“তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস?” দাদু খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “না মানে, উত্তেজনার বশে এমন কিছু করিস না যাতে ছেলেটার ক্ষতি হয়!”
“ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে বাবা। তোমাকে তো আর সব কথা খুলে বলতে পারছি না।” পোলোর মা বিদিশা বহুদিন পরে তাঁর প্রিয় কাঁচা আম ফালি করে কেটে তাতে নুন, লঙ্কা মাখছিলেন, “নতুন করে আর কী ক্ষতি হবে বলো? আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমরা যদি এখানে থেকে মানুষ হতে পারি, পোলো কেন পারবে না? ভাল যে হওয়ার, সে সব জায়গা থেকেই হবে বাবা। আমি তো এই মধুবন থেকেই জয়েন্টে তেতাল্লিশ র্যাংক করেছিলাম। কল্যাণও ওদের বীরভূমের গ্রাম থেকেই। কী ক্ষতি হয়েছিল আমাদের? জীবনে সফল হইনি?”
“সমস্যাটা সেখানে নয়।” দাদু বোঝাতে চেষ্টা করলেন, “যুগ পালটেছে। এখন কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে বাজিমাত করাই সকলের পাখির চোখ। আর সবচেয়ে বড় কথা, পোলো সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে এতদিন ছিল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই লন্ডনে, তারপর এই ছ-সাতটা বছর কলকাতায়, আগাগোড়া ইংরেজি মাধ্যমের আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়াশোনা করছে। ক্লাস সেভেন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়, এইসময়ে ভিত ভালমত তৈরি করতে হয়। আর এখনই যদি তুই ওকে ওর পুরো শিকড় থেকে উপড়ে নিয়ে এসে আমাদের এই গণ্ডগ্রামে রেখে চলে যাস, সেটা কি ...!”
মা কথার মাঝে বাধা দিলেন, “শিকড়? শহরের অত্যাধুনিক বারফট্টাই দেখানো, স্মার্ট ফোনে ডুবে থাকা, সারাদিন ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থেকে একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বাস করে স্বার্থপর তৈরি হওয়া, এইটা শিকড়?”
দাদু চুপ করে রইলেন, কোনো কথা বললেন না।
বিদিশা দ্রুত মাথা নাড়লেন, “না বাবা, এইটা পোলোর শিকড় নয়। আমরা ছোটবেলায় দুষ্টু ছিলাম, কিন্তু চিৎকার করে বাবা মা'কে বাজে গালাগাল দিতাম না, বন্ধ ঘরে ঢুকে অন্ধকার ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ঘোরাফেরাও করতাম না। বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়নো, শীতের নতুন আলু ক্ষেত থেকে তুলে সবাই মিলে মাঠে গোল হয়ে বসে খোসা ছাড়িয়ে নুন লঙ্কা দিয়ে পুড়িয়ে খাওয়া, বুড়িবসন্ত এই সব নিয়েই থাকতাম। আমি বলছি না যে যুগের সঙ্গে তাল মেলানোটা খারাপ, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমাদের ছোটবেলাটা অনেক সুন্দর ছিল বাবা! আমি বা কল্যাণ, দুজনেই এখন চাই পোলো শুধুমাত্র একজন ভাল মানুষ হোক। সফল, ঝাঁ চকচকে কেরিয়ার, ওসব কিচ্ছু চাইনা, একজন ভাল সংবেদনশীল মানুষ হলেই আমরা ধন্য হয়ে যাব বাবা! তুমি আর প্লিজ না কোরো না। জীবনে একটা আঘাত এমনিতেই পেয়ে গেছি, আরো একটা আঘাতের আগেই সেটা শুধরে নিতে চাই।”
দাদু আর কিছু বললেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বেশ, তাই হবে। তোরা থাকতে পারবি তো?”
বিদিশার চোখ এবার ছলছল করে উঠল, প্রাণপণে নিজেকে সংবরণ করে আমের আচার বানানোতে মন দিলেন তিনি, “পোলোর ভালর জন্যই আমাদের পারতে হবে বাবা। এমনিতেই এখন আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি ছ’মাসের জন্য, কল্যাণ অফিসের মাঝে একা ওকে সামলাতে পারবে না। পোলোর একটা পরিবার দরকার বাবা। আমাদের দুজনেরই যা কাজের চাপ, সেটা আমরা ওকে দিতে পারছি না। আরো ভুল করেছিলাম যা চেয়েছে তা-ই দিয়ে, নিজেদের সময় না দেওয়াটাকে এইভাবে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজেরাই ঠকে গেছি বাবা!”
পর্দার আড়াল থেকে গোটা কথোপকথনটা শুনছিল পোলো। শুনতে শুনতে রাগে প্রথমে ওর ফর্সা কানদুটো লাল হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিলো এক ছুট্টে গিয়ে মা’কে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
কিন্তু তারপর শেষের দিকে মা’র দৃঢ় সিদ্ধান্ত শুনে গলার ভেতরটা যেন কী একটা দলা পাকিয়ে উঠল ওর। ঠোঁটটা কাঁপছিল তিরতির করে, নাকের পাটাটা ফুলে উঠছিল ঈষৎ।
সত্যিই মা ওকে এই জঘন্য জায়গায় রেখে চলে যাবে? এটাও সম্ভব? ওর কাছে কোনো স্মার্ট ফোন তো দূর, কোনো মোবাইলও থাকবে না?
কম্পিউটার, ভিডিও গেমস, প্লে-ষ্টেশন কিচ্ছু না? বিবস্বান, রাজর্ষি, তপোব্রত, ওদের সঙ্গে আর হ্যাং আউট করা হবে না? আর ওদের বন্ধুদের যে চ্যাটিং এর গ্রুপগুলো? সেখানেও পোলোর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না?
কী এমন করেছে ও, যার জন্য ওকে এতবড় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? নিজের গালে আবার একটা ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে হল পোলোর, কেন সেদিন ও আরো একটু সাবধান হয়নি? কেন ভুলে গিয়েছিল সেদিন মা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে?
কনুইয়ে একটা আলতো খোঁচা পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল পোলো।
ওফ, সেই গেঁয়ো ভুত মেয়েটা। কী যেন নাম, পোলো মনে করতে চেষ্টা করলো। মা প্রথমদিন এসেই বলেছিলেন, “পোলো, এই হল তোমার মামার মেয়ে টিয়া, তোমার একমাত্র ছোট বোন। তুমি ওকে বোনু বলে ডেকো, কেমন?”
সেদিনের কথা মনে পড়তেই মুখ বেঁকাল পোলো। এহ, ঢলঢলে একটা ফ্রক, গরুর মত চোখ, কানে গোল গোল দুলের এই ক্যাবলা মেয়েটা ওর বোন? কক্ষনো নয়। এমন কারুর সঙ্গে বোন পাতানো তো দূর, পোলো কথাই বলে না। ওদের স্কুলে এর থেকে ছোট ছোট মেয়েগুলোও কত ফিটফাট, আর এই মেয়েটার কোনো স্মার্টনেস আছে?
ও রুক্ষভাবে ইংরেজিতে বলল, “কী হয়েছে? গায়ে হাত দিচ্ছ কেন তুমি?”
টিয়া একটু গুটিয়ে গেল। না, পোলোদাদা ইংরেজিতে বলল বলে নয়, ইংরেজি সে ভালই বোঝে, এইবার ওয়ান থেকে টু’তে ওঠার পরীক্ষায় তিরানব্বই পেয়েছে, আর এইটুকু ইংরেজি বুঝবে না? কিন্তু পোলোদাদা সবসময় কেমন যেন রেগে থাকে। এক সপ্তাহ হয়ে গেল এসেছে, তবু ওর সঙ্গে একটুও ভাল করে কথা বলছে না।
যাই হোক, টিয়া বেশি মাথা ঘামাল না, বাবা তাকে বলেছেন, পোলোদাদা পাকাপাকিভাবে এখন এখানেই থাকবে, পিসি ওকে রেখে চলে যাবেন। কী মজা! ভাবলেই আনন্দে পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠছে টিয়ার, বাড়িতে একটা জলজ্যান্ত দাদা থাকার যে কী আনন্দ! একসঙ্গে খেলবে, একসঙ্গে পড়বে, রুমেলার দাদার মত পোলোদাদাও ওর জন্য গাছ থেকে আম পেড়ে দেবে। দামোদরের পাড়ে যাওয়ার জন্য তখন আর কাউকে ডাকতে হবে না, ভাইবোনেই চলে যাবে, কেউ বকবে না।
বাবার কাছে কথাটা শুনেই সে আনন্দে তাই ছুটে এসেছে এখানে, “পোলোদাদা, তুই আমাদের সঙ্গে এখানেই থাকবি? কী মজা! আমরা একসাথে স্কুল যাব, গাজন দেখতেও যাব, কেমন? হি হি!”
পোলো এবার দাঁতে দাঁত চিপলো, “ননসেন্স একটা!”
নিমেষে হাসি উবে গিয়ে টিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। ননসেন্স মানে তো যার সেন্স নেই, কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। টিয়াকে ননসেন্স কেন বলল পোলোদাদা?
পোলো আর দাঁড়ালো না, দুম দুম করে পা ফেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। ওর দাদুর এই বাড়িটা প্রকাণ্ড বড়, সামনে পেছনে বিশাল বাগান, তাতে বড়বড় গাছ, তার পাশেই পুকুর, পুকুরের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে সবুজ ধানের ক্ষেত। এই গ্রামের সবচেয়ে বড় পাকা বাড়ি এটা। ওর দাদু এই গ্রামের সবচেয়ে ধনী এবং মান্যগণ্য ব্যক্তি।
পোলো একটা গাছের তলায় গিয়ে বসে পড়ল। ওর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। একটু ইন্টারনেট সার্ফ করে যে অবসাদটা কাটাবে সে উপায়ও নেই। মা চিরতরে ওর কাছ থেকে স্মার্ট ফোনটা কেড়ে নিয়েছেন। বিদ্রোহ যে ও করেনি তা নয়, সব রকম ফর্মুলাই প্রয়োগ করেছে । খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, রাগে আক্রোশে নিজের বইগুলো কুটিকুটি করেছে, বাবার ট্যাবটা ছুঁড়ে ভেঙেছে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। মা-বাবা দুজনেই যেন কেমন হয়ে গেছেন, ওর প্রতি তাঁদের যেন আর কোনো ভালবাসাই নেই! এইসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলের কোনো দামও তাই নেই।
পোলো চোখের জলটা মুছে নিয়ে দূরের দিকে তাকাল। দূরে ধানের ক্ষেতে কয়েকটা লোক জল দিচ্ছে। দাদু বলেছেন, ওদের বলে মুনিশ। ওরা অনেক দূর থেকে এসে বছরের এই সময়টায় এই গ্রামে থাকে, জমিতে খেটে পয়সা পায়। পোলো তেতো চোখে চেয়ে রইল।
বর্ধমান থেকে দামোদর নদীর দক্ষিণ দিকের পাড় বরাবর এগোতে লাগলে ছোট ছোট অজস্র গ্রাম পড়ে। একদিকে দামোদরের বালির চর, মাঝে কাঁচা এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা, আর অন্যদিকে গ্রাম। তেয়ান্ডুল, ধামাস, পলেমপুর ... আরো কী সব গ্রামের নাম!
গাড়িতে করে আসার সময় দাদুর গাড়ির ড্রাইভার বনমালীদাদুর কাছ থেকে সোৎসাহে নামগুলো ও জেনেছিল। তখন তো আর জানতো না, মায়ের আসল প্ল্যানটা কি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই প্রথম মামার বাড়ি আসছে, সেই আনন্দেই মশগুল ছিল পোলো। মা ওর পাশে চুপচাপ বসেছিলেন, দামোদরের চর শুরু হতেই উদাস চোখে তাকিয়েছিলেন সেদিকে।
তেয়ান্ডুল আর গোপালনগর গ্রামদুটো পেরোলেই ওর দাদুর এই গ্রাম, মধুবন। মধুবন নামেই গ্রাম, আসলে অজপাড়াগাঁ বললেও অত্যুক্তি হয় না। পাকা রাস্তা একটাও নেই, একটা মোটে প্রাইমারী স্কুল আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে, হাই স্কুল পাশের গ্রাম বোড়োতে। খুব গরীব গ্রাম, এখানকার লোকজনের অধিকাংশেরই জীবিকা চাষবাস, এছাড়া গরু-ছাগলও পোষে অনেকে।
পোলোর মা বিদিশা এই মধুবন গ্রামেরই মেয়ে। বিদিশার বাবা অর্থাৎ পোলোর দাদু অনাদিচরণ মল্লিক বর্ধমান শহরে চালের গদি করে প্রচুর পয়সা করেছিলেন, তবু পূর্ব পুরুষের এই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাননি। বরং, নিজের আর্থিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব গ্রামটার সংস্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মধুবনের এই প্রাইমারী স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সব অনাদিচরণের উদ্যোগেই বানানো, স্কুলবাড়িটার জমিও তিনিই দান করেছিলেন।
বিদিশা এই অখ্যাত গ্রামে জন্মেও খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। অনাদিচরণ পড়াশুনোয় মেয়ের মাথা দেখে একটা আলাদা গাড়ি কিনেছিলেন শুধু মেয়েকে বর্ধমান শহরে স্কুল বা টিউশনিতে দিয়ে আসা-নিয়ে আসার জন্য। এখান থেকে বর্ধমান শহর গাড়িতে দামোদরের পাড় দিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক, রাস্তা যদিও খুব খারাপ।
বিদিশা নিরাশ করেননি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট, সঙ্গে জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিং এ দুর্দান্ত র্যাংক করে পড়তে চলে গিয়েছিলেন যাদবপুরে, তারপর সেখান থেকে চাকরি পেয়ে কলকাতাতেই ছিলেন, ছুটিতে বাড়ি আসতেন। কল্যাণকে বিয়েটাও তখনই করেন বিদিশা। কল্যাণ বীরভূমের ছেলে, তিনিও যাদবপুরে বিদিশার সহপাঠী ছিলেন। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই পোলো জন্মায়, তার বছরকয়েকের মধ্যেই দুজনে প্রোজেক্টের কাজে পাড়ি দেন লন্ডন।
এইসবই পোলো গল্পচ্ছলে জেনেছে দাদুর কাছ থেকে। লন্ডন থেকে ফিরে বিদিশা আর কল্যাণ রাজারহাটে যখন একটা বিশাল ফ্ল্যাট কেনেন, তখন পোলোর বয়স পাঁচ কি ছয়। লন্ডনের স্মৃতি পোলোর আবছা মনে পড়ে। বাবা মা কলকাতায় দুজনেই চরম ব্যস্ত, পোলো বেড়ে উঠছিল আয়ামাসির সাহচর্যে, স্কুল, বন্ধু, মোবাইল, কম্পিউটার নিয়ে।
কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন।
পোলো আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেদিন ও আর বিবস্বান স্কুল কামাই করে ফ্ল্যাটে বসে যখন তামাক আর গাঁজার জয়েন্টটা বানাচ্ছিল, ঠিক সেইসময়েই মা এসে না পড়লে কি আজ ওর এত বড় সর্বনাশ হত? ও তো তেমন অভ্যাস করেও ফেলেনি, বিবস্বানই যা শেখাচ্ছিল। কিন্তু মা কিছুতেই ওর কথা বিশ্বাস করলেন না।
পোলো হঠাৎ দেখল, একটা ছেলে এদিকে আসছে, বেশ হাসি হাসি মুখেই। গ্রামের লোকজনদের নিয়ে এই এক মুশকিল, যখন তখন যেখানে এসে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বকবক করা শুরু করে দেবে। প্রাইভেসির কোনো ধারণাই যেন এদের মধ্যে নেই।
ছেলেটা কাছাকাছি আসতে পোলো একটু চমকে উঠল। বয়স ওরই মত হবে, তেরো কি চোদ্দ, মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো, মুখটা হাসি হাসি। মুখটাও অনেকটা ওরই মত যেন, চোখগুলো বড় বড়। বলল, “তুমি পোলো, না?”
পোলো ভ্রূ কুঁচকোল। মধুবনে আসা ইস্তক গ্রামের অনেক মানুষজন যেচে এসে ওকে দেখে যাচ্ছে। ওদের কথায় পোলো ‘বিলেতফেরত’ বলে কথা, তায় গ্রামের মেয়ে বিদিশার ছেলে! ওর থুতনি নেড়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গাছের কলাটা, লিচুটাও দিয়ে যাচ্ছে কিছু লোকজন।
বিরক্তিকর!
পোলো তবু মুখে শিষ্টতা বজায় রেখে বলল, “আমার ভাল নাম দীপঙ্কর বসু। তোমার নাম কী?”
ছেলেটার গায়ে একটা টি-শার্ট, এই একই রঙের আর ডিজাইনের টি-শার্ট পোলোরও রয়েছে, বাবা কিনে এনেছিলেন সিঙ্গাপুর থেকে। ছেলেটা ফিক করে হেসে ফেললো, “দীপঙ্কর! সিনেমা করত না ওই নামে একজন?”
পোলো এবার গম্ভীর হয়ে গেল। এইসব অশিক্ষিতদের সঙ্গে ওকে এখন কাটাতে হবে দিনরাত, ভাবলেই রাগ হচ্ছে। কোনো সাধারণ জ্ঞান নেই, ক্রিকেট – ফুটবল, দেশবিদেশের খবর রাখা নেই, এখনো সেই বস্তাপচা বাংলা সিনেমাতেই পড়ে আছে।
দাদু মানুষটা এমনিতে ভাল, এই বাড়িতে একটা বিশাল লাইব্রেরী আছে, প্রথম দিনই পোলোকে সেই লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে সব বই দেখিয়েছেন।
কিন্তু এখন পোলোর আর বই পড়তে তেমন ভাল লাগেনা। অথচ ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত কিন্তু ও প্রচুর গল্পের বই পড়ত, কিন্তু তারপর থেকে সেই সময়টায় থাবা বসিয়েছে মোবাইল। এখন আর বইতে মনোযোগই দিতে পারে না, একটু সময় অন্তরই মনে হয়, দেখি তো নতুন কী মেসেজ এল, নতুন কে কি ছবি পাঠাল! এই করে করে পড়াশুনোতেও ব্যাঘাত হয় বেশ।
কিন্তু এখন চাইলেও মোবাইল ল্যাপটপ পাবে না পোলো। এমনকি হাতে টাকা পর্যন্ত পাবে না, মা দাদুর কাছে টাকা রেখে যাবেন, প্রয়োজনে দাদুই কিনে দেবেন যা লাগবে, মায়ের এমনই আদেশ।
পোলো ছেলেটার দিক থেকে মুখ ঘোরাতে গিয়েও একবার তাকাল। ছেলেটার প্যান্টের বাঁ পকেটে উঁচু হয়ে রয়েছে একটা জিনিষ, কি ওটা?
*****
বিদিশা চলে গেলেন দু’সপ্তাহ পরের এক বিকেলে। যাওয়ার আগে ছেলেকে জড়িয়ে বললেন, “আমি জানি তুই আমার ওপর খুব রেগে আছিস। কিন্তু যদি সত্যিই মধুবনে মিশে যেতে পারিস, বড় হয়ে বুঝবি মা তোর ভালই করেছে। আমি আর তোর বাবা দুজনেই তোকে ছেড়ে খুব কষ্টে থাকবো পোলো!” বিদিশার গলা ধরে এল, “যখন যা দরকার, দাদুকে, মামাকে কিংবা মামিমাকে বলবি। এঁরা সবাই তোকে খুব ভালবাসেন। আর ...!” বিদিশা সামান্য থামলেন, “আর ওসব নেশাও করিস না, ওতে শরীরের ক্ষতি হয়, মনেরও।”
পোলো উত্তর দিল না।
বিদিশা আরো একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে, “নতুন স্কুল, মন দিয়ে পড়াশুনো করবি। আমরা পুজোর সময়েই আসব। তখন দেখবো আমার পোলোবাবু কত বড় হয়ে গেছে।”
পোলো একইরকম গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোট থেকেই সে গোঁয়ার প্রকৃতির, কষ্ট হলে কাঁদতে পারে না, তখন রাগ বা মাথাগরম করে বাড়ি মাথায় তোলে।
মা’র গাড়িটা ছোট হতে হতে দামোদরের তীর বেয়ে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। দাদু পোলোর মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভেতরে চলো, দাদুভাই।”
পোলো কান্নাটাকে অনেক কষ্টে গিলছিল, শুধু বলল, “তুমি যাও, আমি আসছি।”
দাদু ভেতরে চলে যেতে ও একটা শক্ত পেয়ারা গাছের ডাল নিয়ে পুকুরপাড়ে হাঁটতে লাগলো। দশদিন হল ও নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এই মধুবনে কোনো হাই স্কুল নেই, পাশের গ্রাম বোড়োতে থাকলেও পোলোর পক্ষে এই বয়সে বাংলা মিডিয়ামে মানিয়ে নেওয়াটা খুব মুশকিল, দাদু আর মা ওকে তাই বর্ধমান শহরের এক ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করেছেন। সকালবেলা গাড়ি করে যায়, বিকেলবেলা সেই গাড়িতেই ফেরে।
পেছন থেকে কার পায়ের শব্দে পোলো চমকে পেছনে তাকাল, “অতীশ, এসে গেছিস?”
সেদিনের সেই ছেলেটা একটা আখ চিবোতে চিবোতে এল, “হ্যাঁ। তোর কান্না শেষ হল? দামোদর তো এবার উপচে পড়বে তোর চোখের জলে!”
পোলো তড়িৎ গতিতে চোখ মুছে নিল, কই ও তো কাঁদেনি, চোখদুটো ছলছল করছিল শুধু, এই অতীশ বলে ছেলেটা মহা পাজী। ও মুখে বলল, “তুই সেদিন বললি আমি পুরো চাঁদের পাহাড় নাকি শেষ করতে পারব না। দাদুকে জিজ্ঞেস কর আমি দুদিনে পুরোটা শেষ করেছি।”
কথাটা সত্যি। মা অবধি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যে ছেলে বইয়ের ধারেকাছে যেত না, সে খেতে বসেও বই পড়ছে, মোবাইলের জন্য বায়না করতেও ভুলে গেছে। পোলোও অবাক, বাংলায় এত ভাল বই যে আছে, ও জানতোই না!
অতীশ হাসল, “তাই? বল তো, ভিক্টোরিয়া হ্রদের পাশের কোন বন্দরে শঙ্কর আর আলভারেজ নেমেছিল?”
“উমম...!” পোলো একটু ভেবে বলল, “মোওয়ানজা।”
“ওখান থেকে কোথায় গিয়েছিল ওরা?” অতীশের বুলেটের মত প্রশ্ন ধেয়ে এল।
“উজিজি বন্দরে। টাঙ্গানিয়াকা হ্রদের পাশে।”
“হল না।” অতীশ বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল, “উজিজি গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ট্যাবোরা বলে একটা জায়গায় কয়েকদিন থাকার পর।” অতীশ আঙুল নাড়ল, “দশে পাঁচ। আজকে পাবি না।”
“দে না ভাই।” পোলো এবার একটু পাশে সরে এল, “ঠিক দশ মিনিট খেলব। দে না!”
অতীশ প্যান্টের পকেটে উঁচু হয়ে থাকা মোবাইলটা এবার বের করে পোলোর দিকে বাড়িয়ে দিল, “মাত্র পাঁচমিনিট।”
এত এঁদো গ্রামের ছেলে হয়ে অতীশের কাছে কি করে লেটেস্ট মডেলের আইফোন এল, এটা পোলোর কাছে চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। জিজ্ঞেস করলেও শুধু বলে, “আমার বাবা-মা মস্ত চাকরি করে, আমি এখানে মামারবাড়িতে থাকি। বাবা-মা’ই এগুলো পাঠায়।”
“কি ভাল রে তোর বাবা-মা!” পোলো ঈর্ষার চোখে তাকায়।
অতীশ শুধু মিটিমিটি হাসে। শুধু লেটেস্ট আইফোনই নয়, অতীশের অনেক কিছুই অদ্ভুত। তার ফোনে কোনো সিমকার্ড নেই, অথচ ইন্টারনেট চলে ঝড়ের গতিতে। কি ওয়াই-ফাই কানেকশন কে জানে? তার ওপর পোলো চাঁদের পাহাড় পড়লে অতীশের যে কী উপকার হবে সেটা ও এখনো বুঝতে পারে না।
অতীশও নাকি ক্লাস সেভেনেই পড়ে, বর্ধমানেরই কোন এক অন্য স্কুলে। ট্রেকারে করে স্কুল যায়, ইদানীং পোলো ওঠার আগেই গাড়িতে উঠে বসে থাকে, আবার পোলো নামার সময় ওর সাথে নেমে চলে যায়। রোজ নয়, মাঝে মধ্যে।
পোলো যতই এখানকার লোকেদের অপছন্দ করুক, এর মধ্যে অতীশের সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে। ছেলেটা একটু অদ্ভুত, কিন্তু ভালই। এর মধ্যে দুদিন দুজনে মিলে দামোদরের তীরে গিয়েছিল। নদীর পাড় যে এত নির্জন হয়, পোলোর কোনো ধারণাই ছিল না। দুজনে মিলে সেদিন অনেক গল্প করেছিল।
ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট হতে না হতেই অতীশ ঝুঁকে পড়ে ফোনটা নিয়ে নিল।
পোলো হাঁ হাঁ করে উঠল, “ইশ! একেবারে ফাইনাল রাউন্ডে চলে গেছিলাম, দে না আরেকটু!”
“আবার কাল।” অতীশ চোখ নাচাল, “আজ রাতে বাবাকে ইমেল করবি, তারপর।”
“কিসের ইমেল?” পোলোর বলতে না বলতেই মনে পড়ল। উফ, অতীশের এখন দাবী, প্রতি সপ্তাহে বাবামা’কে একটা করে ইমেল করতে হবে। কতদিন ও ঠিক করে বাবা-মা’র সঙ্গে কথাই বলে না, আর সেখানে ইমেলে কী লিখবে? পোলোর মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। আবার আজ পিন্টুমামার কাছে যেতে হবে।
মা যাওয়ার সময় পাশের বাড়ির পিন্টুমামাকে বলে গিয়েছেন, খুব দরকারে, স্কুলের কোনো প্রোজেক্টের কাজে যেন পোলোকে ওর কম্পিউটারটা ব্যবহার করতে দেয়। পিন্টুমামা কম্পিউটারে নানারকমের ফর্ম ফিলাপ করে দেয় লোকজনের। পিন্টুমামা একগাল হেসে বলেছিল, “কিচ্ছু চিন্তা করবি না বিদিশা দি। খেলতে বা অন্য কিছু করতে দেখলেই মাথায় এক চাঁটি দিয়ে দেব।”
রাগে অপমানে পোলোর কানদুটো লাল হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ও ভাবতে পারত, পাশের বাড়ির কেউ এই কথাটা বলছে?
মা বুঝতে পেরে ওর চুল ঘেঁটে দিয়েছিলেন, “গ্রামে সবাই সবাইকে ভালবাসে পোলো। এখানে সবাই নিজেদের মত। সবাই তোর ভাল চায়, বুঝলি? দেখবি কোন বিপদ আপদেও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
পোলো কতক্ষণ পুকুরপাড়ে বসেছিল কে জানে, চমক ভাঙল টিয়ার ডাকে, “পোলোদাদা, তুই এখানে? মা সারা বাড়ি খুঁজছে। খাবি চল।”
পোলো উত্তর দিল না। সন্ধ্যেবেলা খাওয়া মানে নয় মুড়ি-তরকারী, নয় তো চিঁড়ে-দুধ। আর কলকাতায় এইসময়? বাবা মা আসতে আসতে রাত ন’টা সাড়ে ন’টা। এখন কোনো মলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্যান্ডউইচ, পিৎজা কিংবা বার্গার, সঙ্গে কোল্ড ড্রিংক।
দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করে পোলোর। কথা না বাড়িয়ে সে পায়ে পায়ে এগোয় টিয়ার সাথে।
টিয়া মেয়েটা খুব গায়ে-পড়া ধরণের। পোলো পাত্তা দেয় না, তবু সারাক্ষণ এসে বলবে, “পোলোদাদা, গল্প কর না!”
এইটুকু পুঁচকে মেয়ের সাথে কী গল্প করবে পোলো? না জানে কোনো গেমস, না রাখে কোনো খবর!
আজকেও পড়াশুনোর পাট চুকতে না চুকতেই টিয়া চলে এল, “পোলো দাদা, গল্প বল না একটা!”
পোলো চুপ করে রইল। এই বাড়িতে সারাক্ষণ গুচ্ছের লোক। দাদু, মামা, মামিমা, টিয়া তো রয়েইছে, এছাড়া ব্যবসার কাজে একবার এই লোক, একবার ওই লোক আসছেই। তাছাড়া পাশের বাড়ির কাকিমা, দিদিমা তারা প্রায়ই তরকারীর বাটি হাতে চলে এসে গল্প জুড়ে দেয় মামিমার সাথে। সকাল হলে কিছু বুড়ো চলে আসে, তারা দাদুর সাথে বৈঠকখানায় বসে চা খায় আর গল্প করে।
এতদিন শুধু বাবা মা’কে নিয়ে বড় হওয়া পোলো যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
মামিমা হেসে বললেন, “পোলোদাদা রোজ রোজ গল্প বলতে পারবে না টিয়া। তুমি এখানে এসে চুপটি করে বোসো।”
টিয়া চলে যাচ্ছিল, পোলোর মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, “একটা গল্প শুনবি? চাঁদের পাহাড়?”
টিয়া চোখ বড়বড় করে পোলোর গা ঘেঁষে বসলো, “চাঁদের পাহাড়? কোথায় রে সেটা পোলোদাদা? চাঁদে? তুই গিয়েছিস? ওই লন্ডন থেকে কাছে বুঝি?”
“বেশি কথা না বলে চুপটি করে বোস।” পোলো গল্প কাউকে কখনো বলেনি, তবু গুছিয়ে বলতে চেষ্টা করে, “শঙ্কর বলে একটা ছেলে ছিল ...।”
*******
প্রায় তিনমাস কেটে গেছে। পোলোর আর তেমন দুঃখ হয়না। নতুন স্কুলে সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে, অতীশ আর ও প্রায়ই একসঙ্গে স্কুল যায়, বাড়ি এসে পড়াশুনো, হোম ওয়ার্ক শেষ করেই টিয়াকে রোজ একটা করে গল্প বলতে হয়। নইলে মেয়েটা কিছুতেই খাবে না।
ওদিকে অতীশের জ্বালায় পোলো নয় নয় করে প্রচুর বই পড়ে ফেলেছে। ইদানীং অতীশের মোবাইলে আর খেলাও হয়না, কি বই পড়েছে, তাই নিয়ে আলোচনা করতে করতেই সময় চলে যায়। প্রথম প্রথম পিন্টুমামার কম্পিউটারে গিয়ে পোলো খুটখাট করত, ফাঁকা পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করতে নিশপিশ করত হাত, এখন আর স্কুলের প্রোজেক্টের কাজ ছাড়া ওদিকে যাওয়াই হয় না। নিজে পড়া, টিয়াকে পড়া দেখিয়ে দেওয়া,
অতীশের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, গল্পের বই সময় হু হু করে কেটে যায়।
একদিন পোলো স্কুল থেকে ফিরে সবে হাত মুখ ধুয়ে ভাবছে দামোদরের দিকে একটু বেড়িয়ে আসবে। আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে, খেলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। অতীশ নির্ঘাত ওখানেই আছে। এমন সময় দাদু গম্ভীর গলায় বৈঠকখানা থেকে ডাকলেন, “দাদুভাই, শোন একবার!”
পোলো ঘরে ঢুকে দেখল ড্রাইভার বনমালীদাদু অপরাধীর ভঙ্গীতে মাথা নিচু করে বসে আছে। কি ব্যাপার? অন্যদিন তো বনমালীদাদু পোলোকে নামিয়েই গাড়ি গ্যারাজে রেখে চলে যায়, আজ আবার কী হল?
পোলো বলল, “কী হয়েছে দাদু?”
দাদু একবার বনমালীর দিকে তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন, “তুমি গাড়িতে যেতে যেতে নিজের মনে বকবক করো?”
“নিজের মনে?” পোলো অবাক, “কই নাতো!”
বনমালীদাদু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আজই তো সারাটা গাড়ি বকে গেলে পোলো। মাঝেমাঝেই এমন করো, আমি কিছু বলি না, কিন্তু আজ না বলে পারলাম না। মাথার ব্যামো ট্যামো হচ্ছে নাকি?”
“ওহ! একা কেন বকব?” পোলো রাগত স্বরে বলল, “অতীশ ছিল তো। ওর সঙ্গেই গল্প করছিলাম দাদু।’
“অতীশ?” দাদু চমকে তাকালেন ওর দিকে, “কে অতীশ? কাদের বাড়ির ছেলে?”
এই তিনমাসেই পোলো বুঝেছে, গ্রামের লোকেরা কারুর সম্পর্কে জানতে গেলে আগে কোন বাড়ির সেটা জানে। ও মাথা চুলকোল, “কোন বাড়ির তা তো জানি না। দামোদরের পাশেই ওর বাড়ি। বর্ধমানের একটা স্কুলে পড়ে। এখান থেকে ট্রেকারে যায়, মাঝেমধ্যে আমার সাথে গাড়িতেও যায়।”
যেটা ও বলল না সেটা হল, ওই অতীশের পাল্লায় পড়েই আগের সপ্তাহে দাদুকে আর টিয়াকে নিয়ে ওকে গাজনের মেলা দেখতে যেতে হয়েছে। খারাপ লাগেনি অবশ্য! বিশেষ করে টিয়াকে যখন ও একটা লাল রঙের পুতুল কিনে দিল, টিয়ার তখন সে কি আনন্দ!
“এখান থেকে আর কাদের ছেলে বর্ধমানে পড়তে যায় বনমালী?” দাদু চিন্তান্বিত স্বরে তাকালেন।
“আজ্ঞে পোলোবাবু ছাড়া কেউ যায় না। আমি হলফ করে বলতে পারি। এই গ্রামে কারুর অত পয়সা নেই।” বনমালীদাদু সাফ জানাল।
পোলো এবার বিরক্ত হয়ে উঠল, “বনমালীদাদু, তোমার অ্যান্টেনায় জং ধরেছে, তুমি জানো না।” ও দাদুর দিকে তাকাল, “আমি চললাম দাদু। দেরি হয়ে যাচ্ছে। অতীশ আর আমি আজ ডাংগুলি খেলব। এসে পড়াশুনো আছে, বোনুকেও পড়াতে হবে।”
পোলো যেতে উদ্যত হতেই দাদু উঠে দাঁড়ালেন, “দাঁড়া! কে এই অতীশ? তুই আমাকে তোর সাথে নিয়ে চল। এই নামে এখন আর এই গ্রামে কেউ নেই।” শেষ বাক্যটা বলার সময় দাদুর গলাটা যেন ঈষৎ কেঁপে গেল।
পোলো কাঁধ নাচাল, “ঠিক আছে। চলো তাহলে। অতীশ তো তোমার কথা প্রায়ই বলে। কিভাবে তুমি কয়েক বছর আগে বড় বাঁধ তুলে বন্যার হাত থেকে মধুবনকে বাঁচিয়ে ছিলে, কিভাবে তুমি দুর্গামণ্ডপে সন্ধ্যারতি করো, সব ...!”
দাদু, বনমালীদাদু আর পোলো বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। শেষ মুহূর্তে টিয়াও যাওয়ার জন্য বায়না করায় পোলো ওকে কোলে তুলে নেয়। টিয়া বলে, “কাল ঝড়ে খুব বেশি আম পড়েনি। আসার সময় আমায় পেড়ে দিবি কিন্তু দাদা!”
“দেব। এখন চল। আর একটা দাদা আছে, একসঙ্গে খেলবো।” পোলো হাঁটতে থাকে। অতীশ টিয়াকে দেখলে খুশিই হবে, রোজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় ওর কথা। পোলোর দেখাদেখি অতীশও ওকে বোনু বলে ডাকে আজকাল।
বাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া কাঁচা রাস্তা, এই পথ দিয়েই স্কুল যায় পোলো আর অতীশ। রাস্তার ওপারেই বালির চর, দামোদর নদী।
বালির চর মানে বিস্তীর্ণ একটা অঞ্চল, যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। তার মাঝে ইতিউতি গজিয়ে রয়েছে একেকটা করে ছোটবড় গাছ। সেই গাছতলাগুলো সামান্য সবুজে ঢাকা। দূরের নদীতে যতদূর চোখ যায়, কেউ কোথাও নেই।
“কোথায় তোর অতীশ?” বালির চর শুরু হওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন দাদু।
“এই তো, এসো না আমার সাথে।” পোলো হাত দেখিয়ে নিয়ে যায়, “ওই যে দূরে জাম গাছটা, ওখানেই বসে আছে অতীশ।”
দাদু যেন হঠাৎ জ্বরে কাঁপতে শুরু করেছেন, “জাম গাছ? তুই গাছ চিনলি কি করে পোলো?”
“অতীশই বলেছে তো!” পোলো ছুটে এগিয়ে যায় সামনের দিকে, “এসো আমার সঙ্গে।”
“দাঁড়া পোলো!” দাদু কাঁপতে কাঁপতে হাত দেখান, “যাস না ওদিকে!”
পোলোর কানে কথা যায় না। সে টিয়াকে নামিয়ে দিয়ে ছুটতে থাকে রুদ্ধশ্বাসে। অতীশ আর ওর এই মিটিং পয়েন্টটা ওর ভারী প্রিয়। ওই জাম গাছের তলায় বসেই দুজনে কত গল্প করেছে, কত বই, কত খেলা করেছে।
চৈত্রমাসের ভরদুপুর। শুনশান বালির চরে ছুটতে ছুটে এসে পোলো থমকে যায়। জামগাছটা হাওয়ায় মৃদুমন্দ দুলছে, দু-একটা পাতা ঝরে পড়ছে নীচে, কিন্তু গাছের তলায় অতীশ নেই।
কী ব্যাপার! এমন তো কখনো করে না অতীশ। যখনই পোলো এসেছে, আগে থেকেই সেই ছেঁড়া প্যান্ট পরে অতীশকে বসে থাকতে দেখেছে।
পোলো ঘাবড়ে যায়, “অতীশ! কোথায় গেলি অতীশ? এদিকে আয়, দাদু তোকে দেখবেন। আমার বোনু এসেছে দ্যাখ, তোর সাথে খেলবে বলে।”
কোথায় অতীশ! বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে যেন ঢেকে যায় পোলোর কণ্ঠস্বর। দামোদরের জলের কুলকুল শব্দ যেন বাড়িয়ে তোলে নিস্তব্ধতা।
দাদু ততক্ষণে এসে পড়েছেন, “কে-কেমন দেখতে অতীশকে? তোরই মত কি পোলো?”
“হ্যাঁ, আমারই মত তো!” পোলো সোৎসাহে বলে, “আমারই মত লম্বা, মুখটাও গোল, শুধু গায়ের রঙটা একটু রোদে পুড়ে ...!” পোলো কথা শেষ করতে পারে না, ফাঁকা জামগাছের তলায় কিসে যেন ঠোক্কর খায়, নিচু হয়ে দেখে একটা ফলক।
এতদিন এতবার এসেছে এখানে, কই এই ফলকটা চোখে পড়েনি তো! পোলো ভাল করে দেখে ফলকটা, কিছু একটা লেখা রয়েছে সেটার ওপরে। পড়া যাচ্ছে না ঠিকমত। মোটা আস্তরণ পড়ে গেছে মাটির।
টিয়া এগিয়ে এসে ওর জামার খুঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে ফলকটা। একটু পরেই লেখাটা পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে –
শ্রীমান অতীশ বসু
পিতা – শ্রী কল্যাণ বসু, মাতা – শ্রীমতী বিদিশা বসু মল্লিক
জন্ম - ... মৃত্যু - ...
পোলো বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, এই অতীশ বসু কে? এর আর ওর নিজের জন্মদিন এমনকি সালটাও যে এক! আর ... আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, পোলো ঢোঁক গেলে, বাবা-মা’র নামটাও যে একদম এক!
আতঙ্কে ওর চোখ সাদা হয়ে যায়। এই ফলকের জায়গাটাতেই যে রোজ অতীশ বসে ওর জন্য অপেক্ষা করে।
পোলো কিছু বলার আগেই দাদু এসে ওর কাঁধে হাত রাখেন, “অতীশ তোর যমজ ভাই ছিল পোলো। তোদের বাবা অতীশ দীপঙ্করের নামে মিলিয়ে দুই ভাইয়ের নাম রেখেছিল অতীশ আর দীপঙ্কর। অতীশ দীপঙ্করের নিজের বাবার নামও কল্যাণই ছিল। জন্মানোর কিছুদিন পর তোদের মা দুজনকে নিয়ে এখানে চলে আসে। তোরা দু-ভাই’ই একসাথে বড় হচ্ছিলি। কিন্তু দু’বছর হতে না হতেই অজানা একটা জ্বরে অতীশ ...!” দাদুর গলা প্রায় বুজে এল, “তখন তরতর করে হাঁটতেও শিখেছিল। ছোটদের তো পোড়ানোর নিয়ম নেই, এই বালির চরে এই ফলকের নীচেই ...!”
“সে কি করে হয়?” আতঙ্কে বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে পোলো, “অতীশ আমাকে বই পড়ার নেশা ধরিয়েছে, মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, আর ... আর অতীশ নেই বললেই হবে?”
আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হয়ে যায় পোলোর চিৎকারে, পাখিরা ডানা ঝাপটে উড়ে যায় গন্তব্যে। দূরে কোন এক অজানা পাখির করুণ ডাকে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে যেন!
“অতীশ তোকে ভাল মানুষ বানিয়েছে দাদুভাই!” দাদু শ্রান্ত গলায় ওকে জড়িয়ে ধরেন, “ও তোর মধ্যে দিয়েই হয়ত পরিবারের মানুষগুলোকে, পরিজনদের কাছে পেতে চেয়েছে। বোঝাতে চেয়েছে ভালবাসার অনুভূতিগুলো। বাড়ি চল!”
দাদু আর বনমালীদাদু সামনে হাঁটছিলেন, বিস্মিত স্তব্ধ পোলো টিয়াকে নিয়ে ফিরছিল। টিয়া ফিসফিস করে বলছিল, “কোথায় রে সেই দাদাটা পোলোদাদা? খেলবে না আমাদের সাথে?”
পোলো তর্জনী দিয়ে বোনের মুখচাপা দিল। নিঃশব্দ জলের আওয়াজে খানখান হয়ে যাচ্ছিল বালির চর। হঠাৎ ফিকফিক আওয়াজ হতেই পোলো চমকে উঠে পেছন ফিরল।
ওই তো! পেছনে ফেলে আসা জামগাছের নীচে ওই তো বসে আছে অতীশ, ফিকফিক করে হাসছে, চোখাচোখি হতেই চেঁচিয়ে বলল, “আজ কিন্তু মা-কে ইমেল করবি, ভুলে যাস না যেন! আর বোনুকে অলিভার ট্যুইস্টের গল্পটা ...!”
পোলোর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কিন্তু তবু ও চিৎকার করে দাদুদের আর ডাকল না।
কারণ ও জানে দাদুরা অতীশকে দেখতে পাবেন না। ও ছাড়া কেউই দেখতে পাবে না ওর সঙ্গে
একই সময়কাল মাতৃজঠরে থাকা ভাই অতীশকে।
মৃত্যুর পরে তো মানুষের বয়স বাড়ে না, তবে কি কোনো সমান্তরাল জগতে ওর ভাই বড় হয়ে উঠেছে, পোলোর আলগা হয়ে যাওয়া পারিবারিক, সামাজিক বাঁধনগুলোকে নিজের অতৃপ্তি থেকেই কি শক্ত সুতো দিয়ে বাঁধতে চেয়েছে?
পোলো মৃদু হাসল, হাত তুলে ‘ভি’ দেখাল ওর ভাইকে। তারপর বোনুর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো।
আর দূরে বালির চরের পাশের জামগাছের তলায় ফলকের নীচে ঠাণ্ডা মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা অতীশ চেটেপুটে গিলতে লাগল না পাওয়া ভাইবোনের ভালবাসার উত্তাপটা!
দু’বছর বয়সে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়া আত্মাটা তিরতির করে কাঁপছিল।
কেন ওকে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হল?
ও চেঁচিয়ে পোলোকে বলল, “কাল ঠিক এইসময়ে আসিস কিন্তু ...!”
.... পোলোর পরিজনেরা-- দেবারতি মুখার্জী ২০১৮ সালে শারদীয়া শুকতারায় প্রকাশিত।