বিকেল পাঁচটা বাজতে চলল । আর কিছু মিনিট বাকি আছে । এখনই অফিস ছুটি হয়ে যাবে । এর মধ্যেই এক দুই করে কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছে । বাসার পথে । দিন শেষে সবাই একটু শান্তি চায় । ফিরতে চায় আপন নীড়ে ।
হাতঘড়িটায় কাটায় কাটায় ৫ টা । কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি । আটতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আমার কর্মক্ষেত্র । প্রতিদিন তিন-তিন ছয়টা সিঁড়ি ভেঙ্গে অফিসে উঠা-নামা আমার । কষ্ট হলেও শরীরের জন্য ভাল । তাই লিফটা এড়িয়েই চলি ।
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল দুম করে । অন্ধকারে চলতে একটু কষ্টই হচ্ছে । সিঁড়ির দেয়াল ঘেষে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে নিচে নামছি । সিঁড়িটা পূবে হওয়ার শেষ বেলার আলোটা এপাশে আসেনা । আর নগর জীবনে দেখেছি শত শত আঁকাশ ছোয়া কংক্রিটের দালান । এগুলোর জন্যেও আলোর দেখা পাওয়া দুষ্কর ।
নিচে এসে পড়েছি । শক্ত সোলের বুট পরা দারোয়ান আচমকা চিৎকার করে উঠল ।
“ছ্যার ছালাম”
ক্যাঁৎ করে উঠলাম । একেবারে পিলে চমকে গেছি । এভাবে কেউ ছালাম দেয় ? তাও আবার ঘুটঘুটে অন্ধকারে । দারোয়ান মিঞার চেহারা যে খুব একটা সুবিধের । তা নয় । ইয়া লম্বা । অস্ট্রেলিয়ান গরুর মত বডি । আর নাকের নিচে লম্বা-মোটা লম্বা গোঁফ । যে কেউ ভয় পাবে । বাংলার গৃহিনীরা যদি এই ব্যাটার চেহারা একবার দেখত; তাহলে রাক্ষস ক্ষোক্কসের গপ্পো ছেড়ে এর কথা বলেই ছেলেমেয়েকে খাওয়াতো, ঘুম পাড়াত । আমি জোয়ান ছেলেটাই তো ভয়ে কুচকে গেছি । বাচ্চারা তো প্যান্টে ইয়ে করে দিত । রাগ হচ্ছে খুব । সাথে বুকের ব্যাথাও । হার্টের একটু প্রবলেম আছে আমার । ছোটকাল থেকেই ।
কিছু না বলে মাথা উপর-নিচ একবার ঝাকিয়ে সালামের উত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিল্ডিং থেকে । গরমকাল । আকাশ ফকফকা । গাছের পাতার নড়ন- চড়নও বন্ধ ।
ব্যাটা গেটম্যানের অতিভক্তির জন্য বুক টা ব্যাথা করছে । মনে মনে কয়েকটা উত্তম মধ্যমও দিলাম ব্যাটার পিঠে । সামনে থেকে দেয়া যাবেনা । এক কিলে বুকের আর পিঠের হাড্ডি এক করে ফেলবে । আমার মত ছাপোষা আমজনতাদের জীবনটা এমনই । এমন নিরীহ । মনে মনেই মনের আশা পুষতে হয় । আশাগুলো মরেও যায় মনের ভিতরেই ।
বুক ডলতে ডলতে একটা রিক্সা ডাকলাম....
“মামা, যাইবা ?’
“কই যাইবেন মামা ?”
“মিরপুর-১২”
“হ্ যামু”
“কত নিবেন?”
“ষাইট ট্যাকা”
“কিহ্ . . এত্ত ? কেন ?”
“বেশি কতা কইতা পারতাম না । ষাইট ট্যাকা দিয়া গেলে চলেন । না গেলে নাই ।“
মামা ক্ষেপে আছে । বোঝা গেল । আর কিছু না বলে রাজি হয়ে গেলাম ।
“ওকে মামা, চলেন”
রিক্সায় উঠে থম মেরে বসে আছি । রিক্সাওয়ালা মামা পুরো ভর প্যাডেলের উপর দিয়ে চালাচ্ছেন ।িএকবার ডানে হেলছেন । একবার বামে । আশেপাশের সব রিক্সাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি । কেমন যেন গর্ববতী লাগছে নিজেকে । ভয়ভয় ও করছে । যদি এ্যাকসিডেন্ট করে ? তাইলে সব গর্ব ফুসসসসসস...
সোজা উপরের টিকিটও ধরতে হতে পারে । সবে বিয়ে করছি । এত তাড়াতাড়ি উপরে যাবার ইচ্ছা নাই ।
তাই মামাকে স্বরণ করলাম ।
“মামা, ইট্টু আস্তে চালালে হয়না ? এ্যাকসিডেন্ট করবেন তো ।”
মামা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেক একবার । আমার মুখটা দেখার জন্যই হয়তো । ভয় পাচ্ছি; বুঝতে পেরে কিছুটা গতি কমালেন। আমিও ওনার মলিন মুখটা একবার দেখে নিলাম । আমি অন্যন্ত বাঁচাল গোছের মানুষ । পৃথিবীতে যদি বাঁচাল নামের কোন প্রাণী থাকে তাইলে সেইটা আমি । কান ঝালাপালা করে দেই আশপাশের মানুষগুলোর । অনেক চুপ থেকেছি । আর না । মুখ খুললাম এইবার ।
“মামার নাম কি ? বলা যাবে?”
“নাম, মালেক মিঞা । ক্যান মামা ?”
“না মামা, এমনিতেই । তো মামার মুখ শুকনা কেন ? কিছু হয়েছে ?
“গরীবের কথা শূইনা কি করবেন মামা ? বাদ দ্যান”
ওনার কথাটায় যে কত কষ্ট লুকানো আছে, সেটা আঁচ করতে পারছি হয়ত কিছুটা । তাই বুকটায় কেমন যেন অন্যরকম ফিল করলাম ।
“না মামা, বলেন । কোন অসুবিধা নেই । আমিও নিম্ন শ্রেণীর মানুষ । বলেন”
মামা একটা একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সেটা বের করলেম । মধ্যিখানে একটা “হাহ্” - শব্দ হল । মামা শুরু করলেন।
“কি আর কমু মামা ? আইজ বউডার লগে ম্যালা চিল্লাইছি”
“কেন মামা ?” জানতে চাইলাম কৌতুহল নিয়েই ।
“আইজ ফিরনের সময় একটু গরুর মাংস নিয়া যাইতে কইছিল । আমরা গরীব । আমগো সাধ-আল্লাদ থাকোন লাগেনা । বউডা ম্যালা কষ্ট কইরা সংসার চালায় । আমার একলার ট্যাকায় চলেনা । হেয় মাইষের বাড়িত কাম কইরা ট্যাকা আনে । তাই জইন্নে তড়াতড়ি চলাইতেছিলাম । আরও প্যাছেঞ্জার তুলমু । আইজ য্যামনেই হউক গোস্তো নিয়া বাড়িত যামু । কিন্তু ট্যাকা আরও লাগবো ।”
রিক্সার গতি কমে গিয়েছে অনেকটা । খেয়াল করিনি দুজনের একজনও । মামা প্রথম খেয়াল করেই আবার আরেকটু গতি বাড়িয়ে বললেন,
“মামা, গতি বাড়ামু ? কিছু হইবোনা । দেইখেন”
“. . . . . .”
আমাকে চুপ থাকতে দেখে এবার একটু জোরেই ডাকলেন..
“মামা”
নড়ে উঠলাম যেন । কল্পনা থেকে ফিরলাম । হারিয়ে গেছিলাম রিক্সাওয়ালা মামার মাঝেই ।
“কি বললেন মামা? ”
“মামা, কইলাম- গতি বাড়ামু ?”
“না মামা । রিক্সা থামান । একটু বাজার করবো”
মামার মুখটা কালো হয়ে গেল । এত তাড়া ওনার । এরই মাঝে ওনার সময় নষ্ট ।
কিছু না বলে রিক্সা থামালেন ।
রিক্সা থেকে নেমে বললাম, “রিক্সা সাইড করে আমার সাথে আসেন মামা”
মন খারাপ করে আছেন । তাতে কি ? ওরা গরীব । ওদের সময়ের কোন মূল্য নেই ।
বাজার শেষে আবার যাত্রা শুরু । মামাকে বললাম, “মামা; আপনার বউ, মানে ‘মামী’ তো এখনও রাগ করেই আছে মনে হয় ।”
‘হু’ বলে জবাব দিলেন শুধু ।
“মামী কি খাইতে ভালবাসে ? জানা আছে ?”
এবার মামা কিছুটা হালকা হয়েই বললেন,
“ওই ত অংপুরের মাইয়া । পান খায় খুব । দিনভরা পান চিবায় । ছাগলের লাহান” বলেই শুকনো মুখে একটা মন ভেজানো হাসি দিলেন । এ হাসিতে কোন কৃত্রিমতা নেই । বিধাতাই এর কারিগর ।
“তাইলে মামা, যাবার সময় মামীর জন্য পান নিয়ে যাবেন । তাহলে দেখবেন রাগ থাকবেনা আর”
মামা কি যেন ভেবে সম্মতি জানালেন । বাসার সামনের গলিতে এসে পড়ছি । রিক্সা এরচে বেশি যেতে পারেনা
রিক্সা থেকে নেমে মানিব্যাগ বের করে টাকা গুনছি । দেব বলে।
“মামা, কয়ডা ট্যাকা বেশি দিবেন? আপনের বাজার করবার গিয়া দেরী হইয়া গ্যাছে ।”
“কেন? ভাড়া তো ঠিক করেই উঠলাম । এক পয়সাও বেশি না”
“ঠিক আছে” গলাটা কেঁপে উঠল ওনার ।
ভাড়া দিয়ে চলে আসতেছি । মামা ডেকে বলল,
“মামা, এটা তো পাঁচ শ ট্যাকার নোট”
মুচকি হেসে বললাম,
“ঐটা আপনার”
মামা, অবাক হয়ে শুধু শুনলেন ।
ফিরে আসছি..
আবারও ডাক পড়ল ।
“মামা, বাজারের ব্যাগ তো ফালায় গ্যালেন!”
“ঐটাও আপনার । ৫ কেজি মাংস আছে । মামীকে দিবেন । আর হ্যাঁ, যাবার সময় পান নিতে ভুলবেন না যেন”
আমিও একটা হাসি দিলাম । রিক্সাওয়ালা মামার মত হয়নি, জানি । তার কুটিলতা বিহীন হাসির কাছে আমারটা কিছুই না ।
কিন্তু, একি ! মামা কাঁদছে ! মুক্তোদানার মত চকচক করছে ওনার চোখগুলো । কিছু বলতে চাইছেন হয়তো । কিন্তু বলতে পারছেন না । কারণটা আমি জানি । এটাই ভালবাসা । ভালবাসা মানুষকে হাসায় । আবার কাঁদায়ও ।
বিদায় নিলাম মামার কাছে ।
গলির শেষ মাথায় এসে পিছনে তাকালাম একবার । মামা তখনও দাঁড়িয়ে আছে ।
মোড় ঘুরতেই আড়াল হয়ে গেলাম । আর দেখা যাচ্ছেনা ।
মামীর রাগ ভাঙ্গাতে আজ মামাকে হয়ত অনেক কিছুই করতে হতে পারে । কান ধরে উঠবস । আরও কত কি ! ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেললাম । কিন্তু সে হাসি স্থায়ী না । মিষ্টি কথা হবে তাদের মাঝে । সবাই ঘুমিয়ে পড়বে । জেগে থাকবে তারা । রাত জাগা পাখির মত ।
বাসার সামনে আসতেই মনে পড়ল, আল্লারে । মাইরালাইসে ..... . . .
আজ আমার খবর আছে । বারোটার খবর । বারোটার আগে বাসায় ঢুকতে পারব না শিওর । আজ আমাদের ম্যারেজ এ্যানিভার্সারী । ভুলেই গেছি ।
আজ বাড়িতে আগুন জ্বলবে । হরতাল পালিত হবে । জ্বালাও ! পোড়াও ! ভাংচুর !
চট করে মামার কথা মনে পড়ল । সে হয়তো যাবার সময় পান কিনে নেবেন । বউ এর রাগ ভাঙ্গাতে ।
আমার পাগলীটা আইসক্রিম ভালবাসে । ছুট লাগালাম দোকানে । যে করেই হোক আজ আইসক্রিম নিয়ে বাড়ি ফিরবোই ।