somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুলাউড়ার বাংলোয় ঠাণ্ডা নির্জনতা

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত নয়টা বেশী রাত না ঢাকা শহরে কিন্তু কুলাউড়ার জন্য গভীর নিস্তব্ধ রাত। শীতের এই রাতে একটা মানুষ পাওয়া যাবেনা এই পাহাড়ি বাংলো এবং এর আশে পাশের এলাকাতে যারা এলোমেলো হাঁটছে কিংবা বসে আড্ডা দিচ্ছে । বাংলোর নাইট গার্ড ভুতুরে এই পরিবেশে প্রতিদিনের মতোই হয়তো তার জন্য নির্ধারিত ছোট্ট কামরার টুলে বসে ঝিমাচ্ছে । অনেক বেশী নিস্তব্ধতা নিয়ে পুরো এলাকাই আসলে ঝিমুচ্ছে । এতো বেশী সতর্ক হয়ে চোখ কান খাঁড়া রেখে পাহারা দেবার মতো কোন ঘটনাই হয়তো এখানে ঘটেনি কোনদিন। মুল বাংলোর টিলা থেকে বাংলোয় ঢোকার প্রধান দরজা বেশ খানিকটা দূরে, বাংলোয় বসে অনুমান করছি দারোয়ান একরাশ বিরক্তি নিয়ে মাশা মারার কয়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। তীব্র ঠাণ্ডা নিয়ে হালকা বাতাশ বয়েযাচ্ছে , বাইরে টানা অনেকটা সময় কাটানো বেশ মুস্কিল। সে হালকা বাতাশে পাতা ঝরার শব্দ শোনা যায়, চাঁদনি রাতে পাতা খসে পরার ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্যও দেখা যেতে পারে। যদিও পাতা ঝরার দৃশ্য রাতের চে নির্জন মধ্য দুপুরেই বেশী অপার্থিব লাগে।নানা ধরনের গাছ, আগাছায় পূর্ণ জঙ্গল আশে পাশের চার দিক। এমন জঙ্গলে দু একটা বাঘ না পাওয়া গেলেও দেশি ভাল্লুকের আনাগোনা থাকলেও থাকতে পারে। বাংলোতে আসার পথে দুধারে চা বাগানের সবুজ সারি, দিগন্ত ছড়ানো চা বাগানের মাঝে শিরিষ গাছগুলো আস্থা আর শান্তির প্রতিক হয়ে নিশ্চল দাড়িয়ে আছে, দেখলে ভিতরেও প্রশান্তি ছড়িয়ে পরে ঠাণ্ডা মৃদুমন্দ হাওয়ার মতো । একটানা স্থির দৃষ্টেতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, চোখে ক্লান্তি আসেনা।
ছয় জন মানুষ, একটা গাড়িতে পুরো রাস্তা মাতামাতি করে, একজন আর একজনকে কথার ল্যাঙ মেরে দারুন মুড নিয়ে রাত নটায় নামলাম সিআরপির বাংলোয়। বাংলোর কেয়ার টেকার আমাদের জন্য দাড়িয়ে আছে পেছনে হাত দিয়ে, মাথাটা হালকা সামনে বাঁকা করে, নতজানু ভঙ্গিতে; ব্রিটিশ ওয়াডারলি যে ভাবে তার প্রভুর জন্য দাড়িয়ে থাকতো। ওর নাম মিজান। মিজানের আয়োজনে কোন ঘাটতি নেই। নেমেই দেখি বাংলোর সামনের খোলা চত্বরে সিমেন্টের তৈরি স্থায়ী টেবিলে নানা ধরনের খাবার আয়োজন, তবে সেটা রাতের মুল খাবার নয়, মুল খাবারের আগে হালকা একটু স্টারটার । কয়েক ধরনের সালাদ, দুই ধরনের ছোট মাছ ডুবো তেলে ভাজি , ফ্রুটস, লেবু, কোক- পেপসি ইত্যাদি ইত্যাদি । পাশেই লোহার চৌকোনা বড় পাত্রে কাঠে আগুন জ্বালানো হয়েছে, একটু পর সেটাতে তিন ধরনের মাছ ফ্রাই হবে। আগুনের উত্তাপ দুরথেকে আমাদেরও গরম করছে পাহাড়ি শীতের এই পূর্ণিমা রাতে। পাহাড়ে শীত আর পূর্ণিমা দুটোই দুর্দান্ত। যারা সেটা উপভোগ করে নাই, তাদের অনুভুতি কিছুটা অপূর্ণাঙ্গই রয়ে গেলো। ব্যাগ-ট্যাগ বাংলোর ভিতরে যার যার রুমে ঢুকিয়ে , মুখে পানি ছিটিয়ে সবাই মিলে গোল হয়ে আগুনের পাশের সেই সিমেন্টের টেবিল ঘিরে বসলাম। হালকা মোমের আলো আর চাঁদের আলোয় মধুর ছিপি খোলার শব্দ এক রাশ জমানো কাংখিত উচ্ছাস হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। মধুর সাথে কাঠের আগুনে ঝলসানো কোরাল, চিংড়ি আর রুই , এ এক অসাধারন টেস্টি মুহূর্ত। আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে, সাথে ঠাণ্ডাটাও। চাঁদটাকে ভালো করে দেখতে সবাই মিলে বাংলোর ছাদে উঠলাম। কারাওকিতে গানের বান তূলে ফেলেছে আমাদের সঙ্গের একজন সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য চলছে সবার। অনেক রাত পর্যন্ত এসব করে রাতে পরোটা, সবজি , ডাল, ছোট মাছ দিয়ে ভুরি ভোজ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতের ব্যাপক খানাপিনা, নাচানাচি আর অনেকটা রাতজাগার পরও সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম সবাই। একটা মহা জ্বলজ্বলে রাতের স্মৃতির পর আর একটি কুয়াশা মাখা শীতের সকাল। সকালের নাস্তা ছিল খিচুরি, ডিম ভাজি আর আমের ঝাল আচার । সবাই মিলে ভালোই মেরে দিলাম সেটা। আমেরিকা ফেরত হিপ্পি মামা আর আমি মিলে পুরো বাংলোর টিলার চারদিকের জঙ্গল ঘুরতে বের হলাম। অফ ট্রাকে হাঁটবো ঠিক করেছি। শুকনা পাতা মারিয়ে এলো মেলো হেঁটে বাংলোর পেছন দিয়ে বের হয়ে এসে দেখি সামনের লিছু গাছটাতে উঠে আমাদেরই একজন জোরছে চেছাচ্ছে, চেঁচিয়ে আসলে সে গান গাওয়ারই চেষ্টা করছে । জঙ্গলে এসে এমন অনেক অদ্ভুত আচরন ভিতর থেকে চলে আসতে পারে, কিছু করার নাই। হাকালুকি হাওড় নাকি খুবি কাছে । প্লান হোল সেটা ঘুরতে যাব। হাতে শুধুমাত্র আজকের দিনটাই, তাও আবার পুরো দিনও নাই বিকেল ৫ টার মধ্যে ঢাকায় ব্যাক করতে হবে। হাকালুকি হাওড় এখন পুরাই শুকনা, মাঝ খান দিয়ে আমাদের গাড়ি হুশ করে ছুটে চলছে। পুরো হাওড় সবুজ ঘাসে ভর্তি। এতো সুন্দর দিগন্ত জোড়া সবুজ সচারচার চোখে পড়েনা । হটাত করে চোখ খুললে মনে হবে কোন বিশাল গলফ মাঠে এসে পরেছি । অনেকটা ভিতরে এসে মুল হাওরের শীতকালের শুকনা অংশের শেষে বিশাল জলাভূমি আর জলাভুমিতে দাপিয়ে বেড়ানো নামনাজানা অসংখ্য পাখির দেখা পেলাম। মিজান আমাদের আরেক প্রস্থ ব্রেক ফাস্টের জন্য খিচুড়ি, ডিম ভাজি আর হাওরের কচি পাতিহাঁসের মাংস ভুনা করে বেঁধে দিয়ে দিয়েছিলো। বিশাল খোলা সবুজের চাদরে ঢাকা মাঠে শুয়ে বসে ব্যাপক উল্লাসে ভোজন সারলাম। বলতে ভুলে গেছি সূক্ষ্ম অনুভুতিগুলোকে সম্মান জানাতে সঙ্গে সিলেটের সবচে বিখ্যাত ইকেবেনার সাতকড়া আচারও ছিল সে মহা ব্রেক ফাস্টে । হিপ্পি মামা বিড়ি সিগারেট মোটেও খায়না, তবে জয়েন্টে কোন আপত্তি নেই। মহা ব্রেক ফাস্টের পর মহা আড্ডায় মামার বানানো সেই ঘাস খেয়ে ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে বিমোহিত হতে চেষ্টা করছিলাম, হয়তো কিছুটা সফলও হয়েছিলাম। আসলে ঢাকায় ফেরার তাড়া মনের কোনে সবসময়ই ঝামেলে পাকাচ্ছিল। ঘাস খেতে খেতে মামার কাছে জানলাম তার আমেরিকা থাকাকালিন হিপ্পি জীবনের খুঁটিনাটি। হিপ্পিদেরও যে একটা দুর্দান্ত ফিলসফি আছে আগে জানতাম না। কতো কি যে জানার আছে বাকি।

‘কত কী করার আছে বাকি
বেলা বয়ে যায়
কী করে এভাবে আমি থাকি
ভেবে ভেবে সারাদিন কাটে
বলো কী উপায়,
তোমারও কি এরকম ঘটে?


ঠিক কী যে চাই, খুঁজে বেড়াই
কূল কিনারা ভেবে না পাই
কী করি বলো না,
হা-হুতাশ গেল না!
সব ছেড়ে ছুড়ে বহুদূরে
সরে যাই তবে,
আর কী বা হবে?
কিছু তো হল না এ জীবনে
বৃথা কালক্ষয়
তোমারও কি এমন হয় মনে?
নিঃসঙ্গতা ঘিরে আসে
কঠিন এ সময়
তোমারও কি কেউ নেই পাশে?
ঠিক কী যে চাই খুঁজে বেড়াই...
কত কী করার আছে বাকি’

এই খোলা সবুজ মাঠ, বিস্তীর্ণ বিল আর বিশাল আকাশকে ফিকে মনেহয় যখন টিকে থাকার লড়াইয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন হয় এবং প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তার পেছনে ছুটে হয়। কাজেই, ঢাকা আর টাকাই সত্য বাকি সব আমার লাজুক প্রিয় কল্পনা।







সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×