শিক্ষা হল জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। ইউনেস্কোর একটি গবেষণা অনুসারে, "একজন ব্যক্তির শারীরিক, বৌদ্ধিক, মানসিক এবং নৈতিকভাবে একজন সম্পূর্ণ পুরুষ/নারীর সাথে একীভূত করাই শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য।" সক্রেটিসের ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।”
এরিস্টটল বলেন “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।
অর্থাৎ শিক্ষা এমন একটা ব্যবস্থা যার ফলে মানুষ স্রষ্টা প্রদত্ত মেধার বিকাশ সাধন করতে পারে, অজানাকে জানতে পারে, সত্য - মিথ্যা, ন্যায় অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে যার ফলে মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়, নিজের মতামত সকলের সামনে তুলে ধরতে পারে, সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। সভ্যতার প্রধান উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষার আলোয় মানুষ অন্ধকারকে জয় করে। অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পায়। শিক্ষাই মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত পশুত্বকে অবদমিত করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মানুষ ও পশুর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে, বিবেকবোধ জাগ্রত করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা:
মহান আল্লাহ মানবজাতিকে জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এ যোগ্যতা নেই। নারী পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ের শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে কারণ মহান আল্লাহ উভয়কেই সেই যোগ্যতা দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয় সেখানে শুরুতেই আছে,
ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ ١ خَلَقَ ٱلْإِنسَـٰنَ مِنْ عَلَقٍ ٢ ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ ٣ ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ ٤ عَلَّمَ ٱلْإِنسَـٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ٥
" পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্তপিন্ড হতে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দিয়ে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।" (সুরা আলাক:১-৫)
এ আয়াতগুলোতে স্পষ্টতঃ নারী পুরুষ উভয়ের শিক্ষা অর্জনের প্রতিভা প্রমাণিত হয়। নারী শিক্ষার গুরুত্ব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এক হাদিসে। একবার এক নারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার হাদিস তো শুধু পুরুষরা শুনতে পায়। সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিন, যেদিন আমরা আপনার কাছে আসব, আল্লাহ আপনাকে যা কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে আপনি আমাদের শেখাবেন।’ তিনি বলেন, ‘তোমরা অমুক অমুক দিন অমুক অমুক জায়গায় একত্র হবে।’ সে মোতাবেক তারা একত্র হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে এলেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা কিছু শিখিয়েছেন তা থেকে তাদের শিক্ষা দেন। (বুখারি, হাদিস : ৭৩১০)
জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা :
পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যানকর জ্ঞান অর্জন ইসলামেও কাম্য। বিধানগতভাবে জাগতিক জ্ঞান দুই প্রকার। এক, যা চর্চা করা অপরিহার্য। যেমন: চিকিৎসা, গণিত, রাষ্ট্রনীতি, কৃষি, প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি। গোটা জনপদে যদি কেউ এ জ্ঞান রপ্ত না করে তাহলে সকলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দুই, নিষিদ্ধ জ্ঞান চর্চা, যা মানুষকে অকল্যানের দিকে ধাবিত করে। (ইহইয়াউ উলুমুদ্ দ্বীন: ১/২৯-৩০)
দ্বীনি খেদমতের উদ্দেশ্যে জাগতিক জ্ঞান অর্জন করাও ইসলামের খেদমত হিসেবে গণ্য হবে। কোরআনে কারিমে আছে,
وَاَعِدُّوۡا لَہُمۡ مَّا اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ قُوَّۃٍ وَّمِنۡ رِّبَاطِ الۡخَیۡلِ تُرۡہِبُوۡنَ بِہٖ عَدُوَّ اللّٰہِ وَعَدُوَّکُمۡ وَاٰخَرِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ ۚ لَا تَعۡلَمُوۡنَہُمۡ ۚ اَللّٰہُ یَعۡلَمُہُمۡ ؕ وَمَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ یُوَفَّ اِلَیۡکُمۡ وَاَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের (মুকাবিলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে এবং তাদের ছাড়া সেই সব লোককেও, যাদেরকে তোমরা এখনও জান না; (কিন্তু) আল্লাহ তাদেরকে জানেন। তোমরা আল্লাহর পথে যা-কিছু ব্যয় করবে, তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। (আল আনফাল - ৬০)
বর্তমান যুগ বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের যুগ তাই প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় জ্ঞান বিজ্ঞান ও নানা প্রযুক্তিতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা।
দ্বীনি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
একজন মুসলিমের জীবনে দ্বীনি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী। নিজের রব্বকে চেনা, শরীয়তের সঠিক আহকাম জানা, সুন্নাত ও বিদআতের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারা, হারাম হালাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য দ্বীন শিক্ষা অর্জন নরনারী সকলের অবশ্য কর্তব্য। দ্বীনি পরিবেশের অভাবে যদি নারীরা বাইরে জ্ঞান অর্জনের জন্য যেতে না পারে তাহলে পরিবারের পুরুষের দায়িত্ব তাদের দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন,
ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِى ٱلَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُو۟لُوا۟ ٱلْأَلْبَـٰبِ ٩
বলুন, 'যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে। ( সুরা যুমার:৯)
রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দান করে। (বুখারী :৫০২৭)
আরেক হাদিসে এসেছে, আল্লাহ যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন। (বুখারী :৭১)
নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও ইতিহাস
ইবনুল কায়্যিম রা বলেন, উম্মতের অর্ধেক হচ্ছে নারী, আর বাকি অর্ধেককে জন্মও দিয়েছে নারী। তাই বলা যায়, পুরো উম্মতই হলো নারী। ( তুহফাতুল মাওলুদ ফি আহকামিল মাওলুদ)
এ কথাটির মর্ম বুঝতে পারলে নারীশিক্ষার গুরুত্ব কত বেশি তা বুঝার বাকি থাকে না।
কিন্তু পশ্চিমারা জীবনের সব ক্ষেত্রে,- বিজ্ঞান, শ্রম ও শিল্প-সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে নারীর ওপর জুলুম করেছে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করেছে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিতে, মধ্যযুগ থেকে এবং পরবর্তীতে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, নারী ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। ব্রিটেনে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষিত নারীদের সার্টিফিকেট বা সনদ দেয়া হত না। সে সময় বলা হত মেয়েদেরকে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেয়া উচিত নয়। (ParsToday)
অথচ ইসলামে নারী শিক্ষার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। নবীজির আমলে নারী শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়, যার প্রমাণ আমরা নারী সাহাবীদের জীবনীতে দেখতে পাই। যেমন আয়েশা (রা) হাদিসশাস্ত্র, ইসলামী আইন, ফিকহ, ইতিহাস 'বংশলতিকা, কবিতা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। আসমা বিনতে আবি বকর, উম্মে আব্দিল্লাহ বিন জুবায়ের (রা) হাদিস বর্ণনায় পারদর্শী ছিলেন। আয়শা বিনতে তলহা সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র ও নভোমণ্ডল বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। সাকিনা বিনতে হোসাইন ও খানসা সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন। মায়মুনা বিনতে সাদ হাদিসে পারদর্শী ছিলেন। আলী (রা) ও তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। কারিমা মারজিয়া (রহ) হাদিসের পণ্ডিত ছিলেন, ইমাম বুখারী (রহ) তার কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন। ফাতিমা বিনতে আব্বাস প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ ছিলেন, তিনি মিশর দামেশকে প্রভাবশালী নেত্রী। উখত মজনি (রহ) ছিলেন ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর শিক্ষক, আল্লামা মারদিয়ী (রহ) তার কাছ থেকে যাকাত বিষয়ক মাসয়ালা বর্ণনা করেছেন। হুজাইমা বিনতে হায়ই প্রখ্যাত তাবেয়ী ও হাদিসবিদ ছিলেন, ইমাম তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ (রহ) তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম স্পেনের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ক্যালিগ্রাফিতে দক্ষ ছিলেন। লুবনি (রহ) ভাষাবিদ ও আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রের পারদর্শী ছিলেন। ফাতেমা বিনতে আলী বিন হোসাইন বিন হামজা ছিলেন হাম্বলি মাজহাবের পন্ডিত। সমসাময়িক আলেমরা তার কাছ থেকে হাদিস শিখেছেন এবং প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ দারেমী শরীফের সনদের অনুমতি নিয়েছেন। রাবিয়া কাসিসাহ সুপ্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। ইমাম হাসান বসরী (রহ) ও তার কাছ থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন। ফাতিমা বিনতে কায়েস শিক্ষাবিদ ও আইনবিদ ছিলেন, উম্মে ফজল, উম্মে সিনান হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন। আশ্ শিফা বিনতে আবদিল্লাহ প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ছিলেন। ওমর (রা) তাকে ইসলামী আদালতের 'কাজাউল হাসাবাহ' (Accountability court) ও 'কাজাউল সুক' (Market administration) ইত্যাদির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (তাপকাতে ইবনে সাদ :৮/৪৫-৪৮; দালায়িলুন নবুয়্যাহ : ৫/৪১৬; ইবনে আসির : ৫/৪৫০; আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া : ৫/৭৮)
ইবনে কায়েসের বর্ণনায় দেখা যায়, প্রায় ২২ জন নারী সাহাবী ও ইসলামী আইন শাস্ত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে সাতজন উম্মাহাতুল মুমিনীন ছিলেন। ১১ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে তৎকালীন মুসলিম নারীরা দামেশকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২ টি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে মুসলিম নারীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। ( কালের কণ্ঠ)
প্রিয় দ্বীনি বোন, যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনি গর্ববোধ করছেন, সেই সমাজে শত বছর পূর্বেও নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হত না। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারীকে পশুর পালের সাথে তুলনা করা হত, নানা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে নারীসমাজ জর্জরিত ছিলো, যার ফলে পুরুষরা ইচ্ছে মত তাদের শোষণ করতে পারতো। অথচ যে ইসলামি ব্যবস্থাকে আপনি সেকেলে বর্বর বলে হীনমন্যতায় ভুগছেন, সে-ই ইসলাম হাজার বছর পূর্বে আপনার শিক্ষার অধিকার কেবল নিশ্চিতই করেনি বরং তা যথাযথ মূল্যায়নও করেছে।
প্রিয় দ্বীনি ভাই আপনার পরিবারের নারীদের নিরাপদ পরিবেশে সুশিক্ষা নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্ব। ইসলাম কখনই ওই শিক্ষা ব্যবস্থা অনুমোদন করে না, যেখানে নারীকে তার নারীত্ব ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে গড়ে তোলে তা কস্মিনকালেও জায়েজ হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত," গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। "
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:০২