somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালবাসা

১৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিকেল পাঁচটা বাজতে চলল । আর কিছু মিনিট বাকি আছে । এখনই অফিস ছুটি হয়ে যাবে । এর মধ্যেই এক দুই করে কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছে । বাসার পথে । দিন শেষে সবাই একটু শান্তি চায় । ফিরতে চায় আপন নীড়ে ।

হাতঘড়িটায় কাটায় কাটায় ৫ টা । কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি । আটতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আমার কর্মক্ষেত্র । প্রতিদিন তিন-তিন ছয়টা সিঁড়ি ভেঙ্গে অফিসে উঠা-নামা আমার । কষ্ট হলেও শরীরের জন্য ভাল । তাই লিফটা এড়িয়েই চলি ।

ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল দুম করে । অন্ধকারে চলতে একটু কষ্টই হচ্ছে । সিঁড়ির দেয়াল ঘেষে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে নিচে নামছি । সিঁড়িটা পূবে হওয়ার শেষ বেলার আলোটা এপাশে আসেনা । আর নগর জীবনে দেখেছি শত শত আঁকাশ ছোয়া কংক্রিটের দালান । এগুলোর জন্যেও আলোর দেখা পাওয়া দুষ্কর ।
নিচে এসে পড়েছি । শক্ত সোলের বুট পরা দারোয়ান আচমকা চিৎকার করে উঠল ।
“ছ্যার ছালাম”

ক্যাঁৎ করে উঠলাম । একেবারে পিলে চমকে গেছি । এভাবে কেউ ছালাম দেয় ? তাও আবার ঘুটঘুটে অন্ধকারে । দারোয়ান মিঞার চেহারা যে খুব একটা সুবিধের । তা নয় । ইয়া লম্বা । অস্ট্রেলিয়ান গরুর মত বডি । আর নাকের নিচে লম্বা-মোটা লম্বা গোঁফ । যে কেউ ভয় পাবে । বাংলার গৃহিনীরা যদি এই ব্যাটার চেহারা একবার দেখত; তাহলে রাক্ষস ক্ষোক্কসের গপ্পো ছেড়ে এর কথা বলেই ছেলেমেয়েকে খাওয়াতো, ঘুম পাড়াত । আমি জোয়ান ছেলেটাই তো ভয়ে কুচকে গেছি । বাচ্চারা তো প্যান্টে ইয়ে করে দিত । রাগ হচ্ছে খুব । সাথে বুকের ব্যাথাও । হার্টের একটু প্রবলেম আছে আমার । ছোটকাল থেকেই ।

কিছু না বলে মাথা উপর-নিচ একবার ঝাকিয়ে সালামের উত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিল্ডিং থেকে । গরমকাল । আকাশ ফকফকা । গাছের পাতার নড়ন- চড়নও বন্ধ ।

ব্যাটা গেটম্যানের অতিভক্তির জন্য বুক টা ব্যাথা করছে । মনে মনে কয়েকটা উত্তম মধ্যমও দিলাম ব্যাটার পিঠে । সামনে থেকে দেয়া যাবেনা । এক কিলে বুকের আর পিঠের হাড্ডি এক করে ফেলবে । আমার মত ছাপোষা আমজনতাদের জীবনটা এমনই । এমন নিরীহ । মনে মনেই মনের আশা পুষতে হয় । আশাগুলো মরেও যায় মনের ভিতরেই ।

বুক ডলতে ডলতে একটা রিক্সা ডাকলাম....

“মামা, যাইবা ?’
“কই যাইবেন মামা ?”
“মিরপুর-১২”
“হ্ যামু”
“কত নিবেন?”
“ষাইট ট্যাকা”
“কিহ্ . . এত্ত ? কেন ?”
“বেশি কতা কইতা পারতাম না । ষাইট ট্যাকা দিয়া গেলে চলেন । না গেলে নাই ।“

মামা ক্ষেপে আছে । বোঝা গেল । আর কিছু না বলে রাজি হয়ে গেলাম ।
“ওকে মামা, চলেন”


রিক্সায় উঠে থম মেরে বসে আছি । রিক্সাওয়ালা মামা পুরো ভর প্যাডেলের উপর দিয়ে চালাচ্ছেন ।িএকবার ডানে হেলছেন । একবার বামে । আশেপাশের সব রিক্সাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি । কেমন যেন গর্ববতী লাগছে নিজেকে । ভয়ভয় ও করছে । যদি এ্যাকসিডেন্ট করে ? তাইলে সব গর্ব ফুসসসসসস...
সোজা উপরের টিকিটও ধরতে হতে পারে । সবে বিয়ে করছি । এত তাড়াতাড়ি উপরে যাবার ইচ্ছা নাই ।
তাই মামাকে স্বরণ করলাম ।

“মামা, ইট্টু আস্তে চালালে হয়না ? এ্যাকসিডেন্ট করবেন তো ।”

মামা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেক একবার । আমার মুখটা দেখার জন্যই হয়তো । ভয় পাচ্ছি; বুঝতে পেরে কিছুটা গতি কমালেন। আমিও ওনার মলিন মুখটা একবার দেখে নিলাম । আমি অন্যন্ত বাঁচাল গোছের মানুষ । পৃথিবীতে যদি বাঁচাল নামের কোন প্রাণী থাকে তাইলে সেইটা আমি । কান ঝালাপালা করে দেই আশপাশের মানুষগুলোর । অনেক চুপ থেকেছি । আর না । মুখ খুললাম এইবার ।

“মামার নাম কি ? বলা যাবে?”

“নাম, মালেক মিঞা । ক্যান মামা ?”

“না মামা, এমনিতেই । তো মামার মুখ শুকনা কেন ? কিছু হয়েছে ?

“গরীবের কথা শূইনা কি করবেন মামা ? বাদ দ্যান”

ওনার কথাটায় যে কত কষ্ট লুকানো আছে, সেটা আঁচ করতে পারছি হয়ত কিছুটা । তাই বুকটায় কেমন যেন অন্যরকম ফিল করলাম ।

“না মামা, বলেন । কোন অসুবিধা নেই । আমিও নিম্ন শ্রেণীর মানুষ । বলেন”

মামা একটা একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার সেটা বের করলেম । মধ্যিখানে একটা “হাহ্” - শব্দ হল । মামা শুরু করলেন।

“কি আর কমু মামা ? আইজ বউডার লগে ম্যালা চিল্লাইছি”

“কেন মামা ?” জানতে চাইলাম কৌতুহল নিয়েই ।

“আইজ ফিরনের সময় একটু গরুর মাংস নিয়া যাইতে কইছিল । আমরা গরীব । আমগো সাধ-আল্লাদ থাকোন লাগেনা । বউডা ম্যালা কষ্ট কইরা সংসার চালায় । আমার একলার ট্যাকায় চলেনা । হেয় মাইষের বাড়িত কাম কইরা ট্যাকা আনে । তাই জইন্নে তড়াতড়ি চলাইতেছিলাম । আরও প্যাছেঞ্জার তুলমু । আইজ য্যামনেই হউক গোস্তো নিয়া বাড়িত যামু । কিন্তু ট্যাকা আরও লাগবো ।”

রিক্সার গতি কমে গিয়েছে অনেকটা । খেয়াল করিনি দুজনের একজনও । মামা প্রথম খেয়াল করেই আবার আরেকটু গতি বাড়িয়ে বললেন,
“মামা, গতি বাড়ামু ? কিছু হইবোনা । দেইখেন”

“. . . . . .”

আমাকে চুপ থাকতে দেখে এবার একটু জোরেই ডাকলেন..
“মামা”

নড়ে উঠলাম যেন । কল্পনা থেকে ফিরলাম । হারিয়ে গেছিলাম রিক্সাওয়ালা মামার মাঝেই ।
“কি বললেন মামা? ”

“মামা, কইলাম- গতি বাড়ামু ?”

“না মামা । রিক্সা থামান । একটু বাজার করবো”

মামার মুখটা কালো হয়ে গেল । এত তাড়া ওনার । এরই মাঝে ওনার সময় নষ্ট ।
কিছু না বলে রিক্সা থামালেন ।

রিক্সা থেকে নেমে বললাম, “রিক্সা সাইড করে আমার সাথে আসেন মামা”

মন খারাপ করে আছেন । তাতে কি ? ওরা গরীব । ওদের সময়ের কোন মূল্য নেই ।

বাজার শেষে আবার যাত্রা শুরু । মামাকে বললাম, “মামা; আপনার বউ, মানে ‘মামী’ তো এখনও রাগ করেই আছে মনে হয় ।”

‘হু’ বলে জবাব দিলেন শুধু ।

“মামী কি খাইতে ভালবাসে ? জানা আছে ?”

এবার মামা কিছুটা হালকা হয়েই বললেন,
“ওই ত অংপুরের মাইয়া । পান খায় খুব । দিনভরা পান চিবায় । ছাগলের লাহান” বলেই শুকনো মুখে একটা মন ভেজানো হাসি দিলেন । এ হাসিতে কোন কৃত্রিমতা নেই । বিধাতাই এর কারিগর ।

“তাইলে মামা, যাবার সময় মামীর জন্য পান নিয়ে যাবেন । তাহলে দেখবেন রাগ থাকবেনা আর”

মামা কি যেন ভেবে সম্মতি জানালেন । বাসার সামনের গলিতে এসে পড়ছি । রিক্সা এরচে বেশি যেতে পারেনা
রিক্সা থেকে নেমে মানিব্যাগ বের করে টাকা গুনছি । দেব বলে।

“মামা, কয়ডা ট্যাকা বেশি দিবেন? আপনের বাজার করবার গিয়া দেরী হইয়া গ্যাছে ।”

“কেন? ভাড়া তো ঠিক করেই উঠলাম । এক পয়সাও বেশি না”

“ঠিক আছে” গলাটা কেঁপে উঠল ওনার ।

ভাড়া দিয়ে চলে আসতেছি । মামা ডেকে বলল,
“মামা, এটা তো পাঁচ শ ট্যাকার নোট”

মুচকি হেসে বললাম,
“ঐটা আপনার”

মামা, অবাক হয়ে শুধু শুনলেন ।

ফিরে আসছি..
আবারও ডাক পড়ল ।

“মামা, বাজারের ব্যাগ তো ফালায় গ্যালেন!”

“ঐটাও আপনার । ৫ কেজি মাংস আছে । মামীকে দিবেন । আর হ্যাঁ, যাবার সময় পান নিতে ভুলবেন না যেন”

আমিও একটা হাসি দিলাম । রিক্সাওয়ালা মামার মত হয়নি, জানি । তার কুটিলতা বিহীন হাসির কাছে আমারটা কিছুই না ।

কিন্তু, একি ! মামা কাঁদছে ! মুক্তোদানার মত চকচক করছে ওনার চোখগুলো । কিছু বলতে চাইছেন হয়তো । কিন্তু বলতে পারছেন না । কারণটা আমি জানি । এটাই ভালবাসা । ভালবাসা মানুষকে হাসায় । আবার কাঁদায়ও ।

বিদায় নিলাম মামার কাছে ।

গলির শেষ মাথায় এসে পিছনে তাকালাম একবার । মামা তখনও দাঁড়িয়ে আছে ।

মোড় ঘুরতেই আড়াল হয়ে গেলাম । আর দেখা যাচ্ছেনা ।

মামীর রাগ ভাঙ্গাতে আজ মামাকে হয়ত অনেক কিছুই করতে হতে পারে । কান ধরে উঠবস । আরও কত কি ! ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেললাম । কিন্তু সে হাসি স্থায়ী না । মিষ্টি কথা হবে তাদের মাঝে । সবাই ঘুমিয়ে পড়বে । জেগে থাকবে তারা । রাত জাগা পাখির মত ।

বাসার সামনে আসতেই মনে পড়ল, আল্লারে । মাইরালাইসে ..... . . .
আজ আমার খবর আছে । বারোটার খবর । বারোটার আগে বাসায় ঢুকতে পারব না শিওর । আজ আমাদের ম্যারেজ এ্যানিভার্সারী । ভুলেই গেছি ।

আজ বাড়িতে আগুন জ্বলবে । হরতাল পালিত হবে । জ্বালাও ! পোড়াও ! ভাংচুর !
চট করে মামার কথা মনে পড়ল । সে হয়তো যাবার সময় পান কিনে নেবেন । বউ এর রাগ ভাঙ্গাতে ।

আমার পাগলীটা আইসক্রিম ভালবাসে । ছুট লাগালাম দোকানে । যে করেই হোক আজ আইসক্রিম নিয়ে বাড়ি ফিরবোই ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×