তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। জগন্নাথ হলের অতুলের ঘুম ভাঙ্গে প্রচন্ড শীতে। আধ ঘুম অবস্থায় সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা যে এই মার্চ মাসের গরমে তার এত ঠান্ডা লাগছে কি করে?অতুল একটু আলসে গোছের ছেলে সে সুযোগ পেলেই ঘুমায় আর ঘুমায়ও একেবারে দিকবিদিক হারিয়ে কুম্ভকর্ণের মত। তাই সে শীতকে পাত্তা না দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা শুরু করল। তবু শীত করছে,সে আস্তে আস্তে গায়ে হাত বুলায় এবং দেখে গায়ের স্যান্ড গেঞ্জিতা একদম ভেজা। খুব বিরক্ত হয় সে,ভাবে আবার বুঝি কেউ ওর ঘুম ভাঙ্গানর জন্য গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছে। একথা ভাবতেই তন্দ্রা কেটে যায় তার।তারপর কেমন যেন একটা গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে ওর যেন এক্ষুনি বমি করে দেবে। তরাক করে উঠে বসে বিছানায়...তারপরই এক ভয়ানক চিৎকার দিয়ে ওঠে সে- এ কি !একি দেখছে সে?এ কোন মৃত্যুপুরীতে এল সে ?অতুল ভাবে সে নিশ্চয়ই কোন দুঃসপ্ন দেখছে,কিন্তু দুঃসপ্নও কি এত বিভৎস হয়?ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে শরীর।
বিশাল হল ঘরটিতে সে একাই এখন জীবিত মানুষ। চারিদিকের দেয়ালে রক্ত আর গুলির চিহ্ন,রুমের সমস্ত কিছু ঝাঝরা করে দিয়েছে বুলেট। ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি হায়নাদের এলপাথারি গুলিগুলো ছুঁতে পারেনি অতুলের শরীর,তাই সে বেঁচে গেছে! সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে ওর,দম আটকে আসে।রক্তের গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস।যে ছেলেগুলোর সাথে আজ সন্ধ্যায়ই সে একসাথে বসে খেয়েছে,রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে চোখে ভেসে উঠেছে উত্তেজনার আগুন...তাদেরই দেহগুলো কেমন নিথর মাংসের স্তুপের মত পড়ে আছে বিছানায়! কেউ বিকৃতভাবে আবার কেউ শান্ত হয়ে যেমনি ঘুমিয়ে ছিল তেমনই পড়ে আছে।কি বিভৎস! “তবে কি সমঝতা হয়নি ওদের সাথে...? মেনে নেয়নি ওরা? হায় ঈশ্বর...!” আরকিছুই ভাবতে পারছেনা সে...কোন অনুভুতি কাজ করছেনা ওর। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে..“না না আমি নিঃশ্বচয়ই সপ্ন দেখছি,দুঃস্বপ্ন!তা না হলে আমার এমন লাগছে কেন?”ক্রমশ এক পা দু পা করে এগিয়ে যেতে চাইল অতুল কিন্তু পারল না।একটু এগিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পরল সে।
সেদিন ২৫শে মার্চ ভোর রাতে অতুল ঘুম থেকে উঠে যা দেখেছিল তা কোন দুঃস্বপ্ন ছিল না,ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের পৈশাচিক অত্যাচারের এক ছোট্ট নমুনা মাত্র,এক নির্মম হত্যাযজ্ঞের অবশেষ। অতুল ঠিকই ধরেছিল, বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার সমঝতা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। বাঙ্গালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা ছিল ভীত।ভুট্টোর নির্দেশে রাত ১০টার দিকে সেদিন পাকিস্তানি মিলেটারিরা ট্যাংক নিয়ে নেমে পড়ে ঢাকার রাজপথে, হিংস্র হায়নার মতন ঝাপিয়ে পরে হত্যাযজ্ঞ চালায় সারারাত । গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সবাই জানতো আলোচনা শেষে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকা ছেড়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন রিং এর ছবি এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে অন্যকথা । ঐ রাতেই ভুট্টো এসে উঠেন বর্তমান শেরাটন হোটেলের পূর্বপাশে প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটে।ঐ হোটেলে আটক থাকা সাংবাদিকরা তার সাথে দেখা করতে গেলে তাদের জানানো হয় তিনি ঘুমিয়ে গেছেন! রাত দেড়টা দুইটার দিকে যখন হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ তখন তিনি রওনা হন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে এবং পরদিন ঘোষণা দেন
“Allah has saved Pakistan” !!
তারপর শুরু হয়ে যায় মুক্তির পথে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম।
সে রাতের পর শত শত মানুষের আর ঘুম ভাঙ্গেনি,
অতুলের মত দেখা হয়নি ভোর,দেখা হয়নি ২৬শে মার্চ, স্বাধীনতা দিবস।