দেড় বছরের শিশু সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছে মা। রাজধানীর নর্দ্দা জগন্নাথপুর এলাকার একটি বাসা থেকে মা ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকালে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় গৃহবধূ ও বিছানায় গলাকাটা অবস্থায় তার দেড় বছরের মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পারিবারিক কলহের জের ধরে সন্তানকে হত্যা করে গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। গৃহবধূর নাম সারজিনা (৩০), শিশুকন্যার নাম আজিফা (১৪ মাস)। ঘটনার পর থেকে সারজিনার স্বামী আনিসুর রহমান আকাশ পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মেয়েকে হত্যা করে মা আত্মহত্যা করেছে- এমন খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর উৎসুক মানুষের ঢল নামে ওই বাড়িতে। গৃহবধূ সারজিনা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেখান থেকে অল্প কিছু দূরেই ভাড়া থাকেন তার বাবা-মা। গতকাল ওই বাসায় গেলে দেখা যায়, সারজিনার পিতা সফিক পাগলের মতো আচরণ করছেন। আর মা তোতা বেগম বিলাপ করছেন আর কপাল চাপড়ে চলেছেন। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সারজিনার স্বামী আকাশ আমার ছোট ছেলে সাবাসতিয়ানের মোবাইলে ফোন করে বলে- তোমার আপার মোবাইল খোলা কিন্তু ফোন ধরছে না। দেখ তো কি হয়েছে। এরপর সাবাসতিয়ান আমাকে ফোনে কথা বললে আমি তখনই সারজিনার বাসায় গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করি। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ কোন সাড়া দেয়নি। হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ঘুমিয়ে আছে বলে ১০-১৫ মিনিট পর আমি চলে আসি। কিছুক্ষণ পর আবার আকাশ ফোন করলে সারজিনার বাবা ওই বাসায় যায়। কিন্তু অনেক ডাকাডাকির পরও কোন সাড়া না দিলে মোবাইল ফোনে সে আমাদের ডেকে পাঠায়। আমরা গিয়ে সবাই মিলে অনেক ডাকাডাকি করি। পরে বাসার পেছনের একটা ফুটো দিয়ে একজন নির্মাণ শ্রমিককে ভেতরে কেউ আছে কি না তা দেখতে পাঠানো হয়। সে ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে পায় সারজিনা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। এরপর আমরা পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে সাড়ে ১০টার দিকে দরজা কেটে ভেতর থেকে লাগানো ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢোকে। আমরা পুলিশের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে দেখি সারজিনা ওড়না দিয়ে ফাঁস নিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। তার সারজিনার মেয়ের লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। সফিক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মেয়ের লাশ আর নাতনির লাশ একসঙ্গে দেখে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে আমার নাতনি আজিফার লাশ কোলে তুলতে গিয়ে দেখি তার গলা কাটা। সফিক আইসিডিডিআর,বি’র গাড়িচালক। তিনি বিলাপ করে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল তো কি হয়েছিল? তুই স্বামীকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে পারতি। আমি তোকে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছি আমি বাকি জীবনও তোকে বুকে আগলে রাখতে পারতাম। সারজিনার ছোট বোন মৌসুমি বলেন, আমার বোনের সঙ্গে তার স্বামী আকাশের মোবাইল ফোনে পরিচয় হয়। এরপর তারা উভয়ে পালিয়ে বিয়ে করে। আমরা বিয়ে মেনে না নিয়ে মামলা করি। মামলায় আকাশকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। কিন্তু আমার বোন বলেছিল আকাশকে ভালবেসে বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে সংসার করবো। তাই পরে আমরা বিয়ে মেনে নিই। মৌসুমি বলেন, বিয়ের সময় আকাশ আমার বোনকে বলেছিল তাদের ঢাকায় বাড়ি আছে, স্বর্ণের ব্যবসা আছে। কিন্তু পরে সেগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, ভালবেসে বিয়ে করায় সংসারে ঝামেলা হলেও এ বিষয়ে আমার বোন বাবা-মায়ের কাছে কিছুই বলতো না। সারজিনার মা বলেন, আমরা জানতাম সারজিনার স্বামী বনানীতে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করে। কিন্তু ৩-৪ মাস থেকে সে আর অফিসে যাচ্ছিল না। শুনেছি তার চাকরি চলে গেছে। এছাড়া সে বেশ কিছু লোককে চাকরি দেবে বলে টাকা নিয়েছিল। কিন্তু চাকরি না দিতে পারায় পাওনাদাররা বাসায় এসে আমার মেয়েকে নানা কথা শুনিয়ে যেতো। এ নিয়ে গত ৩ দিন সারজিনার স্বামী বাসায় আসেনি। তবে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে যখন সারজিনার সঙ্গে কথা হয় তখন সে জানিয়েছিল গত রাতে সে বাসায় আসবে। তিনি অভিযোগ করেন সারজিনার স্বামী হয়তো গভীর রাতে বাসায় এসে আমার মেয়েকে খুন করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে গেছে। এছাড়া আমার ছোট্ট নাতনিকেও সেই খুন করেছে। তা না হলে এতবড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও সে আসছে না কেন। তার মোবাইল ফোনও কেন বন্ধ থাকবে। জগন্নাথপুর এলাকার শহীদ হারেজ সড়কের ৭৮নং বাসার তেতলায় স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন গৃহবধূ সারজিনা আক্তার। ওই বাড়ির মালিক লোকমান হোসেন বলেন, ৫-৬ মাস আগে তারা বাসাটি ৬ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। তারা আগে থেকেই আমার পরিচিত ছিল। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন গোলমাল চলছিল কিনা তা জানি না। কোনদিন ঝগড়া বিবাদের কথা শুনিনি। তিনি বলেন, সকালে সারজিনার বাবা-মা এসে অনেক ডাকাডাকি করে কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয়নি। পরে পুলিশ এসে দরজা কেটে ভেতরে ঢোকে। তখন পুলিশের সঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখেছি সারজিনার লাশ ঝুলছে আর তার বাচ্চাটির লাশ মেঝেতে পড়ে আছে। পাশে একটি বঁটি রাখা। ২০নং বাসায় ভাড়া থাকতেন গৃহবধূ সারজিনা। ১৯ নম্বর বাসার ভাড়াটিয়া সাবিনা ইয়াসমিন ও তার স্বামী লিয়াকত আলী বলেন, প্রকাশ্যে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদের কথা শুনিনি। সারজিনাও এ বিষয়ে কোন কিছু আমাদের বলেনি। তারা বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১১টায়ও সারজিনার সঙ্গে তাদের কথা হয়। তখনও সারজিনার মন খারাপ বা তাকে বিচলিত মনে হয়নি। গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবীর জানান, ঘটনার সময় মা-মেয়ে ছাড়া বাসায় কেউ ছিল না। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার পর যে কোন এক সময় এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তিনি জানান, প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে এই দম্পতি বিভিন্ন স্থানে টাকা ধার করে চলছিল। পাওনাদারদের টাকা দেয়া না দেয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ চলছিল। ৩-৪ দিন ধরে স্বামী বাসায় আসছিল না। বাড্ডা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বলেন, নিহতের পরিবার মামলা করবে বলে জানিয়েছে। মামলা হলেই তদন্তে নামবে পুলিশ। এছাড়া সারজিনার স্বামী আকাশকে ধরতেও অভিযান চলছে।
সোর্স ঃ Click This Link