এম আর খান নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম মো. রফি খান। বাবা মা, প্রতিবেশী সকলের কাছে খোকা নামে বেশী পরিচিত ছিলেন তিনি। মাত্র চার বছর বয়সেই মায়ের কাছে খোকা রফির হাতেখড়ি হয় প্রথম বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ দিয়ে। তখন কাগজ কলমের তেমন একটা প্রচলন ছিল না। তাল পাতায় হাতের লেখা চর্চা করতে হতো। হাড়ির কালি আর সিমপাতার রস দিয়ে ঘটে বানানো কালিতে বাঁশের কঞ্চির কলমে তাল পাতায় লিখতে হতো। ঘটের কালির মধ্যে কলম ভিজিয়ে তালপাতায় অক্ষর লিখতেন তিনিও। লেখা শেষে তালপাতা পানিতে ধুয়ে আবার গুছিয়ে রাখতে হতো যত্ন করে পরের দিনের জন্য। পরে অবশ্য শ্লেটে লেখা শিখেছিলেন ।
এরপর ভর্তি হন রসুলপুর প্রাইমারী স্কুলে। স্কুল ঘরটি ছিল ছন পাতার ছাউনি দেয়া। বাঁশের চাটায়ের বেড়া দিয়ে ক্লাসগুলো ভাগ করা ছিল। মেঝেতে মাদুর পেতে বসতেন তাঁরা। দশ বছর বয়সে সাতক্ষীরা সদরের ঐতিহ্যবাহী প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (পিএন স্কুল)-এ ভর্তি হন তিনি। পড়াশুনায় মেধাবী ছিলেন খুব। ছেলেবেলায় খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। রসুলপুর স্কুল টিম লিডার হিসেবে তিনি ১৩টি ট্রফি লাভ করেন। বর্তমান 'গোল্ড কাপ' এর সময়ে গ্রামের সেই ট্রফি মূল্যহীন মনে হলেও এই পুরস্কারের উদ্দীপনা তাঁর জীবনে বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিক শক্তি যুগিয়েছিলো। সাতক্ষীরা প্রাণনাথ হাই স্কুলেও তিনি টিম লিডার ছিলেন। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতায় যান। ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেসময় মুসলিম ছাত্ররা ঐ কলেজে পড়ার সুযোগ পেত কম। হাতে গোনা মাত্র দু'চার জনকে ভর্তি করা হতো। কিন্তু তিনি তাঁর মেধার জোরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে পড়ার সময় তিনি হাজী মহসীন বৃত্তি লাভ করেন । ড. কুদরত-ই-খুদা ছিলেন তাঁর শিক্ষক। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আই.এস.সি. পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মাত্র ৩০ জন মুসলমান ছাত্র ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছিল সেবছর। এর আগে মুসলিম ছাত্রদের জন্য কোটা আরও অনেক কম ছিলো। এম আর খানের নেতৃত্বে ছাত্ররা এ বিষয়টি নিয়ে শেরে-বাংলা এ কে ফজলুর হকের কেবিনেটের এমএলএ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরীর সাথে আলোচনা করেন। তাঁদের এ উদ্যোগে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তি কোটা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি।
এরপর ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং বৃটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন-এ ভর্তি হন। সেখান থেকে একই সালে ডিটিএমএন্ডএইচ (Diploma in Tropical Medicine & Hygiene) ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুল অব মেডিসিন লন্ডন থেকে তিনি ডিসিএইচ (Diploma in Child Health) ডিগ্রিও লাভ করেন। ১৯৬২ সালে 'এডিনবার্গের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান' থেকে তিনি এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এফসিপিএস (Fellow of College of physicians and Surgeons) এবং ১৯৭৮ সালে এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি (Fellow of Royal College of physicians) ডিগ্রি লাভ করেন। রসুলপুরের ছনপাতার ছাউনি দেয়া এক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার শুরু হয়েছিল অধ্যাপক এম আর খানের আর সমাপ্তি হলো লণ্ডন আর বৃটেনের নামকরা মেডিকেল কলেজ থেকে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান কৃতিত্বের সাথে শিশু চিকিৎসা ও ডাক্তারি শ্বাস্ত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম মানের ডিগ্রি অর্জনের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, পিজি হাসপাতালসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহন, চিকিৎসা সেবা প্রদান, সর্বোপরি একজন সফল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। দেশ বিদেশে তার চিকিৎসার অনেক সুনাম রয়েছে। তিনি সফল হননি এমন ঘটনা তার জীবনে নেই বললেই চলে। শুধু বাংলাদেশেই নয় উপমহাদেশে তিনি শিশুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথিকৃত হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্যের জনক হিসেবেও তিনি সর্বজনস্বীকৃত।
অধ্যাপক ডা. এম আর খান ১৯৭৩ সালে ঢাকার আইপিজিএমআর-এ শিশুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় এমসিপিএস, ডিসিএইচ এবং এফসিপিএস কোর্স চালু করেন। তার অধীনে এ পর্যন্ত শত শত ছাত্র/ছাত্রী এখান থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করে দেশ বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সুনামের সাথে। ডা. এম আর খানের প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল- কীভাবে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পায়। এজন্য তিনি সরকারী বিভিন্ন হাসপাতালে থাকার সময়ও প্রাণপনে চেষ্ঠা করেছেন কীভাবে আরও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়। অবসর গ্রহন করে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন-ঢাকার গ্রীন রোডে সেন্ট্রাল হসপিটাল লি., মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এন্ড শিশু হসপিটাল, ধানমন্ডিতে নিবেদিতা মেডিক্যাল সেন্টার এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, উত্তরায় মেডিক্যাল কলেজ ফর উইমেন, সাতক্ষীরা ও যশোরে শিশু হসপিটালসহ আরো অনেক স্বাস্থ’সেবামুলক প্রতিষ্ঠান। তার হাতে গড়া সব প্রতিষ্ঠানেরই একটা আলাদা সুনাম রয়েছে।
সহৃদয়, সদালাপী, মিষ্টভাষী ও সমাজহিতৈষী এই মানুষটির ক্লান্তিহীন পথচলা। সততা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, আত্নবিশ্বাস, অধ্যবসায় ও নিরন্তর সাধনায় তিনি একক প্রচেষ্ঠায় আজ পৌছেঁছেন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:২৩