওয়াসিল ইবন আটা হাসান বাসরিকে জিজ্ঞেস করেছিল যে একজন পাপী যে এক জঘন্য পাপ করেছে সে কি বিশ্বাসী না অবিশ্বাসী ? হাসান বলেছিলেন যে সে বিশ্বাসী (মুসলিম) হবে | এখানেই আটা হাসানকে ত্যাগ করেন | আটা আর তাঁর সাথীদের নতুন গ্রুপের নাম হয় মুতাজিলি বা পরিত্যাগকারী | পরে এই গ্রুপ নিজেদের “ন্যায় আর ঐক্যের লোক” বলে পরিচিত হয় | তাদের বিরোধীরা তাদেরকে মুতাজিলি বলে |

মুতাজিলিদের পাঁচটি নীতি :

১] ন্যায় আর ঐক্য
২] আল্লার সতর্কবাণী আর প্রতিশ্রুতি
৩] অন্তর্বর্তী স্থান [ একজন পাপী মুসলিম নয়, কাফেরও নয় )
৪] ভালোটাকে গ্রহণ করা
৫] খারাপকে বর্জন করা

এগুলিকে বিস্তারিতভাবে বলছি :

১] ক) ঈশ্বর এক : দিব্য ঐক্য

মুতাজিলিরা আর পাঁচটা মুসলিমের মত এটা বিশ্বাস করত যে ঈশ্বর এক | তাদের কাজটা ছিল ঈশ্বরের একতাকে এমনভাবে পরিবেশন করা যা শাস্ত্রসম্মত হবে আর যুক্তিসম্মতও হবে | এই কাজে আগের ধর্মীয় গ্রুপগুলি অকৃতকার্য হয়েছিল | এই ধরনের প্রচেষ্টার সামনে যে মুখ্য বাধা তা হলো সীমিত মানুষের ভাষা নিয়ে অসীমকে প্রকাশ করার অবাস্তবতা |

সমস্ত মুসলিম ধর্মীয় শাখাগুলি একটা দোটানার মধ্যে পড়ে : ঈশ্বর জগত থেকে মুক্ত না ঈশ্বরের জাগতিক বৈশিষ্ট্য আছে ? যদি ঈশ্বরকে জগত থেকে মুক্ত বলে মানা যায় তাহলে ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যগুলি কখনই জাগতিক হতে পারে না | কিন্তু ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যগুলি তো সবই জাগতিক | যেমন : ন্যায়পরায়নতা, পবিত্রতা, দয়াবান, সার্বভৌম, শান্তিদাতা, সুরক্ষাদাতা ইত্যাদি | যারা আল্লার নিরানব্বৈটা নাম জানেন তারা জানেন | কিন্তু এইগুলি তো মানুষের মধ্যেও আছে | সুতরাং এগুলিকে স্বীকার করলে ঈশ্বর জাগতিক হয়ে পড়েন , তিনি আর জগত থেকে মুক্ত থাকেন না | সুতরাং এটা একটা দোটানা | যে কোনো একটা হবে | কিন্তু কোনটা ? অথচ দুটিই শাস্ত্রসম্মত | কোনো একটিকে অস্বীকার করা মানে শাস্ত্রকে অস্বীকার | এইটাই সমস্যা |

এখন মুতাজিলিরা এই সমস্যার সমাধান হাজির করলো এইভাবে : ঈশ্বর-এর নিজের সারবস্তু ছাড়া আর কোনো জাগতিক বৈশিষ্ট্য নেই | যেমন ঈশ্বর সর্বজ্ঞ , কিন্তু তিনি জানেন তার সারবস্তু (এসেন্স)দিয়ে | এ ব্যতীত তার জন্য জানার কোনো উপায় নেই | এভাবে মুতাজিলিরা ঈশ্বরের সাথে অনেক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য বাতিল করলো | এতে শাস্ত্রের বৈশিষ্ট্যও রইলো আবার ঈশ্বর জগত থেকে মুক্তও হয়ে গেল | ঈশ্বর এক , তাঁকে ছাড়া অন্য কিছুই নাই : মুতাজিলিরা এটা প্রমান করলো |

খ) দিব্য ন্যায়

এখানকার সমস্যাটা হচ্ছে দুনিয়ায় পাপের উপস্থিতি | মুতাজিলিরা বলে ঈশ্বর কখনো পাপ করেন না, পাপ মানুষে করে | মানুষের আছে স্বাধীন ইচ্ছা | সেই ইচ্ছা দিয়ে তারা পাপ করে | ঈশ্বর কখনো মানুষের উপরে কিছু চাপান না যা সে করতে পারবে না | অন্যায় তো মানুষে করে আর ঈশ্বর সবসময়েই ন্যায় করেন | কারণ মানুষ যদি ঈশ্বরের ইচ্ছায় অন্যায় করে তাহলে তাকে শাস্তি দেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না | সুতরাং তা ঈশ্বরের ইচ্ছা হতে পারে না , সেটা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা | এই হলো মুতাজিলিদের বক্তব্য |

লেখকের সমালোচনা :

যদি তাই হয় তাহলে তো একটা বড় সমস্যা আসে মুতাজিলিরা | দুনিয়াতে পাপের সৃষ্টি করলো কে ? যদি বল ঈশ্বর তাহলে তো মুতাজিলিদের বক্তব্য খন্ডিত হয় | যদি বল মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার স্রষ্টা কে ? এটা নিশ্চয় ঈশ্বরই হবেন | তাহলে সেই স্বাধীন ইচ্ছা দিয়ে পাপ করার ক্ষমতাও নিশ্চয় ঈশ্বরের দান | তাহলে আবার ঘুরেফিরে সেই ঈশ্বরই পাপের স্রষ্টা : এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় | শুধু একটু ঘুরপথে আসতে হয়েছে আর কি |

২] ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি আর সতর্কবাণী

মানুষের ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের যে স্বাভাবিক ইচ্ছা তাই হলো ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি | আর জাহান্নাম হলো সতর্কবাণী |

৩] অন্তর্বর্তী স্থান

যেসব মুসলিম কোনো জঘন্য পাপ করেছে কিন্তু পরিতাপ করার আগেই মরেছে তারা মুমিনও নয় আর কাফেরও নয় | মুমিন হতে গেলে ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকতে হবে আর সেই বিশ্বাস কার্যে প্রতিফলিত হতে হবে | এই দুটি না থাকলে সে মুমিন নয় | আর কাফের যে সে তো ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে | কিন্তু জঘন্য মুসলিম অপরাধী ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে না | তাই সে কাফেরও নয় | এই ধরনের লোকেদের জায়গা হলো নরক | তবে নরকেরও স্তর আছে | এটা সম্পূর্ণভাবেই মুতাজিলিদের দান | সেইরকম স্তরে থাকবে |

৪] ঠিকটাকে গ্রহণ করা ও ভুলটাকে বর্জন করা

এই দুই ডকট্রিন ওই দিব্য ন্যায় আর একতা থেকে এসেছে |

যুক্তি-তর্কের ব্যবহার

মুতাজিলিরা চেয়েছিল সমস্ত ধর্মগ্রন্থ যুক্তির আলোকে বুঝতে হবে আর যদি কোনো গ্রন্থ যুক্তি অস্বীকার করে তাহলে সেই গ্রন্থ বর্জন করতে হবে | এটাই মুতাজিলিদের সাথে প্রাচীনপন্থী গোঁড়া মুসলিমদের বিরোধের কারণ |
লেখকের সমালোচনা

যে শাস্ত্র যুক্তির আলোকে বুঝা যায় না তার দুর্বোধ্যতার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে | ওই কারণ থেকেই বুঝার চেষ্টা করতে হবে | বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না বুঝার কারণ হয় দুটি : ১] জ্ঞানের অভাব, ২] অভিজ্ঞতার অভাব | এই দুই কারণ কেবলমাত্র অনুসন্ধান দ্বারাই দূর করা যেতে পারে |

ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যার নিয়ম

মুতাজিলিরা বলেছিল যে যদি ধর্মগ্রন্থ তার আক্ষরিক মানে দিয়ে বোঝা না যায় আর যদি দুটো ব্যাখ্যা সম্ভব হয় , যার একটা আক্ষরিক অর্থের কাছে আর আরেকটা দুরে, তাহলে কাছের ব্যাখ্যাটা গ্রহণ করতে হবে |

প্রথম দায়িত্ব

মুতাজিলিদের মতে প্রতিটি বুদ্ধিমান মানুষের উচিত নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ধর্মগ্রন্থ বোঝা | প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে এই বিশ্বে ঈশ্বর ও তাঁর বৈশিষ্ট্যকে খুঁজে বার করা | ভাবা যে কেন এই বিশ্ব আছে ? কে এটাকে বানিয়েছে ? ইত্যাদি | সেই স্রষ্টা মানুষের কাছ থেকে কি চায় ? এটা খুঁজে বার করতে হবে | এটাই ঈশ্বরীয় জ্ঞান | এইভাবে খোঁজাটাকে ইসলামিক ধর্মশাস্ত্রে বলে “ওজুদ আল নজর” (হিন্দু ধর্মে এর নাম “ব্রহ্ম বিচার”)| এইটাই মুতাজিলিদের প্রথম দায়িত্ব বা কর্তব্য | যেহেতু ঈশ্বরকে কেউ ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে পারে না তাই যুক্তি বা চিন্তা দ্বারা তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে | অনেকটা সক্রেটিস বা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদীদের মত কথা | ফারাক শুধু এখানেই যে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদীরা তাঁদের যুক্তি বিশ্বের রহস্য খোঁজার ব্যাপারে নিয়োগ করতেন | মুতাজিলিরা সেই একই যুক্তিবুদ্ধি ঈশ্বরকে খোঁজার ব্যাপারে নিয়োগ করেন |

এই ওজুদ আল নজর এর ব্যাপারে মুতাজিলিদের সাথে অন্য গোঁড়া মুসলিমদের ফারাকটা এখানেই যে মুতাজিলিরা এটাকে প্রথম কর্তব্য বলে নিজেরাই খোঁজে যদি তারা কোনো প্রফেট নাও পায় | অন্যদিকে গোঁড়া মুসলিমরা তখনি অজুদ আল নজর করে যখন তারা কোনো প্রফেট পায় | এইমাত্র ফারাক |

যুক্তি আর ধর্মশাস্ত্র

মুতাজিলিরা যুক্তি আর ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিল | তাদের বক্তব্য হলো যুক্তি দিয়ে কিছুটা জানা যায় ভালোমন্দ কি ? যেখানে সেটা জানা যায় না সেখানেই ধর্মশাস্ত্রের দরকার পড়ে | এতে একটা সমস্যা আসে : ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা আর থাকে না | এই সমস্যার উত্তরে আবদ আল জব্বার লিখেছেন : ঈশ্বর সর্বজ্ঞ বলেই সমস্ত অন্যায়কে জানেন | তাই তিনি অন্যায় করেন না , অন্যায় মানুষেই করে | তাই মানুষকেই যুক্তি দিয়ে ন্যায় অন্যায় ঠিক করতে হবে | এতে করে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতারই প্রমান হয় |

লেখকের মন্তব্য

সংক্ষেপে এই হলো মুতাজিলিদের কথা | এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে মুতাজিলিরা নাস্তিক ছিল না | তারা আস্তিক ছিল | আমাদের মুক্তমনাদের মত যুক্তিকে জাগতিক ভোগসুখের কাজে লাগাত না , বরং ঈশ্বরকে জানার কাজে লাগাত | এরাই প্রথম বৈজ্ঞানিক ইসলামধর্মের সৃষ্টি করেছিল যা কখনই জিহাদিদের জন্ম দেয় নি | এটাই ছিল এদের শত্রু গোঁড়া মুসলিমদের মাথাব্যথার কারণ | এরই জন্য গোঁড়া মুসলিমরা মুতাজিলিদের হত্যা করে ও তাঁদের বই জ্বালায় |

তথ্যসুত্র
উইকিপিডিয়া



সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×